রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কাশ্মীর ও রোহিঙ্গা ইস্যু দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন


সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কাশ্মীর ও রোহিঙ্গা সমস্যা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। একদিকে এই দুটো অঞ্চলের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিতিশীলতাকে যেমনি সংঘাতময় করেছে, ঠিক তেমনি উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক বরাবরই উত্তেজনাকর। কাশ্মীর নিয়ে অতি সম্প্রতি দেশ দুটো আবারো এক ধরনের 'মনস্তাত্তি্বক যুদ্ধ' এ লিপ্ত হয়েছে। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বা এলওসির কাছে ভারতীয় সেনারা গলা কেটে অন্তত ১২ জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেছে বলে জাতিসংঘের একটি পর্যবেক্ষক দলের কাছে অভিযোগ করেছে পাকিস্তান। দেশটি আরো বলেছে, ১৯৯৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত এসব পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। একই সময় ২৯ জন বেসামরিক পাকিস্তানি নাগরিককেও হত্যা করেছে ভারতীয় সেনারা। পাকিস্তানের এই অভিযোগ সংক্রান্ত গোপন রিপোর্টটি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে ভারতীয় দৈনিক 'দি হিন্দু'। এ ধরনের একটি রিপোর্ট যে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আজকের নয়। ১৯৯৭ সালের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বলা হয়_ ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে অপহরণ, ধর্ষণ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় কাশ্মীরে আজো হত্যাযজ্ঞ হচ্ছে। এখানে বলা ভালো ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় কাশ্মীর প্রশ্ন ছিল উহ্য। পরবর্তী সময়ে কাশ্মীরের মহারাজ্য ভারতে যোগ দেন কিন্তু এই সংযুক্তির সাথে কাশ্মীরের জনগণের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ফলে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের পাহাড়ী জনগণ বিদ্রোহ করে। অক্টোবরের (১৯৪৭) এই বিদ্রোহের সূত্র ধরেই পাকিস্তান ভারতের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা কাশ্মীরের একটা অংশ দখল করে 'আজাদ কাশ্মীর' নামে একটি রাজ্য গঠন করেছিল, যা আজ পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃত। কাশ্মীর মূলত ৩টি এলাকায় বিভক্ত। মুসলমান অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চল, পূর্বে বৌদ্ধ প্রধান লাদাখ এবং দক্ষিণে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা জম্মু। জাতিসংঘে কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠানের একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও ভারত ওই সিদ্ধান্ত কখনো কার্যকর করেনি। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে যে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে : ১. কাশ্মীরী জনগণের প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণ, ২. ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান, ৩. কাশ্মীরকে বৃহৎ ভারতের একটি 'কলোনিতে পরিণত করা। ভারত সংযুক্তির সময় কাশ্মীরীদের একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু সে প্রস্তাব কখানোই কার্যকরী করা হয়নি। বরং ধীরে ধীরে সংবিধানের সেই ধারা (ধারা ৩৭০) সংশোধন করা হয়েছিল। ভারতীয় শাসকরা কাশ্মীরকে একটি 'বিশেষ মর্যাদা' দেয়ার বদলে কলোনিয়াল প্রভুদের মতোই ব্যবহার করে আসছেন। কাশ্মীরের ব্যবসা-বাণিজ্য আজ কাশ্মীরীদের হাতে নেই। কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সংম্পদ ও এর অর্থনীতির ওপর কাশ্মীরী জনগণের কোনো অধিকার নেই। এর নিয়ন্ত্রণ ভারও অকাশ্মীরীদের হাতে। এ কারণেই জনগণের অসন্তোষ বাড়ছিল। অতি সম্প্রতি এর সাথে যোগ হয়েছে সর্বভারতব্যাপী হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান। এতে করে মুসলমান প্রধান কাশ্মীরী জনগণ এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কাশ্মীরে ভারতীয় নেতাদের বিমাতাসুলভ আচরণ এবং সেনাবাহিনীর অত্যাচার সেখানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনার জন্ম দিয়েছে। এই চেতনা অত্যন্ত শক্তিশালী। এটা স্পষ্ট যে, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ছাড়া পাক-ভারত সম্পর্ক উন্নয়ন অসম্ভব। কাশ্মীর নিয়ে দুটো (১৯৪৭, ১৯৬৫) যুদ্ধ হলেও তাতে কোনো সমাধান হয়নি। ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিতে কাশ্মীর প্রশ্নে স্থিতাবস্থা এবং জম্মু ও কাশ্মীরের বিষয়গুলো মীমাংসার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। এরপর দুটো দেশ লাহোর ঘোষণা (বাজপেয়ী ও নওয়াজ শরীফ) স্বাক্ষর করেছিল ১৯৯৯ সালে। লাহোর ঘোষণায় বলা হয়েছিল জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুসহ সব ইস্যু সমাধানে উভয়পক্ষ তাদের প্রচেষ্টা জোরদার করবে। এই ধারাবাহিকতায় আগ্রা শীর্ষ সম্মেলনে (জুলাই ২০০১) অনুষ্ঠিত হলেও তাতে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। এমনকি ২০০১ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আব্দুল্লাহ একটি স্বায়ত্তশাসন দেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু নয়াদিল্লী এ ব্যাপারে তেমন উৎসাহ দেখাননি। দীর্ঘদিনের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। লস্কর-ই-তৈয়বা বা আহলে হাদিস-এর নাম একাধিকবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এরা আজ একটি পক্ষ। এদের সাথে যদি আলোচনার কোনো উদ্যোগ নেয়া না হয়, তাহলে কাশ্মীরে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যাবে না। এই স্থিতিশীলতা বিপন্ন হলে, তাতে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াও আক্রান্ত হবে। পাকিস্তান ও ভারতও একটি ফ্যাক্টর। সিমলা, লাহোর ও আগ্রা ঘোষণার আলোকে কাশ্মীর প্রশ্নে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে। কাশ্মীর সমস্যার পাশাপাশি অতি সম্প্রতি রোহিঙ্গা সমস্যা এ অঞ্চলের রাজনীতিতে বড় ধরনের উত্তাপ সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গারা, যারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান, তারা মূলত মিয়ানমারের নাগরিক। শত বছর ধরে তারা মিয়ানমারে বসবাস করলেও, গেল বছর মিয়ানমার সরকার ব্যাপকহারে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের গ্রহণ করতে বাংলাদেশের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করে। এই ঘটনায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি চক্র অপতৎপরতায় লিপ্ত। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যাপকহারে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে এই রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্কের অবনতি হবে কিনা? এমনিতেই দুদেশের মাঝে সম্পর্ক যে উষ্ণ রয়েছে, তা বলা যাবে না। গত মে মাসেই (২০১২) তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশখাবাদে ও আইসির উদ্যোগে শরণার্থী বিষয়ক একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা সমস্যাটা তুলে ধরেছিলেন। তিনি সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সমাজে ক্ষতির প্রভাব ফেলবে। এর প্রতিক্রিয়ায় কিনা তা বলতে পারব না। কিন্তু বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা সমস্যাটা আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়। ঠিক তার দু'সপ্তাহ পরেই গত ৩ জুন (২০১২) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুনরায় জাতিগত দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। এই জাতিগত সহিংসতায় সেখানে প্রায় ৫২ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছিলেন। যদিও সেখানে এই জাতিগত সহিংসতার ইতিহাস আজকের নয়। বরং বেশ পুরনো। মূলত সেখানে বসবাসকারী কয়েক লাখ মুসলমান, যারা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয় না। ১৯৭৮ ও ১৯৯১ সালে এ ধরনের জাতিগত সহিংসতায় ব্যাপকহারে রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। কক্সবাজার এলাকায় এসব রোহিঙ্গা নানা রকম অবৈধ কর্মকা-ে লিপ্ত। দু'দুটো ক্যাম্পে এরা বসবাস করে। জাতিসংঘের উদ্যোগ পরিচালিত এই দুটো ক্যাম্পে রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ২৮ হাজার। কিন্তু এর বাইরে আরো প্রায় দু'লাখ রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করছে। স্পষ্টতই বাংলাদেশ আর অতিরিক্ত রোহিঙ্গা গ্রহণ করতে পারে না। অবৈধ রোহিঙ্গারা আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বিনীতভাবে পশ্চিমা বিশ্বের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয় রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করা, তখন তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন। বাংলাদেশ আর রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে পারে না। এতে করে দু'দেশের মাঝে একটা ভুল বোঝাবুঝির যেন সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। আগামী যে কোনো মাসে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সেটাও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। তবে আমরা রোহিঙ্গা প্রশ্নে চুপ করে বসে থাকতেও পারি না। রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের সাথে নব্বই এর দশকের ইউরোপের সাবেক যুগোসস্নাভিয়া রাষ্ট্রের অন্তর্গত বসনিয়া হারজেগোভিনার পরিস্থিতির তুলনা করতে পারি। শতকরা ৪৪ ভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠী হত্যা ও ধর্ষণ ও উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হয়েছিলেন বসনিয়া হারজেগোভিনায়। সার্বিয়া এই দেশটিকে সার্বিয়ার একটি আশ্রিত রাজ্য বানাতে চেয়েছিল। বৃহৎ পরিসরে বসনিয়ার পরিস্থিতির সাথে আজকের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির অদ্ভুত এক মিল আমরা লক্ষ্য করি। মুসলমানরা রাখাইন রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও একটি 'বৌদ্ধ রাজ' কায়েমের লক্ষ্যে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধ জঙ্গিরা মুসলমানদের উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছে। তারা সহযোগিতা পাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর। মিয়ানমারে সাবেক জেনারেল থেইন সেইন 'বেসামরিক' হলেও তার ক্ষমতার মূল উৎস সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানে কাজ করছে মিয়ানমারে একটি 'বৌদ্ধ রাজ' প্রতিষ্ঠা করার মানসিকতা। অংসান সূচিও এর বাইরে নন। তিনি রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের সমালোচনা করেননি। বরং পরোক্ষভাবে থেইন সেইন সরকারকে সমর্থন করেছিলেন। আমার ধারণা ব্যাপকহারে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করার সুযোগ দিয়ে কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘিরে একটি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে পারে একটি 'চক্র' যাদের সাথে বৈদেশিক চক্রের যোগাযোগ রয়েছে। কক্সবাজারের বসবাসরত রোহিঙ্গারা নানা অপকর্মের সাথে যুক্ত। ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে তারা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের জন্য নানা সমস্যা সৃষ্টি করছে। রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে সরকারকে আরো সতর্ক হতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নানা সমস্যা। চলতি ২০১৩ সালটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালে নির্বাচন হবে, অথবা দেশগুলো নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। ভারতে নির্বাচন ২০১৪ সালে। তবে আগাম নির্বাচনও হতে পারে। এমনি এক পরিস্থিতিতে কাশ্মীর ও রোহিঙ্গা ইস্যু দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। এতে করে দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে।Daily JAI JAI DIN 12.03.13

0 comments:

Post a Comment