সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের 'বিশেষ সম্পর্ক' স্থাপন বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির জন্য একটি 'টার্নিং পয়েন্ট' হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য। বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে টানাপড়েন চললেও প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এ সফর প্রমাণ করে ভারতের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশকে কত গুরুত্ব দিচ্ছে। এর আগে নয়াদিল্লি বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ভাষায় সেটা ছিল 'নিঃশব্দ রণকৌশল পরিবর্তন'। আর সরকারি ভাষ্য হচ্ছে, 'বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও বহুদলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের চলমান যোগাযোগের অংশ।' নিঃসন্দেহে ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এ মূল্যায়ন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফর যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। 'পুরনো সম্পর্ককে নতুন করে ঝালাই করার একটি উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৈদেশিক নীতিতে উজ্জ্বল একটি অধ্যায়; যদিও ১৯৭৫ সালের পর থেকে এ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ ছিল না।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি আমাদের নীতিনির্ধারকরা। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ ও ১৯৭৪ সালে মস্কো গিয়েছিলেন। এরপর কোনো সরকারপ্রধান মস্কো সফরে যাননি। রাশিয়া একটি বিশ্বশক্তি। অথচ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণ ছিল না। এখন প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফরের মধ্য দিয়ে নতুন করে সম্ভাবনার একটি ক্ষেত্র তৈরি হলো। এই সম্পর্ককে এখন আমাদের উন্নয়নের আলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যাঁরা বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা জানেন ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক ছিল চমৎকার। মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের বাধ্য করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক আসরে সোভিয়েত পক্ষ অবলম্বন করে বাংলাদেশ যে বৈদেশিক নীতি রচনা করেছিল, তা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ভিন্ন ধারণার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তেমন উষ্ণ ছিল না; যদিও ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। বিশ্ব অর্থনীতিতেও রাশিয়া তেমন একটা ভূমিকা রাখতে পারছিল না। ফলে বাংলাদেশ রাশিয়ার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই পুরনো সম্পর্ককে ঝালাই করার উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন মস্কো যান, তখন সংগত কারণে পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এদিকে থাকে। শেখ হাসিনার মস্কো সফরের সময় তিনটি চুক্তি ও ছয়টি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি দুটি। এক. প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে রাশিয়া থেকে সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র ক্রয়। দুই. পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রস্তুতিমূলক অর্থায়নে সহযোগিতা। এখানে বাংলাদেশ ৫০ কোটি ডলার ঋণ পাবে। রূপপুরের পারমাণবিক কেন্দ্রের কারিগরি গবেষণার জন্য এই অর্থ। কেন্দ্র নির্মাণে কত টাকা লাগবে, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। এ ব্যাপারে পরে চুক্তি হবে। আপাতত দুই বছরের মধ্যে এই ৫০ কোটি ডলার ব্যয় করা হবে কারিগরি গবেষণার জন্য। এর বাইরে যেসব এমইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও আট হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ক্রয় বিতর্ক বাড়াবে। সরকারের শেষ সময়ে এসে সরকার এত বিপুল অর্থ ব্যয় করার যখন উদ্যোগ নেয়, তখন বিতর্ক থাকবেই। প্রথম বিতর্ক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে বিনিয়োগ অনেক বেশি। তুলনামূলক বিচারে খরচ অনেক বেশি। সেই সঙ্গে রয়েছে নিরাপত্তার প্রশ্নটি। রাশিয়া বিশ্বের অস্ত্রবাজারে অন্যতম বিক্রেতা। তাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই অস্ত্র বিক্রি। স্টকহোমের পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে (সিপরি), রাশিয়া বর্তমানে অস্ত্র বিক্রির শীর্ষে রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যে দেশটি এখনো বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, সেই দেশটি যখন আট হাজার কোটি টাকা দিয়ে অস্ত্র ক্রয় করে, তখন বিশ্বে বাংলাদেশের এ ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই এবং তা উঠেছেও।
রাশিয়ার ঋণের ধরন (যা দিয়ে অস্ত্র কেনা হবে) দেখে বলা যায়, এটি নন-কনসেশনাল। বাংলাদেশে কোনো স্বীকৃত প্রতিরক্ষা নীতিমালা নেই। কাজেই কোন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই অস্ত্র কেনা হলো তা পরিষ্কার নয়। আমাদের সেনাবাহিনীর অস্ত্রের অন্যতম উৎস হচ্ছে চীন। এখন সেই স্বাভাবিক সোর্সকে বাদ দিয়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা, সংগত কারণেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতির কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত কি না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারে। তবে এটা যে পশ্চিমা বিশ্বে ভুল সিগন্যাল পৌঁছে দেবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। চীন বিষয়টি ভালো চোখে দেখবে না। ফলে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তাতে ভাটা পড়তে পারে। ইতিমধ্যে আইএমএফের পক্ষ থেকে নেতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়েছে। এখন আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়েও বিলম্ব হতে পারে। আইএমএফ বাংলাদেশকে ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার সুদমুক্ত ঋণ দেবে। এর প্রথম কিস্তি ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার আমরা পেয়ে গেছি। এখন দ্বিতীয় কিস্তি আটকে যেতে পারে। তবে আমাদের জন্য যা দুর্ভোগের, তা হচ্ছে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার আগে বিষয়টি আমরা জানলাম না। একজন সিনিয়র জেনারেল (অব.) একটি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অস্ত্র কেনা হয়েছে (আমার দেশ, ২০ জানুয়ারি)। অভিযোগ উঠেছে, রাশিয়ার অস্ত্র ক্রয়ে একটি 'তৃতীয় পক্ষ'-এর উপস্থিতি রয়েছে। এই চুক্তি নিয়ে যে অস্পষ্টতা, তা হচ্ছে এর সঙ্গে কোনো শর্ত যুক্ত কি না; যদিও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কোনো শর্ত যুক্ত নেই। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অস্ত্র কেনায় সুদ দিতে হবে ৪.৫ শতাংশ। ব্যবহার করতে হবে এই ঋণ ২০১৩-১৭ সালের মধ্যে। আর ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০ কিস্তিতে ১০ বছর ধরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, অস্ত্র ক্রয়ে কোনো অস্বচ্ছতা নেই। বলা হয়েছে, এই অস্ত্র সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহার করবে। এই পরিসংখ্যান নিয়েও কথা বলা যায়। বিশেষ করে সুদের হার বেশি বলেই মনে হয়। তবে আমার কাছে যা মনে হয় তা হচ্ছে, এই চুক্তি আমাদের বৈদেশিক ও সামরিক নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত বহন করে। কেননা আমাদের বৈদেশিক নীতি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চীনের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের বিমান বাহিনী চীনা বিমান ব্যবহার করে। সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও চীনের তৈরি। আমাদের সামরিক নেতৃত্ব চীনা যুদ্ধাস্ত্রের ওপর অনেক দিক থেকেই নির্ভরশীল। আমাদের উন্নয়নে চীন অন্যতম অংশীদার। চীন আমাদের নিকট প্রতিবেশীও। আমাদের উন্নয়নে চীনের উপস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই সরকারপ্রধান চীনে গিয়েছিলেন, এমনকি বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াও অতি সম্প্রতি চীনে গিয়েছিলেন এবং তাঁরা দুজন লালগালিচা সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। চীন সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই মহাসড়ক ও গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের চেহারা আগামী দশকে বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশ হতে পারে এ অঞ্চলের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। চীন শ্রীলঙ্কার হামবানটোটায় (প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জন্মস্থান) গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে একটি বিমানবন্দরও চীন তৈরি করে দিয়েছে। সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন আগ্রহও দেখিয়েছিল। এটা নির্মিত হলে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের সাত বোন রাজ্যগুলো যেমন এটি ব্যবহার করতে পারবে, তেমনি পারবে চীন, তথা মিয়ানমারও। এখন সংগত কারণেই রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের এই সামরিক চুক্তি চীন খুব সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। চীনারা এসব ক্ষেত্রে খুবই রক্ষণশীল। তারা খুব দ্রুতই প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বোধকরি এ ব্যাপারে কোনো সরকারি মন্তব্যও আমরা পাব না। তবে যা হবে, তা হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনা আগ্রহের ঘাটতি আমরা দেখতে পাব। এই মার্চে চীনে নয়া নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করছে। শি জিন পিং ইতিমধ্যে পার্টিপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং মার্চে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও নেবেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ধারণা রয়েছে। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং খালেদা জিয়া যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এখন এই অস্ত্র ক্রয় চুক্তিতে চীনে বাংলাদেশ ইমেজ সংকটের মুখে পড়তে পারে।
ফলে একটা ধারণার জন্ম হওয়া স্বাভাবিক যে বাংলাদেশ আবার মস্কো-নয়াদিল্লি অক্ষে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সমাজে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ- তার একটির সমাধান হয়নি। বারবার ভারতের উচ্চ পর্যায় থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধের কথা বলা হলেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। ঢাকায় ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ ঠিক একই কথা বলে গেলেন। তিস্তা চুক্তি হবে এমন কথাও সালমান বলেছেন। অথচ পশ্চিম বাংলার একজন মন্ত্রী বললেন উল্টো কথা- পশ্চিম বাংলার স্বার্থ রক্ষা হয় না এমন কোনো চুক্তিকে পশ্চিম বাংলা সমর্থন করবে না। তাহলে কী চুক্তি হতে যাচ্ছে? তাতে আদৌ বাংলাদেশের স্বার্থ কি রক্ষিত হবে? নাকি শুধু একটি চুক্তির জন্য একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ? এ দেশের আমজনতা এ বিষয়ে কিছুই জানে না। ভারতীয় ঋণের ১৩টি প্রকল্পের মধ্যে দুই বছরে মাত্র দুটি বাস্তবায়িত হয়েছে। অনেক ইস্যু রয়ে গেছে, যার সমাধান আজও হয়নি।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান সরকারের আমলে গত চার বছরের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের বড় অভাব। তবে বাংলাদেশ অকৃতজ্ঞ জাতি নয়। আমরা আমাদের 'বন্ধুদের' সম্মান জানাতে জানি। প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের খাঁটি 'বন্ধু'। পারিবারিকভাবেও তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। তিনি নীতিনির্ধারণে কোনো প্রভাব খাটান না বটে। কিন্তু তাঁর মতামতকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার উপেক্ষা করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী আগস্টে নয়াদিল্লি যাচ্ছেন। তিস্তা চুক্তি ওই সময়ই স্বাক্ষরিত হবে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরো উন্নত হোক।Daily KALERKONTHO03.03.13
0 comments:
Post a Comment