প্রণব মুখার্জির আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন নেই। হয়তো তিনি সত্যি সত্যিই চান সমস্যাগুলোর সমাধান হোক! কিন্তু সমস্যা ভারতের আমলাতন্ত্র নিয়ে। সেই সাথে রয়েছে ভারতের নীতি নির্ধারকদের ‘মাইন্ড সেটআপ’। তারা বাংলাদেশকে কখনো সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেছে, এটা আমি মনে করি না। ভারত বড় দেশ। আগামি ৩০ বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি হবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি। ভারতে প্রচণ্ড দারিদ্র্যতা থাকলেও, আগামি ৩০ বছরের মধ্যে মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলার। ভারতের এই অর্থনীতি আমাদের অর্থনীতিকেও গ্রাস করবে। আমাদের উন্নয়নে ভারত একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে তেমনটি হচ্ছে না। দেখা গেছে দ্বিপাক্ষিকতার বেড়াজালে ভারত এককভাবে সুবিধা নিচ্ছে। বিভিন্ন ইস্যুতে যে সমস্যা রয়েছে তা সমাধানে ভারতের আগ্রহ কম। সীমান্ত হত্যা বন্ধ না হওয়ায় তা বাংলাদেশী মানুষদের ভারত বিদ্বেষী করে তুলেছে। ভারতীয় ঋণে ১৩টি প্রকল্প নির্ধারিত হলেও গত ২ বছরে মাত্র ২টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশী পণ্যের আমদানি বাড়ায়নি ভারত। নানা ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক বাঁধায় বাংলাদেশী পণ্য চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। বন্দী প্রত্যার্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তাতে ভারতের স্বার্থ বেশি। কানেকটিভিটির আড়ালে ভারতকে ট্রানজিট বা করিডোর দিলেও, নেপাল ও ভূটানের জন্য তা সম্প্রসারিত হয়নি। পানি ব্যবস্থাপনার কথা প্রণব মুখার্জি বলেছেন বটে, কিন্তু এখানে ভারতের কোনো উদ্যোগ কখনও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ২০১১ সালে মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূটান, ভারত, নেপাল ও চীনকে নিয়ে ‘গঙ্গা নদী অববাহিকা সংস্থা’ ও ‘ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকা সংস্থা’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ভারত তাতে সাড়া দেয়নি। বাংলাদেশের প্রচণ্ড বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাতে সিকিম থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কথা বাংলাদেশ বললেও, ভারত তাতে সম্মতি দেয়নি (ভারতীয় এলাকার উপর দিয়ে এই বিদ্যুৎ আনতে হবে)। ‘কুনমিং উদ্যোগ’ এর ব্যাপারেও ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প কিংবা টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে শঙ্কা, সে শঙ্কা দূর করতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি ভারত। স্বয়ং একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। সমুদ্রসীমা নিয়েও ভারতের সাথে আমাদের বিপদ আছে, যা এখন হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারাধীন।
তাই প্রণব বাবুর ঢাকা সফরের পর যে প্রশ্নটি থেকেই গেল, তা হচ্ছে এই সফরের পর সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা আছে, তা কী কাঁটবে? এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। ভারতীয় ‘মাইনড সেটআপ’-এ যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে উন্নতি আসবে না। ভারতকে উদার মনোভাব নিয়ে আসতে হবে। আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিক ভারতীয় মন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেছেন। বাংলাদেশের একাধিক মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা একধাকিবার ভারত সফর করেছেন। এর মধ্যে দিয়ে ভারত আমাদের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নানা কারণে। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে রাজনীতি, তাতে ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ‘ঐক্য’ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ সেই প্রভাবের বাইরে থাকতে পারে না। উপরন্তু ভারত একটি অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্ব ব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলীর মতে আগামি ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। তখন মাথাপিছু আয় ৯৪০ ডলার থেকে ২২ হাজার ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত যেখানে অবদান রাখতো মাত্র ২ ভাগ, তখন অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। সুতরাং এই অর্থনীতির প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশের উপর পড়বেই। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন একটি বড় দেশের পাশে যদি একটি ছোট দেশ থাকে, তাহলে ওই বড় দেশ ছোট দেশের উপর প্রভাব খাটায়। মেদভেদেভ (সাবেক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী) এর ধারণা ‘তড়হব ড়ভ চৎরারষবমবফ ওহঃবৎবংঃ’ অনেকটা এ ধারণাকেই সমর্থন করে। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে অতিমাত্রায় ‘ভারতমুখীতা’ সাম্প্রতিককালে বিতর্কের মাত্রা বাড়ালেও, বাস্তবতা হচ্ছে আমরা ভারতের ‘প্রভাব’ থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা এক জায়গাতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমরা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারিনি। আমাদের ‘প্রাপ্তি’ এখানে কম, ভারতের ‘প্রাপ্তি’ অনেক বেশি। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ২০১০ সালেই প্রধানমন্ত্রী ভারত গেছেন। ফিরতি সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসেন ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। এ ধরনের সফর ও পাল্টা সফরের মধ্যে দিয়ে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি ‘ফ্যাক্টর’। বেগম জিয়া এটাকে বিবেচনায় নিয়েই ভারতে গিয়েছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বেগম জিয়া ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। চীন সফরের সময় চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শিন জিন পিং, যিনি মার্চে (২০১৩) প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, বেগম জিয়াকে সাক্ষাৎকার দেন। সুতরাং দেখা গেল বেগম জিয়া যখন ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে আস্থায় নিতে চেয়েছিলেন, তখন উল্টো ভারতীয় নেতৃবৃন্দ মহাজোট সরকারকেই ‘প্রমোট’ করছে। প্রণব বাবুর ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে ‘শাহবাগ নাটকের’ দ্বিতীয় অংশ মঞ্চস্থ হলো। প্রণব বাবু প্রকারান্তরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকেই সমর্থন করে গেলেন। প্রণব বাবুর সফরের পুরোটা সময় মানুষ দেখেছে লাশের মিছিল। কিন্তু একবারও তিনি এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করলেন না। সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ড তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি, বড় হয়ে দেখা দিয়েছে শাহবাগীদের আন্দোলন। তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে তরুণ প্রজন্মকে উস্কে দিয়েছে মহাজোট সরকার। ১৯৭৩ সালে যাদেরকে আমরা দেখেছিলাম তিন দলীয় ঐক্যজোট গঠন করতে (যা বাকশালে রূপান্তরিত হয়েছিল), সেইসব মুখগুলো ও তাদের ছাত্র সংগঠন আজ শাহবাগে তৎপর। উদ্দেশ্য একটাই ১৯৭৫ সালের মতোই দেশ থেকে সব বিরোধী দলকে উৎখাত করা। প্রণব বাবুকে বাংলাদেশের মানুষ সম্মান জানিয়েছে। ‘জামাই’ হিসেবে তাকে বরণ করে নিয়েছে। তার পদের প্রতি তিনি সুবিচার করেননি।
15.03.13
0 comments:
Post a Comment