রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

দেশ যাচ্ছে কোন দিকে?

কতগুলো মানুষ মারা গেল এ ক’দিনে। লাশের সংখ্যা বাড়ছেই। দিনের পর দিন হরতাল হলো। বিএনপির হরতাল। জামায়াতের হরতাল, কিন্তু শেষটা কোথায়? এতগুলো জীবন চলে গেল, কাকে দায়ী করব আমরা? রাজনীতিকে? পুলিশকে? সরকারকে? কাকে আমরা দায়ী করব? একজন মানুষ যখন মারা যায়, অসহায় হয়ে যায় তার সংসার। যারা মারা গেছে, তাদের কারো স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। সেই স্ত্রী-সন্তান, মিডিয়া যাদের কোনো দিন খুঁজবে না, তাদের ভবিষ্যৎ কি? রাষ্ট্র তো তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেবে না! তাহলে? সমাজের বোঝা হয়ে গেল এইসব মানুষের সংসার। সবাই যে জামায়াতের সমর্থক, তা তো নয়।
তিন দিনের হরতালে জামায়াতকর্মীদের উন্মত্ততা ও জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বগুড়াসহ দেশজুড়ে জামায়াত যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তা দেখেছে এ দেশের জনগণ। থানা আক্রমণ করেছে তারা, পুলিশকে পিটিয়ে মেরেছে এবং একপর্যায়ে থানা রক্ষা করতে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল বগুড়াতে। রাজশাহীতে ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, আক্রমণ হয়েছে সংখ্যালঘুদের ওপর। এ অপপ্রবণতা চিন্তার কারণ।
২৮ ফেব্র“য়ারি যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার পর কিংবা তার চারদিন আগে ২৪ ফেব্র“য়ারি মানিকগঞ্জের গোবিন্দল গ্রামে পুলিশ যে তাণ্ডবলীলা চালায়, স্বাধীন বাংলাদেশে এ রকমটি আগে আর কখনো ঘটেনি। ২৮ তারিখের ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ অতিক্রম করছে। একটি সভ্য দেশে পুলিশ এভাবে মানুষ গুলি করে মারে, এ ঘটনার একটিও দৃষ্টান্ত দেখা যাবে না। ১৯৯৪ সালে আফ্রিকায় বুরোন্ডিতে হুতু তুতসি দ্বন্দ্বে কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। সেটা ছিল জাতিগত দ্বন্দ্ব। কিন্তু আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশে, যেখানে গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে, সেখানে কী দেখলাম আমরা পাখির মতো গুলি করে মেরেছে পুলিশ। চ্যানেলের পর্দায় চোখ রেখে যখন এ ধরনের দৃশ্য দেখছি, তখন ভাবতে আমার সত্যিই কষ্ট হয়
এ কোন গণতান্ত্রিক দেশে আমরা বসবাস করছি? এ কোন ধরনের গণতন্ত্র? মানুষের মত প্রকাশের অধিকার থাকবে। এটা গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। কিন্তু তাই
বলে গুলি করে মানুষ মারতে হবে? বিএনপির
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা এটি।
তার এই বক্তব্যকে অস্বীকার করা যাবে না। গণহত্যার প্রতিবাদে ৩ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। ওই হরতালে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল পরোক্ষ। একটা ভয়ের আবহ তৈরি হয়েছে। মানুষ বের হতে পারেনি ভয়ে। ২ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে অনেক ককটেল ফাটিয়ে যে ভয়ের আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছিল, তাতে সাধারণ মানুষ ছিল আতঙ্কিত। এই স্বাধীনতার মাসে এমনটি হওয়া উচিত ছিল না। আমি অবাক হয়েছি পুলিশের বেপরোয়া ভূমিকা দেখে। কোনো রকম হুঁশিয়ারি না দিয়ে পুলিশ যখন গুলি করে, তখন প্রশ্ন ওঠে বৈকি! মাত্র ৩ দিন আগে ‘আকদ’ হয়েছিল হেলেনার। মাদ্রাসাপড়–য়া এই ছাত্রী নিজ বাড়িতেই গুলিবিদ্ধ হলো গোবিন্দল গ্রামে। মৃত্যুর সঙ্গে সে এখন লড়ছে। যদি বেঁচেও যায়, তার প্রশ্নের জবাব কে দেবে? তার তো কোনো অপরাধ ছিল না। নিজ বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হলো সে।
আজ দুঃখ লাগে, যখন দেখি মিডিয়া এ প্রশ্নে কোনো উচ্চবাচ্য করে না। নারীবাদীরা কোথায় আজ? একটা মেয়ে তিনদিন আগে যার ‘আকদ’ হয়েছে, কোন অপরাধে পুলিশ তাকে গুলি করল? হেলেনাকে বাঁচাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন কুড়া-ভুসির দোকানদার নাসির। তাকে গুলি করে মারা হলো। সরিষা আনতে মাঠে গিয়েছিলেন কৃষক আলমগীর। পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করল। মসজিদের ইমাম শাহআলম। তার কি দোষ ছিল? তাকে হত্যা করা হলো। প্রবাসী নাজিম উদ্দিন। তাকে যখন গুলি করে হত্যা করা হয়, তখন তার হাতে পুলিশের হাতকড়া ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২২ জনের নামে মামলা করেছে পুলিশ। সেই সঙ্গে আসামি নিরীহ ৪ হাজার গ্রামবাসী। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হলো না, মামলা হলো নিরীহ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে, যারা কেউই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না! এরপরের ঘটনা দেশজুড়ে, চট্টগ্রাম থেকে রংপুর।
এ কেমন রাজনীতি? বেগম জিয়া বললেন গণহত্যা। প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের সিনিয়র নেতারা এর সমালোচনা করলেন অত্যন্ত নগ্নভাষায়। রাজনীতির জন্য পৃথিবীতে উজ্জ্বল হয়ে আছে কয়েকটি নাম নেলসন ম্যান্ডেলা, সুয়েকর্নো, নেহরু, নাসের ও মাহাথির অনেক নাম। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে বিশ্বকে চিনিয়েছিলেন বাংলাদেশের নাম। মাত্র ৪২ বছরের মধ্যে এ রাজনীতিকে আমরা কোথায় নিয়ে গেলাম? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। সেটা তো সবাই-ই চায়। তিনটি রায় হয়েছে, কিন্তু একটি রায় নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, যা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছে, তা কোনো মতেই কাম্য নয়। কিছু ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হয়েছে সাঈদীর রায়ে।
এটা স্বাভাবিক। তাদের কি অন্য কোনোভাবে নিবৃত্ত করা যেত না? পুলিশ কেন এত বেপরোয়া হলো? আমাদের সংবিধানে (৩৯-১, ৩৯-২ ক) তো সমাবেশ, মিটিং, মিছিল করার অধিকার স্বীকৃত। পুলিশের ভূমিকা কি কিছুটা বৈপরিত্য নয়? একদিকে প্রতিবাদী মানুষের (ধরে নিচ্ছি তারা জামায়াতি) গুলি করছে, অন্যদিকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের অবস্থান করতে দিয়েছে ও মিছিল করতে দিয়েছে। ব্রিটেনের একটি জনপ্রিয় সাইট Open Democracy-তে গত ২৭ ফেব্র“য়ারি একটি লেখা ছাপা হয়েছে (Shahbag : What revolution, Whose revolution)। প্রবন্ধটি লিখেছেন উইলিয়াম গমেজ, যিনি বাংলাদেশি ও এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনে কাজ করেছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন এভাবে, ‘The ruling Awami league government is trying to override the existing political system to remain in power beyond their democratic, mandate. The purposive actions and structural forces behind thus movement make it very clear what and who, the movement is for : the ruling political elite. The shahbag movement was never a peoples movement, but has been designed to disrupt the processes of social revolution, by uprooting the governments political opponents from the field to avoid a political revolution at the next election’  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য এটি। উইলিয়াম গমেজ একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষক। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের Centre for Applied Human rights-এ তিনি ভিজিটিং ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি সাইটে যখন এ ধরনের মন্তব্য প্রকাশিত হয়, তখন তাকে গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। আসলে সবকিছু ‘ঘটছে’ আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে। নির্বাচনের ৮-৯ মাস আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি সামনে চলে আসে। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়, ঠিক তখনই বদলে যায় রাজনীতির দৃশ্যপট।
গণজাগরণ মঞ্চ যখন প্রথম সংগঠিত হতে শুরু করে, এদেশের প্রায় সব মানুষই এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিল।
এমনকি বেগম জিয়া নিজেও এদের আবেগের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম শাহবাগ চত্বরের তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। এই দুর্নীতি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবর্মূতি আজ তলানিতে। এদেশের তরুণ প্রজন্ম যখন একাত্তরের ঘাতকদের বিচার চায়, আমি তখন আশান্বিত হই। কিন্তু শাহবাগ চত্বরে যা এখন প্রজন্ম চত্বর, সেখানে যখন দুর্নীতির স্লোগান উচ্চারিত হয় না, তখন আমি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। বিশ্ব ইতিহাস আজ তরুণদের।  যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যে ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট’ হয়েছে কিংবা কায়রোতে তাহরির স্কয়ারে যে আন্দোলন হয়েছে, সেখানে সমাজে অসমতা ও দুর্নীতির প্রশ্নটি ছিল মুখ্য। আজ আমরা বাংলাদেশে দেখলাম এর ঠিক উল্টোটি। অথচ আমাদের দেশে তরুণ সমাজের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। এরা প্রতিবাদী। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন ও পর্যায়ক্রমে এরশাদ তথা সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, প্রতিটি ক্ষেত্রে তরুণরাই ‘প্রতিবাদের প্রতীক’ হয়ে আন্দোলন সংঘটিত করেছে। কিন্তু আজ আমরা কী দেখলাম? সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি একটি শ্রেণী।
এটা ভালো হতো যদি এ প্রশ্নে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতো, কিন্তু তা হয়নি। সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর প্রজন্ম চত্বর আবারো জেগে উঠেছে। তারা বলছে ,তারা রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না। এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। সরকারকেই তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আইন তার নিজস্ব পথে চলবে। এখনো অনেক কাজ বাকি। আরো অনেক বিচার বাকি। গণজাগরণ মঞ্চ যদি আন্দোলন অব্যাহত রাখে, তখন বিচার বিভাগের ওপর তাদের হস্তক্ষেপের অভিযোগ আরো শক্তিশালী হবে। এটা ভালো নয়, মঙ্গলও নয়। এমন অভিযোগ পুষ্ট হোক তা আমাদের কাম্যও হতে পারে না। সাঈদীর রায় নিয়ে রাজনীতি যেভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে, তাতে এই রায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন ডেকে আনতে পারে।
প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ হত্যা করা এবং সেই হত্যার বিচার না হওয়া দেশে সুশাসনের অভাবের কথাই বলে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এই সুশাসনের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক National Intelligence Council (NIC) ২০১২ সালের যে lobal Trends রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে যে ১৫টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। ওই তালিকায় এশিয়ায় যে ৩টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে।
অপর দুটি দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। যুক্তি হিসেবে NIC উল্লেখ করেছে সংঘাতময় পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা। বাংলাদেশের সংঘাতময় পরিস্থিতি যে দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। আমরা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মেলাতে পারি না। তবে চাই একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সেই সঙ্গে সরকারি বাহিনী জনসাধারণের সঙ্গে ‘সেবক’-এর মতো আচরণ করবে, সেটাও আমাদের প্রত্যাশা। আমরা চাই না গোবিন্দলসহ দেশজুড়ে যা ঘটল, সেই ঘটনা দ্বিতীয়বার না ঘটুকু। এ ধরনের গুলিবর্ষণ তথা হত্যার ঘটনা একটি গণতান্ত্রিক সমাজে কাম্য নয়।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঢাকায় অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কূটনীতিকদের এই আশঙ্কা ফেলে দেয়ার মতো নয় এবং এটাকে বিবেচনায় নিতে হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত ৭ মার্চ বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের যে কথা বলেছেন সেই বক্তব্যকে বিবেচনায় নিয়েই অতিদ্রুত পূর্ব শর্ত ছাড়া সংলাপ সূচনা করতে হবে এবং এর মধ্যে দিয়েই সংকট  উত্তরণ সম্ভব। ইতিমধ্যে ব্যবসায়ী মহল থেকে অর্থনীতির মন্দাভাবের যেসব কথা বলা হয়েছে তাও বিবেচনায় নিয়ে অতিদ্রুত সবাইকে সংযমের পরিচয় দিতে হবে।
পুলিশকে সহনশীল আচরণ করতে হবে। জামায়াতের ব্যাপারে প্রয়োজন হলে একটি জাতীয় সংলাপ ডেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশ এক মহাসংকটে এই সত্য কোনো কারো পক্ষেই এড়ানো দুরূহ। এভাবে চলতে পারে না। কোনোভাবেই পরিস্থিতি আর নাজুক হতে দেয়া যাবে না।
Daily MANOBKONTHO
09.03.2013

0 comments:

Post a Comment