সামনের দিনগুলো যে ভালো, তা দিব্যি দিয়ে বলতে পারছি না। গণজাগরণ মঞ্চ ও হেফাজতে ইসলামের পাল্টাপাল্টি অবস্থান আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। এরই মধ্যে আবার গঠিত হয়েছে একটি নাগরিক সমাজ, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়। তাদের এই দাবির প্রতি কারো কোনো দ্বিমত নেই। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি, তাতে সমর্থন আছে অনেকেরই। কিন্তু যে প্রশ্নটি অনেকেই করার চেষ্টা করেন তা হচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ী ও অব্যাহতভাবে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি চলতে থাকে, তাতে নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে এবং একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে বলার যে বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব ফেলতেই এ আন্দোলন। আইন অনুযায়ী বিচারপ্রক্রিয়া চলছে। আইন তার নিজ গতিতে চলুক। আমরা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নই।
এই মুহূর্তে আমাদের সামনে অনেকগুলো রাজনৈতিক বিষয় রয়েছে। এসব বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। বিশেষ করে দুটি বিষয়ে এই ঐকমত্য খুবই জরুরি- এক. দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমরা কোন প্রক্রিয়ায় করব, দুই. বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি কে হবেন, সে ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছা। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আইন আছে, সংসদ আছে, সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব নীতিমালাও আছে। সুতরাং সরকার একটি সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে একটি গণভোটও দেওয়া যায়। কিন্তু বড় প্রশ্ন, নির্বাচন হবে কোন সরকারের অধীনে? সরকারের মেয়াদ শেষ হবে জানুয়ারিতে (২০১৪)। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে যেকোনো এক সময় এই নির্বাচন হতে হবে। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। ধারণা করছি, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর- এই সময়সীমার মধ্যেই নির্বাচন হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী' হিসেবে রেখে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনে তো বিএনপি অংশ নেবে না! তাহলে সমাধান হবে কোন পথে? বিএনপির দাবি করা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার গঠিত হলে বিএনপি তাতে অংশ নেবে এবং নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা তাতে বাড়বে। এখন বিএনপির অবস্থান কিছুটা নমনীয় হওয়ায় বিএনপির সঙ্গে এ ব্যাপারে সংলাপ করা যায়। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রশ্নটিও আছে। এখানেও ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে মহাজোট সরকার, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ 'রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ' থেকে দেখবে। আমি তাতে দোষের কিছু দেখি না। শেখ হাসিনা প্রথম যখন প্রধানমন্ত্রী হন (১৯৯৬-২০০১), তখন তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সেদিন তাঁর সেই সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সব সময় প্রধানমন্ত্রীর কথামতো চলেননি। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে তাঁকে নানা গঞ্জনা সইতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার পর প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করতে এতটুকু দ্বিধা বোধ করেননি। এই ইতিহাস প্রধানমন্ত্রী জানেন ও উপলব্ধি করেন। সুতরাং সব ধরনের 'বিতর্ক' এড়াতে তিনি কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে পুনরায় মনোনীত করবেন- এই আস্থাটা রাখতে পারছি না। দুজন প্রবীণ রাজনীতিবিদের নাম উঠেছে। রাজনীতিতে তাঁদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি এবং যোগ্যতার মাপকাঠিতে কেউ কারো চেয়ে কম নন। কিন্তু সময়টা বড় খারাপ। পরিস্থিতি মহাজোট সরকারের অনুকূলে তা বলা যাবে না। এমনকি মহাজোটের অন্যতম শরিক এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি যেকোনো সময় মহাজোট ত্যাগ করতে পারে। এরশাদকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি 'চমক' দিতে পারেন! কিন্তু তিনি সেটা করবেন, তা বোধ করি জাতীয় পার্টির কোনো সদস্যও বিশ্বাস করেন না। তাই ঘুরেফিরে ওই দুই ব্যক্তির দিকেই দৃষ্টি অনেকের। একটি ইংরেজি দৈনিক তো ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকেই চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছে। তার পরও আমরা আশা করব, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রশ্নে প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে একটা 'আলোচনা' হোক। তাদের মতামত নেওয়া হোক। কেননা রাষ্ট্রপতি কোনো দলের নন। তিনি বাংলাদেশের এক নম্বর ব্যক্তি। তিনি জাতির ঐক্যের প্রতীক। তিনি হবেন সবার রাষ্ট্রপতি। শেখ হাসিনা অতীতে অনেক উদারতা দেখিয়েছিলেন। আজ তেমনি একটি সময় এসেছে তাঁর কাছে। তিনি ইতিহাসে আবারও নন্দিত হতে পারেন, যদি একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেন। তিনি দেশের এক 'কঠিন সময়ে' দল ও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়াতে পারবেন, যদি এ কাজটি করেন। তাই ৯০ দিনের এই সময়সীমাটা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সবার দৃষ্টি থাকবে এখন বঙ্গভবনের দিকে। শেষ পর্যন্ত একজন রাজনীতিবিদই আসনটি অলংকৃত করেন কি না, সেটাই হবে আলোচনার মূল বিষয়।
রাজনীতিতে একটা কথা আছে- 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস'। এটি হচ্ছে একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। রাজনীতিতে বিভেদ-দ্বন্দ্ব থাকবেই; কিন্তু তা যেন সংঘাতময় হয়ে না ওঠে। এ জন্যই বিরোধীপক্ষকে বিশ্বাস ও আস্থায় নেওয়াটা জরুরি। আর উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। আমি মনে করি, বিএনপি কর্তৃক প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। উদ্যোগটা এখন নিতে হবে সরকারকেই। সৈয়দ আশরাফ এখন মির্জা ফখরুলের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। ক্ষতি কী, সৈয়দ আশরাফ যদি মির্জা ফখরুলকে ফোন করেন। হুট করে মিডিয়াকে এড়িয়ে তাঁর বাসায় চলে যেতেও পারেন। আগামী এপ্রিল মাসেই বসছে সংসদের ১৭তম অধিবেশন। যদি এপ্রিলে না হয়, তাহলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ৫ মের মধ্যে সংসদ অধিবেশন ডাকতে হবে। এই অধিবেশনেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর রাষ্ট্রপতি যেহেতু ঐক্যের প্রতীক, সেহেতু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাম্য নয়। বিএনপির সেই শক্তিও নেই সংসদে প্রার্থী দেওয়ার। সুতরাং মহাজোটের প্রার্থী একটি ঐকমত্যের প্রার্থী হবেন, আমরা তেমনটি চাই। একটি আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। সরকারের দায়িত্ব এখন এই আস্থার জায়গাটাকে একটি স্থায়ী রূপ দেওয়া। সমগ্র জাতি তাকিয়ে আছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দিকে- সবাই মিলে বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করবেন, যা সুষ্ঠুভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পথ প্রশস্ত করবে।Daily KALERKONTHO25.03.13
0 comments:
Post a Comment