রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

‘অকুপাই মুভমেন্ট’: জুকোটি পার্ক থেকে শাহবাগ

নিউইয়র্ক শহরের জুকোটি পার্ক থেকে ঢাকার শাহবাগের দূরত্ব কত, আমি বলতে পারব না। কিন্তু জুকোটি পার্কে হাজার হাজার তরুণের জমায়েত ও প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল, যা ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, তার সঙ্গে শাহবাগে জমায়েত হওয়া অগণিত, অজস তরুণের প্রতিবাদের ভাষার অদ্ভুত এক ‘মিল’ আমি খুঁজে পাই। যদিও জুকোটি পার্কে যারা সমবেত হয়েছিলেন, তাদের মূল দাবি ছিল একটাই আর তা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমাজে যে অসমতার জন্ম হয়েছে, যেখানে মানুষে মানুষে বৈষম্য বেড়েছে, তার অবসান হওয়া। এই আন্দোলন একটা পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু তা-ই নয়, আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পাড়ের দেশগুলোতেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। পুঁজিবাদী সমাজে মানুষে মানুষে যে কত বড় বৈষম্য তৈরি করতে পারে, আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল এটিই। ২০১১ সালের মাঝামাঝি জন্ম হওয়া এই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ একসময় সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল। সমাজে অসমতা, বৈষম্য, দরিদ্রতা ছিল ‘অকুপাই মুভমেন্টে’র মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এর সঙ্গে ‘শাহবাগ অকুপাই মুভমেন্ট’-এর কোনো মিল নেই সত্য, কিন্তু এক জায়গায় আমি মিল খুঁজে পাই, আর তা হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এ নিজেদের শরিক করে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আজ শাহবাগের তরুণ প্রজন্মও সেই আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করলেন এবং তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জুকোটি পার্কে যে তরুণী গান গেয়ে রাতে তাঁবুতে থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদে নিজেকে শরিক করেছিলেন, তার সঙ্গে আমি শাহবাগের লাকি আখতারের মুখচ্ছবির অদ্ভুত এক মিল খুঁজে পাই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মিল আছে সব জায়গাতেই। সমাজে যখন অনিয়ম হয়, যখন বৈষম্য বাড়ে, তখন তরুণ সমাজই এগিয় আসে প্রথমে। তারাই প্রথম প্রতিবাদী হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজে যেখানে অসমতা তৈরি হয়েছিল, যেখানে ৪৯ দশমিক ১ মিলিয়ন মানুুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, সেখানে প্রথম প্রতিবাদটি এসেছিল তরুণ সমাজের পক্ষ থেকে। আর বাংলাদেশের ১৯৭১ সালে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে লাকি, আলিম, নওরোজ, অনিন্দা, সি ইউ, ফাতেমা, সামিয়া, নুরজাহান, মুক্তা, তানিয়ার মতো হাজার তরুণ। এ প্রজšে§র প্রতিনিধি তারা। যেখানে সনাতন রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ, সেখানে এই ‘অগ্নিকন্যারা’ প্রতিবাদী। ওরা সৃষ্টি করল বাংলাদেশের ‘অকুপাই মুভমেন্টে’র। ‘বাংলা বসন্ত’ শুরু করল এ যুগের বিপ্লবীরা। আমাদের লাকি আর তানিয়ারা দেখিয়ে দিল জুকোটি পার্ক কিংবা কায়রোর তাহরির স্কয়ারের মতো ওরাও সৃষ্টি করতে পারে ইতিহাস। পার্থক্য তো থাকবেই। জুকোটি পার্ক কিংবা ওয়াল স্ট্রিট থেকে তাহরির স্কয়ার দেশ, সমাজ, প্রেক্ষাপট ভিন্ন। জুকোটি পার্ক গর্জে উঠেছিল অসমতা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাহরির স্কয়ার গর্জে উঠেছিল মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য।

১৭ ডিসেম্বর (২০১০) তিউনিশিয়ার ছোট শহর সিডি বওজিদ-এর একজন সাধারণ ফলবিক্রেতা (কিন্তু শিক্ষায় কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট, বেকার) মোহম্মদ বওকুজিজি গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে যে প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, সেই প্রতিবাদ (জেসমিন বিপ্লব) ছড়িয়ে গিয়েছিল আরব বিশ্বের এক দেশ থেকে অন্য দেশে। তিউনিশিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, মিসর সব জায়গাতেই পরিবর্তন এসেছিল। মূল সুরটি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আর এর সঙ্গেই আমি মিল খুঁজে পাই শাহবাগের আন্দোলনের। এখানে তারুণ্য হচ্ছে আশার আলো। তারাই তো পথ দেখায়। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ইউরোপে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার নেতৃত্ব দিয়েছিল তরুণরা। সেই প্রতিবাদ ইউরোপে শান্তিবাদী আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। জুকোটি পার্কের তরুণরা, তাহরির স্কয়ারের তরুণরা কিংবা বাংলাদেশের লাকি, ফাতেমা, সামিয়ারা সেই আন্দোলনেরই উত্তরসূরি। সুরটা এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের যে অসমতা, তা জন্ম দিয়েছে এক ধরনের Class Warfare-এর, অর্থাৎ এক ধরনের শ্রেণীযুদ্ধ। মার্কস ও এঙ্গেলস বিখ্যাত Communist Manifesto গ্রন্থে লিখেছিলেন, a fight that each time ended, either in a revolutionary reconstitution of society at large, or in the common ruin of the contending class। অর্থাৎ দ্বন্দ্বের ফলে সমাজে বিপ্লবী পুনর্গঠন হবে, নতুবা শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটবে। একুশ শতকে এসে মার্কসের এই ব্যাখ্যা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে ভাষা, তাতে মার্কসের বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। যুগ যুগ ধরে এই যে প্রতিবাদ, এই প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন। প্রতিবাদের ভাষা বদলে যায় জুকোটি পার্কে, তাহরির স্কয়ারে আর সর্বশেষ শাহবাগে। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৮১৫) সংগঠিত করেছিল কৃষকরা, রুটির দাবিতে প্যারিসে রুটির দোকান আক্রমণ করেছিল। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই জনতা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে ‘বিপ্লবে’র সূচনা করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে রাশিয়ার বিপ্লবের (১৯১৭) কোনো মিল নেই। ফ্রান্সে বিপ্লবের পর যে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে বিপ্লব-পরবর্তী রাশিয়ার সমাজব্যবস্থার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু মিল আছে এক জায়গায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আজো শাহবাগ ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর সঙ্গে ইতিহাসে সংঘটিত হওয়া বিপ্লবের কোনো মিল নেই সত্য; কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা একটা মিল খুঁজে পাবেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ, সেই প্রতিবাদই ন্যায়সংগত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি বড় ধরনের অপরাধ হয়েছিল। অপরাধীদের রাষ্ট্র শাস্তি দিয়েছে। কিন্তু ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ কি থেমে যাবে? গত ৩ জানুয়ারি নিউইয়র্কের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ তার ৪৭২ দিন অতিক্রম করেছে। এখন আর এ মুভমেন্টের খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। সীমিত পরিসরে এ আন্দোলন এখনো পরিচালিত হচ্ছে। আগামীতে আমরা এ আন্দোলনকে কীভাবে দেখব কিংবা এই আন্দোলন কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। তবে নোয়াম চমস্কির একটা কথা আমি উল্লেখ করতে চাই। তিনি লিখেছিলেন, If they can be sustained and expanded, occupy can lead to dedicate efforts to set society on a more human course। মার্কস যেখানে বিপ্লবের কথা বলেছেন, সেখানে চমস্কি বলেছেন, More Human Course-এর কথা। তাহরির স্কয়ারের আন্দোলন ড. মুরসি তথা ইসলামপন্থিদের সেখানে ক্ষমতায় বসিয়েছিলে। কিন্তু মুরসির ব্যর্থতাও একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় মুরসির অনাগ্রহ তাহরির স্কয়ারের আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে সেই তরুণদের, যারা দীর্ঘ ১৭ দিন তাহরির স্কয়ারে অবস্থান করে একটি ‘বিপ্লবে’র সূচনা করেছিল। সেই বিপ্লব থেকে ড. মুরসি ফায়দা তুলতে পারেনি। চমস্কি যে More Human Course-এর কথা বলেছেন, সে পথে তিনি চালিত করতে পারেননি মিসরকে। মুরসির ব্যর্থতা সেখানেই। শাহবাগের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ আমাদের একটা ধাক্কা দিল। যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যে প্রতিবাদী হতে পারে, ‘শাহবাগ মুভমেন্ট’ এর বড় প্রমাণ। আমাদের রাজনীতিবিদদের এ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

Daily MANOBKONTHO

10.2.13

0 comments:

Post a Comment