রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাশিয়ার সঙ্গে দুটি চুক্তি ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি রাশিয়া সফর করেছেন। বঙ্গবন্ধু দু’দুবার মস্কো সফর করেছিলেন। প্রথমবার ছিল রাষ্ট্রীয় সফর আর দ্বিতীয়বার ছিল ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য। প্রথমবার তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে যান ১৯৭২ সালের ২ মার্চ। এর আগে ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালের মে মাসে। তবে প্রথম সফর বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণার জš§ দিয়েছিল। এরপর দীর্ঘ সময়ে কোন সরকারপ্রধান মস্কো সফর করেননি। এমনকি ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ২১ বছর অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের কোন সরকারপ্রধান মস্কো সফরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। এটা সত্য যে, নব্বই-পরবর্তী রাশিয়ার অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহ জোগায়নি মস্কো সফরে যেতে। এমনকি ব্যবসায়ী নেতারাও রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করার ব্যাপারে উৎসাহিত হননি। বিশ্ব আসরে রাশিয়া একটি শক্তি, সন্দেহ নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্ব আসরে তার গ্রহণযোগ্যতা কম। তুলনামূলক বিচারে চীন সব দিক থেকে এগিয়ে আছে। চীন এখন বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের পরই তার অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে।
এমনই এক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা যখন মস্কো যান, তখন সঙ্গত কারণেই পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এদিকে থাকে। শেখ হাসিনার মস্কো সফরের সময় তিনটি চুক্তি ও ছয়টি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। এক, প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাশিয়া থেকে সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র ক্রয়। দুই, পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রস্তুতিমূলক অর্থায়নে সহযোগিতা। এখানে বাংলাদেশ ৫০ কোটি ডলার ঋণ পাবে। রূপপুরে পারমাণবিক কেন্দ্রের কারিগরি গবেষণার জন্য এই অর্থ। কেন্দ্র নির্মাণে কত টাকা লাগবে, তা এখনও নির্ধারিত হয়নি। এ ব্যাপারে পরে চুক্তি হবে। আপাতত দুই বছরের মধ্যে এই ৫০ কোটি ডলার ব্যয় করা হবে কারিগরি গবেষণায়। এর বাইরে যেসব এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও আট হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ক্রয় বিতর্ক বাড়াবে। মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সরকার যখন এত বিপুল অর্থ ব্যয় করার উদ্যোগ নেয়, তখন বিতর্ক থাকবেই।
প্রথম বিতর্ক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরিতে বিনিয়োগ অনেক বেশি। তুলনামূলক বিচারে যদি রিস্ক ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ সস্তা নয়। এখানে নিরাপত্তা ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞান এখনও সেই নিরাপত্তার পূর্ণ গ্যারান্টি দিতে পারেনি। ১৯৮৬ সালে আজকের ইউক্রেনের চেরনোবিলে পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর ২০১১ সালে জাপানের ফুকুসিমায় যখন পারমাণবিক চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটে তখন বুঝতে হবে, বিজ্ঞান এখনও পারমাণবিক চুল্লির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রযুক্তি খুঁজে পায়নি। বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে, যেখানে নিজস্ব জনশক্তি নেই, সেখানে একটি পারমাণবিক কেন্দ্রের নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে? জাপানের ফুকুসিমায় বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশনের মাত্রা বেড়েছিল ৫-এ। চেরনোবিলের রেডিয়েশনের মাত্রা ছিল ৭। আর যুক্তরাষ্ট্রের থ্রি মাইল আইল্যান্ডে বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশনের মাত্রা ছিল ৫। পরিসংখ্যান বলছে, চেরনোবিল বিস্ফোরণের পর ওই অঞ্চলে ক্যান্সারের প্রকোপ বেড়েছিল ৪০ ভাগ। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী বেলারুশের কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রফতানিতে মারাÍক ধস নেমেছিল। চেরনোবিলের বিস্ফোরণের পর পুরো নিউক্লিয়ার প্লান্ট তো বটেই, ওই গ্রামের একটা বড় অংশ মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু জার্মান সাংবাদিক আন্দ্রেই ক্রেমেনশক ২০১১ সালের মার্চে চেরনোবিলের আশপাশের এলাকা সফর করে তার প্রতিবেদনে লেখেন, মাটিচাপা দেয়ার পরও সেখান থেকে তেজস্ক্রিয়তা বেরুচ্ছে। ২০১১ সালের ১৭ মার্চ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে চার্লস হোমন্স যে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন (এটমিক ডগ্স), তাতে তিনি বুলগেরিয়া, তুরস্ক, আরমেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ঝুঁকির মাত্রা ও অব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তার প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, তুরস্কের একাধিক পারমাণবিক প্লান্ট প্রতিবাদ ও দুর্ঘটনার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাশিয়ার কোম্পানি (যারা বাংলাদেশেও প্লান্ট তৈরি করার দায়িত্ব পেয়েছে) রোসাতম ওইসব প্লান্ট (তুরস্কের আক্কুজুতে) তৈরি করেছিল। বুলগেরিয়ায় কোজলোদুইয়ে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে, তা ১৯৯৫ সালেই যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। আর্মেনিয়ার মেটসামোরে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল, তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের আপত্তির মুখে ও ঝুঁকি এড়াতে ১৯৮৯ সালে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। জাপানের ‘সিক্কা’র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও ১৯৯৯ সালে দুর্ঘটনার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তবে এটিও সত্য, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঝুঁকির মুখে থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে চীনে ২৭টি, রাশিয়ায় ১১টি ও ভারতে ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। একই সঙ্গে পরিকল্পনা আছে চীনে আরও ৩০টি, ভারতে ১৮টি, জাপানে ১২টি, রাশিয়ায় ১৪টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার। তবে জাপান সেই পরিকল্পনা ফুকুসিমার পর স্থগিত করেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কিন্তু খুব বড় অবদান রাখছে না। আন্তর্জাতিক এনার্জি এজেন্সির মতে, পারমাণবিক বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে শতকরা ৬ ভাগ হারে, ২০৩৫ সালে যা বাড়বে ৮ ভাগ হারে। ২০০৮ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল, সেখানে পারমাণবিক বিদ্যুতের অংশ ছিল মাত্র ১৩.৫ ভাগ। সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয়েছে কয়লা থেকেÑ ৪০.৯ ভাগ। তেলে ৫.৫ ও গ্যাসে ২১.৩ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল। সুতরাং শুধু পারমাণবিক বিদ্যুৎই যে সমাধান, তা বলা যাবে না। অস্ট্রেলিয়ায় কোন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। তারা তাদের বিদ্যুতের চাহিদা মেটায় কয়লা থেকে। বাংলাদেশে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হবে। কিন্তু ফুলবাড়ির ঘটনায় আমরা রীতিমতো আতংকিত। কারণ সেখানে আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এলাকাবাসীর দাবি, ফুলবাড়ির কয়লা উত্তোলনের সময় স্থানীয় লোকজনকে তাদের ভিটাবাড়ি ছাড়তে হবে। জাতীয় পর্যায়েও কয়লা তোলা ও এশিয়া এনার্জির ভূমিকা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। জাতীয় পর্যায়েও এটা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। সুতরাং রূপপুরে যখন পুরোপুরি কাজ শুরু হবে, তখন এই পারমাণবিক প্রকল্প নিয়েও আন্দোলন হবে। সেক্ষেত্রে একটা শংকা থেকেই গেল।
দ্বিতীয় চুক্তিটি অস্ত্র ক্রয় সংক্রান্ত। এ চুক্তিটি ইতিমধ্যেই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। রাশিয়ার ঋণের ধরন (যা দিয়ে অস্ত্র কেনা হবে) দেখে বলা যায়, এটি নন-কনসেশনাল। বাংলাদেশে কোন স্বীকৃত প্রতিরক্ষা নীতিমালা নেই, কাজেই কোন্ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এ অস্ত্র কেনা হল তা পরিষ্কার নয়। আমাদের সেনাবাহিনীর অস্ত্রের অন্যতম উৎস চীন। এখন সেই স্বাভাবিক উৎসকে বাদ দিয়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির কোন পরিবর্তনের ইঙ্গিত কি-না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারে। তবে এটা যে পশ্চিমা বিশ্বে ভুল সিগনাল পৌঁছে দেবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চীন বিষয়টি ভালো চোখে দেখবে না। ফলে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তাতে ভাটা পড়তে পারে। ইতিমধ্যে আইএমএফের পক্ষ থেকে নেতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়েছে। আইএমএফ বাংলাদেশকে ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার সুদমুক্ত ঋণ দেবে। এর প্রথম কিস্তি ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার আমরা পেয়ে গেছি। এখন দ্বিতীয় কিস্তি আটকে যেতে পারে। তবে আমাদের জন্য যা দুর্ভাগ্যের তা হচ্ছে, রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার আগে বিষয়টি আমরা জানলাম না। একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল একটি দৈনিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অস্ত্র কেনা হয়েছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় (আমার দেশ, ২০ জানুয়ারি)। অভিযোগ উঠেছে, রাশিয়ার অস্ত্র ক্রয়ে একটি ‘তৃতীয় পক্ষে’র উপস্থিতি রয়েছে। এই চুক্তি নিয়ে যে অস্পষ্টতা তা হচ্ছে, এর সঙ্গে কোন শর্ত যুক্ত কিনা। যদিও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোন শর্ত যুক্ত নেই। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অস্ত্র কেনায় সুদ দিতে হবে সাড়ে ৪ শতাংশ। এই ঋণ ব্যবহার করতে হবে ২০১৩-১৭ সালের মধ্যে। আর ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০ কিস্তিতে ১০ বছর ধরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, অস্ত্র ক্রয়ে কোন অস্বচ্ছতা নেই। বলা হয়েছে, এই অস্ত্র সেনাবাহিনী শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহার করবে। এই পরিসংখ্যান নিয়েও কথা বলা যায়। বিশেষ করে সুদের হার বেশি বলেই মনে হয়। তবে আমার কাছে যা মনে হয় তা হচ্ছে, এই চুক্তি আমাদের বৈদেশিক ও সামরিক নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত বহন করে। কারণ আমাদের বৈদেশিক নীতি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চীনের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের বিমানবাহিনী চীনা বিমান ব্যবহার করে। সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও চীনের তৈরি। আমাদের সামরিক নেতৃত্ব চীনা যুদ্ধাস্ত্রের ওপর অনেক দিন থেকেই নির্ভরশীল। আমাদের উন্নয়নে চীন অন্যতম অংশীদার। চীন আমাদের নিকট প্রতিবেশীও। আমাদের উন্নয়নে চীনের উপস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই সরকারপ্রধান চীনে গিয়েছিলেন। এমনকি বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও সম্প্রতি চীনে গিয়েছিলেন এবং তারা দু’জনই লালগালিচা সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। চীন সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই মহাসড়ক ও গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের চেহারা আগামী দশকে বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশ হতে পারে এ অঞ্চলের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। চীন শ্রীলংকার হামবানটোটায় (প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জš§স্থান) গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে একটি বিমানবন্দরও চীন তৈরি করে দিয়েছে। সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন আগ্রহও দেখিয়েছিল। এটা নির্মিত হলে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলো যেমন এটি ব্যবহার করতে পারবে, তেমনি পারবে চীন ও মিয়ানমারও। এখন সঙ্গত কারণেই রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক চুক্তি চীন খুব সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। চীনারা এসব ক্ষেত্রে খুবই রক্ষণশীল। তারা খুব দ্রুতই প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বোধকরি এ ব্যাপারে কোন সরকারি মন্তব্যও আমরা পাব না। তবে যা হবে তা হচ্ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনা আগ্রহের ঘাটতি আমরা দেখতে পাব। আগামী মার্চে চীনে নয়া নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করছেন। শি জিন পিং ইতিমধ্যে পার্টিপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং মার্চে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও নেবেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং বেগম খালেদা জিয়া যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এখন এই অস্ত্র ক্রয় চুক্তিতে চীনে বাংলাদেশ ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে।
এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজনÑ বাংলাদেশের এই মুহূর্তে অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন হল কেন? বাংলাদেশের নিরাপত্তা এ মুহূর্তে কোন ঝুঁকির মুখেও নেই। এত বিপুল অস্ত্রের আদৌ প্রয়োজন ছিল না। অস্ত্রশস্ত্রের চেয়ে এ মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। অস্ত্র খাতে নয়, বরং অন্য খাতে আমরা ঋণ নিতে পারতাম। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর চার ভাগের এক ভাগ এখনও গরিব। ‘আইলা’ ও ‘সিডর’ আক্রান্ত এলাকায় মানুষ এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছে। সুপেয় পানির বড় অভাব সেখানে। ২০১৫ সালের মধ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস (এমডিজি) বাস্তবায়ন এখন ঝুঁকির মুখে। সরকার এখন রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে হাজার হাজার কোটি টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ করবে! এই আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর কোন উপকার হবে বলে মনে হয় না। সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের কারণে জাতিসংঘ থেকেই আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পায়। সেই অস্ত্রশস্ত্র তারা দেশেও নিয়ে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে এত বিপুল অংকের টাকা দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র কেনার প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশের এই মুহূর্তে কোন শত্র“ রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কম। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত রয়েছে। এই দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ আদৌ কোন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বেÑ এটি শুধু বোকারাই চিন্তা করতে পারে। দিন বদলে গেছে। মানুষ সচেতন হয়েছে। সব তথ্যই আজকাল পাওয়া যায়। সুতরাং সাধারণ মানুষের দিকে নজর না দিয়ে আট হাজার কোটি টাকার সমরাস্ত্র ক্রয় বিতর্ক বাড়াবে। এর সঙ্গে রয়েছে তৃতীয় কোন পক্ষের জড়িত থাকার বিষয়টি। আমরা এখনও নিশ্চিত নই। তবে মিগ বিমান ক্রয়ে একটি তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি আমরা দেখেছিলাম।
আমরা নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে চাই। সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। কিন্তু এভাবে নয়। যে সমরাস্ত্রের সঙ্গে আমাদের সেনাবাহিনীর পরিচয় নেই, সেই সমরাস্ত্র এনে আমাদের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা যাবে না। সমরাস্ত্র ক্রয়ের নাম করে আমাদের রাশিয়ার ওপর নির্ভর করে তোলা আমাদের প্রতিরক্ষা নীতির জন্য ভালো কোন খবর নয়। সরকার শেষ সময়ে এসে এই চুক্তিটি না করলেও পারত। আমরা চাই, সরকার সামাজিক সমস্যাগুলোর দিকে নজর দিক। দারিদ্র্য দূরীকরণের উদ্যোগ নিক। জনগণের সরকার জনগণের জন্য কাজ করবে, এটাই প্রত্যাশিত।
Daily JUGANTOR
30.01.13

0 comments:

Post a Comment