রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যে ছবি কথা বলে


সংবাদপত্রে প্রতিদিন অসংখ্য ছবি ছাপা হয়। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই ছবি কথা বলে। কিন্তু গেল সপ্তাহে সংবাদপত্রগুলোতে এমন কয়েকটি ছবি ছাপা হয়েছে, যা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে দেশটি ঠিকমত চলছে না, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। ১৯ ডিসেম্বরের একটি ছবি। ছবির ক্যাপসনে লেখা হয়েছে ছাত্রীসংস্থার আটক সদস্যদের সিএমএম কোর্টে হাজির করে রিমান্ডে নেয়া হয়। এর আগের দিন তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল মগবাজার থেকে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের মাঝে একজন অন্তঃসত্ত্বাও রয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে আমরা এই দেশে বসবাস করছি। একজন অন্তঃসত্ত্বাকে গ্রেফতার করা হল? বাকিদের দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে বিজ্ঞ আদালত! কী তাদের অপরাধ? শুধুমাত্র ছাত্রী সংস্থার সদস্য কিংবা হিজাব পরিহিতা এটাই কী তাদের অপরাধ? আমি একটা ধন্দে পড়ে যাই। ছাত্রী সংস্থা তো নিষিদ্ধ কোনো সংস্থা নয়? তাদের কেউ তো ‘চাপাতি শাকিল’ এর মতো প্রকাশ্যে সাধারণ কোনো মানুষকে হত্যা করেনি! এমনকি তাদের কারো নামে মামলা রয়েছে, এমনটিও নয়। তারপরও তাদের গ্রেফতার করা হলো এবং তাদের রিমান্ডে নেয়া হল। যেহেতু বলা হচ্ছে ছাত্রীসংস্থা, সেহেতু ধরে নিচ্ছি তারা ছাত্রী। ছাত্রীরা একটা সংগঠন করতেই পারে। এ দেশে ছাত্রলীগ রয়েছে, ছাত্রদল রয়েছে, ছাত্র সমাজ রয়েছে, কমিউনিস্ট পাটির রয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন। কই কোনো একটি সংগঠনকে তো নিষিদ্ধ করা হয়নি। ছাত্রলীগ সারা দেশে খুন-খারাবি, টেন্ডারবাজি ও হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠলেও সরকার সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা তো দূরের কথা, সংগঠনটির  কর্মকাণ্ডও সাময়িকভাবে স্থগিতও করেনি। তাহলে ছাত্রীসংস্থার ওপর এই আক্রোশ কেন? সরকার যেখানে গণতন্ত্রের কথা বলে, যেখানে এ দেশের সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে সংগঠন করার অধিকার দিয়েছে, সেখানে কোন যুক্তিতে ওই ২০ জন ছাত্রীকে গ্রেফতার করলো পুলিশ? আমাদের দেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বেশ কিছু ধারা রয়েছে যা, আমাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করেছে। বিশেষ করে ২৭ নং অনুচ্ছেদ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), অনুচ্ছেদ ৩২ (জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার), অনুচ্ছেদ ৩৬, ৩৭, ৩৮ (চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা) ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়। আমরা সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১১ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করতে পারি যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন কোথায় থাকলো এ ধারাগুলো? বাংলাদেশে এতগুলো মানবাধিকার সংগঠন। একজন এডভোকেট মনজিল মোরশেদ মিডিয়ায় স্থান পাবার জন্য মানবাধিকারের কথা বলে প্রায়ই হাইকোর্টে রিট করেন। কোথায় গেলেন মনজিল সাহেব? মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজান সংবাদের শিরোনাম হতে ভালোবাসেন। তার চোখ কী করে এড়িয়ে গেল এই ২০ জন ছাত্রীর গ্রেফতারের ঘটনা? ভাবতে অবাক লাগে পুলিশ এই মেয়েদের চুল ধরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। তাদের নেকাব খুলতে বাধ্য করেছিল। ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা একজন ছাত্রীকে ৮ তলায় উঠতে বাধ্য করেছিল। শুধুমাত্র ছাত্রীসংস্থা করেনÑ এটাই কী তাদের অপরাধ? তাহলে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হোক। সংবিধান তো তাদের অধিকার দিয়েছে (অনুচ্ছেদ ৩৮) সংগঠন করার। তারা তো সংবিধানের বাইরে কিছু করেননি। তাদের রাজনীতি নিয়ে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তারা তো ছাত্রলীগের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন না। নিরীহ, সাধারণ এই মেয়েদের রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় আমি দুঃখিত ও মর্মাহত। এই সভ্য দেশে এটা কখনোই কাম্য নয়। ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারী জামিন পাবার অধিকার রাখেন। তাঁকে তার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হলো। ক’দিন আগেও রোকেয়া দিবসে প্রধানমন্ত্রী নারী অধিকারের কথা বললেন। এখন একটি মেয়ে যখন কোনো রকম অন্যায় ও অপরাধ না করে জেলে যান, সর্বোপরি তিনি যদি ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হন, তাতে করে কী তার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না? প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব পেপার কাটিংই যায়। এই ছাত্রীদের গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার কাটিংও নিশ্চয়ই তার কাছে গেছে। এখন কী বলবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
সিপিবি-বাসদের হরতালের সময় পুলিশের ভূমিকার একটি ছবিও গেল সপ্তাহে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এটা ছিল বাহ্যত সরকার সমর্থিত একটি হরতাল। যেখানে অন্য সময় পুলিশ হয়ে ওঠে বেপরোয়া, এবার দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। একটি ছবিতে দেখা গেল পিকেটাররা বাধ্য করছে এক রিকশা চালককে ফিরে যেতে। পাশে দাঁড়ান একদল পুলিশ নির্বিকার। ভাবখানা এমনই যে রিকশাওয়ালা রিকশা বের করলো কেন? আজ তো হরতাল। এই ছবি কী আমাদের বোঝার জন্য যথেষ্ট নয় যে, সরকারই ওই দিন হরতাল করেছে!  আসলে ছবি কথা বলে। ছবিই বলে দেয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কী নির্দেশ ছিল পুলিশের প্রতি! বিশ্বজিৎ এর হত্যার দৃশ্য ধারণ করে ফটো সাংবাদিকরা আমাদের দেখিয়ে দিলেন সরকার আসলে ওইদিন কী চেয়েছিল। বিশ্বজিৎ এর হত্যাকাণ্ডকে নানাভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। বিশ্বজিৎ একজন শিবির কর্মী, একজন অনুপ্রবেশকারীÑ এ ধরনের বক্তব্য এসেছে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। হত্যাকারীরা আদৌ ছাত্রলীগ কর্মী নন, এ ধরনের দাবি ছাত্রলীগের নেতাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হলেও ছবিই প্রমাণ করে দিয়েছে পরিকল্পিতভাবেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। হত্যাকারীরা চেয়েছিল একটি ভয়ের আবহ তৈরি করতে।
বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড, কুপিয়ে প্রকাশ্যে একজন মানুষকে হত্যা করার ঘটনায় সরকারের কোনো উদ্বিগ্নতা প্রকাশ না পেলেও, উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি হত্যাকাণ্ডের এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তার মন্তব্য প্রমাণ করে বিদেশীদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ইতোমধ্যে নিশ্চিন্তপুরের ১১১ জন শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এখন এর সাথে যোগ হলো প্রকাশ্যে মানুষ মারার ঘটনা। এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের বড় বাজার, সেই বাজার এখন হারাতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ১ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ডলারের বাজার যুক্তরাষ্ট্রে। স্পষ্টতই পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে বাংলাদেশ এই বাজার হারাবে। ইতোমধ্যে ওয়ালমার্ট বাংলাদেশ থেকে তার তৈরি পোশাক ক্রয় বাতিল করেছে। কেননা নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন গার্মেন্টস ওয়ালমার্টকে বিশেষ ধরনের পোশাক সরবরাহ করতো। এটা বন্ধ হয়ে গেল। এটা অন্যদের ক্ষেত্রেও একটা প্রচ্ছন্ন ‘হুমকি’। নিশ্চিন্তপুরের ‘হত্যাকাণ্ডের’ সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম, কিংবা ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইটস ফোরামের মতো সংগঠন তৎপর হয়েছে। এমনকি স্টেট ডিপার্টমেন্টও একটি মন্তব্য করেছে। তারা স্পষ্ট করেই বলেছে পোশাক শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধপরিকর।  এ ধরনের মন্তব্য আমাদের জন্য একটি ‘ম্যাসেজ’। পোশাক শিল্প স্পষ্টতই একটি ঝুঁকির মুখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। এবং শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে যেসব মানবাধিকার সংস্থা কাজ করে, তারা ওয়াশিংটনে এক ধরনের ‘লবিস্ট’ হিসেবে কাজ করে। কংগ্রেসম্যানদের তারা বাধ্য করে আইন প্রণয়ন করতে। এমনকি বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তৈরি পোশাক শিল্পে জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা চেয়ে আসছে। বাংলাদেশ এই সেক্টরে এই সুবিধা পায় না। কিছু কিছু সেক্টর, যেমন- সিরামিক, সার, ফার্নিচার ইত্যাদি শিল্পে জিএসপি সুবিধা পায়। তৈরি পোশাকে পায় না। শতকরা ১৫ ভাগ শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে প্রবেশ করছে। গুণগত মান ও সস্তা থাকায় বাংলাদেশী এই পণ্যের বড় বাজার রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এখন এই জিএসপি সুবিধাও প্রশ্নের মুখে থাকলো। আমি আশঙ্কা করছি মার্কিন শ্রমিক সংগঠন তথা শ্রমিক স্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘বাবো’ কংগ্রেসে একটি আইন প্রণীত হতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা হতে পারে। এটা হলে বাংলাদেশের জন্য তা হবে এক ধরনের ‘আত্মহত্যার সামিল’। কেননা আমাদের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্প একটা বড় অবদান রাখছে। ইউরোপের অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করায় সেখানে বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে না। এমনকি সেখান থেকে ‘অর্ডার’ও কমে আসছে। ফলে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা যদি হ্রাস পায়, তা আমাদের অর্থনীতির জন্য হবে হুমকি। এমনকি ‘কমপ্লাইয়েন্স’ এর যে সুযোগ-সুবিধা মার্কিন ক্রেতারা দাবি করছে, তা নিশ্চিন্তপুরের ঘটনার পর আরো শক্তিশালী হবে। ‘কমপ্লাইয়েন্স’ এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার উপর জোর দেবে। শুধু তাই নয় একই সাথে তারা চাইবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি। প্রকাশ্যে মানুষ খুন করা হবে, আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবেন, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় জেলে পাঠানো হবেÑ এসব ঘটনা সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। এসব ঘটনায় বাংলাদেশ এক ধরনের ‘ইমেজ’ সঙ্কটের মুখে থাকবে। তাই আমরা বলেছিলাম ছবি কথা বলে। ড. মিজানের মতো তথাকথিত ‘সরকারি মানবাধিকার কর্মীরা’ অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের গ্রেফতারে ‘কথা’ না বললেও ছবি কথা বলেছে। ছবিগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এটা বুঝতে আমাদের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর রিপোর্টের দিকে তাঁকানোর প্রয়োজন নেই। এই ছবিগুলোই তা বোঝার জন্য যথেষ্ট।
28.12.12

0 comments:

Post a Comment