সিপিবি-বাসদের হরতালের সময় পুলিশের ভূমিকার একটি ছবিও গেল সপ্তাহে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এটা ছিল বাহ্যত সরকার সমর্থিত একটি হরতাল। যেখানে অন্য সময় পুলিশ হয়ে ওঠে বেপরোয়া, এবার দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। একটি ছবিতে দেখা গেল পিকেটাররা বাধ্য করছে এক রিকশা চালককে ফিরে যেতে। পাশে দাঁড়ান একদল পুলিশ নির্বিকার। ভাবখানা এমনই যে রিকশাওয়ালা রিকশা বের করলো কেন? আজ তো হরতাল। এই ছবি কী আমাদের বোঝার জন্য যথেষ্ট নয় যে, সরকারই ওই দিন হরতাল করেছে! আসলে ছবি কথা বলে। ছবিই বলে দেয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কী নির্দেশ ছিল পুলিশের প্রতি! বিশ্বজিৎ এর হত্যার দৃশ্য ধারণ করে ফটো সাংবাদিকরা আমাদের দেখিয়ে দিলেন সরকার আসলে ওইদিন কী চেয়েছিল। বিশ্বজিৎ এর হত্যাকাণ্ডকে নানাভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। বিশ্বজিৎ একজন শিবির কর্মী, একজন অনুপ্রবেশকারীÑ এ ধরনের বক্তব্য এসেছে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। হত্যাকারীরা আদৌ ছাত্রলীগ কর্মী নন, এ ধরনের দাবি ছাত্রলীগের নেতাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হলেও ছবিই প্রমাণ করে দিয়েছে পরিকল্পিতভাবেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। হত্যাকারীরা চেয়েছিল একটি ভয়ের আবহ তৈরি করতে।
বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড, কুপিয়ে প্রকাশ্যে একজন মানুষকে হত্যা করার ঘটনায় সরকারের কোনো উদ্বিগ্নতা প্রকাশ না পেলেও, উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি হত্যাকাণ্ডের এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তার মন্তব্য প্রমাণ করে বিদেশীদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ইতোমধ্যে নিশ্চিন্তপুরের ১১১ জন শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এখন এর সাথে যোগ হলো প্রকাশ্যে মানুষ মারার ঘটনা। এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের বড় বাজার, সেই বাজার এখন হারাতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ১ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ডলারের বাজার যুক্তরাষ্ট্রে। স্পষ্টতই পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে বাংলাদেশ এই বাজার হারাবে। ইতোমধ্যে ওয়ালমার্ট বাংলাদেশ থেকে তার তৈরি পোশাক ক্রয় বাতিল করেছে। কেননা নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন গার্মেন্টস ওয়ালমার্টকে বিশেষ ধরনের পোশাক সরবরাহ করতো। এটা বন্ধ হয়ে গেল। এটা অন্যদের ক্ষেত্রেও একটা প্রচ্ছন্ন ‘হুমকি’। নিশ্চিন্তপুরের ‘হত্যাকাণ্ডের’ সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম, কিংবা ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইটস ফোরামের মতো সংগঠন তৎপর হয়েছে। এমনকি স্টেট ডিপার্টমেন্টও একটি মন্তব্য করেছে। তারা স্পষ্ট করেই বলেছে পোশাক শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধপরিকর। এ ধরনের মন্তব্য আমাদের জন্য একটি ‘ম্যাসেজ’। পোশাক শিল্প স্পষ্টতই একটি ঝুঁকির মুখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। এবং শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে যেসব মানবাধিকার সংস্থা কাজ করে, তারা ওয়াশিংটনে এক ধরনের ‘লবিস্ট’ হিসেবে কাজ করে। কংগ্রেসম্যানদের তারা বাধ্য করে আইন প্রণয়ন করতে। এমনকি বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তৈরি পোশাক শিল্পে জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা চেয়ে আসছে। বাংলাদেশ এই সেক্টরে এই সুবিধা পায় না। কিছু কিছু সেক্টর, যেমন- সিরামিক, সার, ফার্নিচার ইত্যাদি শিল্পে জিএসপি সুবিধা পায়। তৈরি পোশাকে পায় না। শতকরা ১৫ ভাগ শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে প্রবেশ করছে। গুণগত মান ও সস্তা থাকায় বাংলাদেশী এই পণ্যের বড় বাজার রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এখন এই জিএসপি সুবিধাও প্রশ্নের মুখে থাকলো। আমি আশঙ্কা করছি মার্কিন শ্রমিক সংগঠন তথা শ্রমিক স্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘বাবো’ কংগ্রেসে একটি আইন প্রণীত হতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা হতে পারে। এটা হলে বাংলাদেশের জন্য তা হবে এক ধরনের ‘আত্মহত্যার সামিল’। কেননা আমাদের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্প একটা বড় অবদান রাখছে। ইউরোপের অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করায় সেখানে বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে না। এমনকি সেখান থেকে ‘অর্ডার’ও কমে আসছে। ফলে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা যদি হ্রাস পায়, তা আমাদের অর্থনীতির জন্য হবে হুমকি। এমনকি ‘কমপ্লাইয়েন্স’ এর যে সুযোগ-সুবিধা মার্কিন ক্রেতারা দাবি করছে, তা নিশ্চিন্তপুরের ঘটনার পর আরো শক্তিশালী হবে। ‘কমপ্লাইয়েন্স’ এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার উপর জোর দেবে। শুধু তাই নয় একই সাথে তারা চাইবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি। প্রকাশ্যে মানুষ খুন করা হবে, আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবেন, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় জেলে পাঠানো হবেÑ এসব ঘটনা সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। এসব ঘটনায় বাংলাদেশ এক ধরনের ‘ইমেজ’ সঙ্কটের মুখে থাকবে। তাই আমরা বলেছিলাম ছবি কথা বলে। ড. মিজানের মতো তথাকথিত ‘সরকারি মানবাধিকার কর্মীরা’ অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের গ্রেফতারে ‘কথা’ না বললেও ছবি কথা বলেছে। ছবিগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এটা বুঝতে আমাদের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর রিপোর্টের দিকে তাঁকানোর প্রয়োজন নেই। এই ছবিগুলোই তা বোঝার জন্য যথেষ্ট।
28.12.12
0 comments:
Post a Comment