আগামী ২০ জানুয়ারি বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো প্রসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। কিন্তু তাতে করে অর্থনীতিকে তিনি কতটুকু সচল করতে পারবেন, সে প্রশ্ন ইতোমধ্যেই উঠেছে। যদিও বছরের শুরুতে তিনি তথাকথিত 'ফিসকাল ক্লিফ' অর্থাৎ অর্থনীতিকে 'খাদে পড়ার' হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, বিশাল বেকারত্ব, রেকর্ড অতিক্রম করা ঋণ (১৬ ট্রিলিয়ন ডলার), সরকারের অগ্রাধিকার চর্চায় অচলপ্রায় ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাত, সেই সাথে বৈদেশিক নীতিতে ওবামা কি আদৌ কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারবেন? সামনের দিনগুলো ওবামার জন্য সে সুযোগ হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এটা সত্য গেল অক্টোবর মাসে ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ চাকরি পেয়েছেন। যেখানে জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রতি চারজন একটি চাকরির পেছনে দৌড়াবেন, সেখানে নতুন করে ব্যয় ২ লাখ লোকের চাকরি পাওয়া কম কথা নয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণী এ থেকে উপকৃত হয়েছেন। বারাক ওবামার ট্রার্গেটই ছিল এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। আর্থিক খাতকে এমন একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। ২০০৯ সালে বারাক ওবামা বিখ্যাত কায়রো ভাষণে মুসলিম বিশ্বের সাথে নতুন এক সম্পর্ক গড়ার প্রত্যয় ব্যক্তি করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ উৎখাত করতে গিয়ে জঙ্গিবাদেরই জন্ম হয়েছে সেখানে। লিবিয়া থেকে সিরিয়া সব জায়গাতেই আত্মঘাতী বোমাবাজির জন্ম হয়েছে। ওবামার 'আরব বসন্ত' নীতির এটা একটা বড় ব্যর্থতা। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের কিংবা লিবিয়ায় গাদ্দাফির উৎখাতের পর সেখানে ইসলামী কট্টরপন্থীরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়াতে আসাদকে উৎখাত করতে গিয়ে দেখা গেল অস্ত্র চলে গেছে জঙ্গিদের হাতে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। 'আরব বসন্ত' তিউনেসিয়া, ইয়েমেন, মিসরে পরিবর্তন ডেকে আনলেও সেখানে কী ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সমস্যার তিনি কোনো সমাধান প্রথম টার্মে বের করতে পারেননি। চীনের সঙ্গে দক্ষিণ চীন সফর নিয়ে পার্শ্ববর্তী ফিলিপাইন ও জাপানের সঙ্গে যে বিরোধ, তা ওবামা প্রশাসন উসকে দিয়েছিল। নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে মার্কিন জনমত সোচ্চার ছিল, তার ৪ বছরের টার্মে তিনি এ ব্যাপারে কতটুকু কী করেন, সে ব্যাপারে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। এগুলো হচ্ছে : ১. মৃত্যুদ- রদ করা, ২. ৫১১৩টি পারমাণবিক ওয়ারহেডের ভবিষ্যৎ, ৩. গুয়ানতানামো বে বন্দি শিবির বন্ধ করে দেয়া, ৪. রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ধসের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার, ৫. পাকিস্তান, ইয়েমেন, সোমালিয়ায় ড্রোন বিমান হামলা বন্ধ, ৬. প্রতি ঘণ্টায় নূ্যনতম বেতন ১০ ডলার (বর্তমানে ৭.২৫ ডলার), ৭. ইরানে বিমান হামলা, ৮. নির্বাচনে চাঁদাবাজি বন্ধ, ৯. জলবায়ু পরিবর্তন রোধে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ, ১০. সবার জন্য চাকরির নিশ্চয়তা, ১১. পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুলি্লর ভবিষ্যৎ, ১২. লাদেনকে ধরে এনে কেন বিচার করা হলো না, তার ব্যাখ্যা ইত্যাদি। ওবামার আগামী চার বছর এ প্রশ্নগুলো বারবার উঠবে। তবে সব ছাপিয়ে অর্থনীতিকে বাগে আনা তার জন্য হবে বড় চ্যালেঞ্জ। সবাই স্বীকার করেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি আর আগের মতো নেই। গাড়ি শিল্পে প্রণোদনা দিয়ে তিনি এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু অন্যদিকে শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট বেকারদের সংখ্যা বাড়ছে। এটা হবে তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিকে বাগে আনতে না পারলে তিনি তার বিশাল জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারবেন না। তার জন্য কাজটি খুব সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ধনী ও গরিব শ্রেণীর মাঝে বৈষম্য বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে অসমতা, দারিদ্র্য, আর বৈষম্য সেখানে আকুপাই মুভমেন্টের জন্ম দিয়েছে, যা ইতোমধ্যে প্রায় ৪২০ দিন অতিক্রম করেছে। এই বৈষম্য কমিয়ে আনার এক কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে ওবামাকে। কাজটি সহজ নয়। পরিসংখ্যান বলে শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছেন জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ মানুষ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১২ সালে এসে তারা ভোগ করেন মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ গ্রহণ করে। শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। জোসেফ স্ট্রিগলিৎজের মতে শীর্ষে থাকা ওই ১ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। এই ধনীরা এক রাতে জুয়া খেলায় হেরে যান লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে ঈধংরহড় ঈধঢ়রঃধষরংস। অর্থাৎ জুয়া নির্ভর এক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের অপর পিঠে রয়েছে অন্ধকার এক চিত্র। ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন, অর্থাৎ ১ কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। ২০১০ সালে করপোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। এ ধরনের পরিসংখ্যান আরো দেয়া যায়। এসব পরিসংখ্যান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ঠিকমত চলছে না। বৈষম্য দিনে দিনে বাড়ছে। গরিব আরো গরিব হচ্ছে। যে সমাজে শতকরা ৪৭ দশমিক ৮ ভাগ মানুষ 'ফুড স্ট্যাম্প'র (খাদ্য সাহায্য) ওপর নির্ভরশীল, সেই সমাজেই একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে গেল, যেখানে মূল দু'জন প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয় করেছেন ৬০০ কোটি (কারো কারো মতে ১০০০ কোটি) ডলার। ওবামা বা রমনি আবার নিজের অর্জিত আয় থেকে এই অর্থ ব্যয় করেননি। তারা প্রকাশ্যেই চাঁদা তোলেন। বড় বড় ব্যবসায়ী তথা করপোরেট হাউসগুলো তাদের চাঁদা দেয়। এটা বৈধ। ওই চাঁদার টাকায় তারা নির্বাচন করেন। নির্বাচনে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে পারেন না বিধায়, তৃতীয় কোনো শক্তিশালী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে পারেন না। এবারও প্রায় ২৫ জন তথাকথিত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। কিন্তু মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউই থাকতে পারেননি। এদের নামও কেউ জানে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে একটা সমতা ফিরিয়ে আনা, সবার জন্য চাকরি ও স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না বারাক ওবামার জন্য। মানুষ ওবামার ওপর আস্থা রেখেছে এটা সত্য, কিন্তু সেই আস্থার প্রতি কতটুকু সম্মান তিনি দেখাতে পারবেন, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। ওবামার বিজয় অবশ্য একটি বিষয়কে নিশ্চিত করেছে_ আর সেটি হচ্ছে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে বিমান হামলার সম্ভাবনা সীমিত হওয়া। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যে সঙ্কট ওবামা তার সমাধানের জন্য আলাপ-আলোচনার ওপরই গুরুত্ব দেবেন। রমনি বিজয়ী হলে হামলার সম্ভাবনা বাড়ত। তবে ওবামার জন্য মধ্যপ্রাচ্য হবে একটি 'টেস্ট কেস'। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন_ কোনো দেশ থেকেই সুবাতাস আসছে না। 'আরব বসন্ত' সেখানে সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু জন্ম দিয়েছে নতুন এক সঙ্কটের_ জঙ্গিবাদের উত্থান। আত্মঘাতী বোমাবাজির সংস্কৃতির সেখানে জন্ম হয়েছে। ওবামার বৈদেশিক নীতির এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সব মিলিয়ে পুরনো প্রেসিডেন্টকে নতুনভাবে পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি শপথ নেবেন। কিন্তু অর্থনীতির মন্দাভাব তিনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন কিনা, বৈদেশিক নীতিতে 'সফলতা' পাবেন কিনা, বিশ্বে স্থিতিশীলতা তিনি উপহার দিতে পারবেন কিনা, সে প্রশ্ন থেকেই গেল।
Daily JAI JAI DIN
08.01.13
Daily JAI JAI DIN
08.01.13
0 comments:
Post a Comment