প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মস্কো সফরের সময় বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে
পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রস্তুতিমূলক অর্থায়নে সহযোগিতা শীর্ষক এক
চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ৫০ কোটি
ডলার ঋণ পাবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারিগরি গবেষণার জন্য এ অর্থ
ব্যয় হবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এটা প্রাথমিক স্টেজ। গেল
বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটম
নিউক্লিয়ার এনার্জির সঙ্গে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এর রেশ ধরেই বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফরের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো। এখানে বলা
প্রয়োজন, তত্কালীন পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। এখন সেখানেই
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২০ সাল
নাগাদ বাংলাদেশ পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে। প্রস্তাবিত রূপপুর
পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার,
যা প্রায় ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমান। তবে এ খরচ এখন আরো বাড়বে। বাংলাদেশ
যে চুক্তিটি করল এবং চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার কাছ থেকে যে আর্থিক সহযোগিতা
পাওয়া যাবে, ওই অর্থ ব্যয় হবে কারিগরি গবেষণার জন্য। গবেষণায় নির্ধারিত
হবে— কত খরচ হবে। দুই বছরের মধ্যে ওই গবেষণার কাজ শেষ হবে। রূপপুরে দুটি
ইউনিট হবে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, পাঁচ স্তরবিশিষ্ট একটি নিরাপত্তা বলয় থাকবে
এবং তৃতীয় জেনারেশনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখানে বসানো হবে।
জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ বিপর্যয়ের (২০১১) রেশ
ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশ যখন রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুরে পারমাণবিক চুল্লি
তৈরির সমঝোতায় যায়, তখন সঙ্গত কারণেই এ নিয়ে বিতর্ক বাড়বে। জাপান
প্রযুক্তিবিদ্যায় শীর্ষে অবস্থান করলেও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। বলা হচ্ছে, আশির দশকের (১৯৮৬) মাঝামাঝিতে
রাশিয়ার চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে ঘটনা ঘটেছিল, তার চেয়েও
ভয়াবহ ছিল ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপর্যয়। চেরনোবিল
বিপর্যয়ের পর তেজস্ক্রিয়তা ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। গরুর দুধ, গুঁড়ো
দুধ, শাকসবজি, ফলমূল সব কিছুতেই তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ প্রায় ২৬
বছর পরও চেরনোবিল ও তার আশপাশের এলাকা বিপদমুক্ত নয়। ইউরোপের বেশকিছু দেশ
থেকে কৃষিপণ্য রফতানি বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল। এখন বাংলাদেশ পারমাণবিক
বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাবে। কিন্তু এর নিরাপত্তা আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব, সে
প্রশ্ন থেকেই গেল।
পরমাণু প্রকল্প খুব ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণও। দক্ষিণ এশিয়ায় পরমাণু শক্তির
ব্যবহার খুবই কম। ভারতে মোট জ্বালানির মাত্র ২ শতাংশ ও পাকিস্তানের ১ শতাংশ
আসে পরমাণু থেকে। যদিও এ দুটি দেশ পরমাণু শক্তি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ
নিয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত
হয়েছে, যা খোদ ভারতেও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। গেল বছর পাকিস্তান চীনের
সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যেখানে চীন পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে দেবে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয়
দেশ, যেটি পরমাণু শক্তির উৎপাদনে যাচ্ছে। সাধারণত ৬০০ থেকে ১ হাজার
মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ৫০০ মেগাওয়াটের ওপরে
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে উৎপাদন খরচ কম হয়। কিন্তু এ ধরনের কেন্দ্র
স্থাপনে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয়। প্রচলিত
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে প্রতি মেগাওয়াটের জন্য গড়ে খরচ হয় ১ মিলিয়ন মার্কিন
ডলার। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে
নির্মাণে খরচ হয়েছে দেড় থেকে ২ মিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে ১ হাজার মেগাওয়াট
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে খরচ হবে দেড় মিলিয়ন বা ১৫০ কোটি টাকা। জাপানে
পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় প্রতি ইউনিটে ৪ ডলার ৮০ সেন্ট, কয়লায় ৪
ডলার ৯৫ সেন্ট ও গ্যাসে ৫ ডলার ২১ সেন্ট। দক্ষিণ কোরিয়ায় খরচ হয়
পারবমানবিকে ২ ডলার ৩৪ সেন্ট, কয়লায় ২ ডলার ১৬ সেন্ট আর গ্যাসে ৪ ডলার ৬৫
সেন্ট। ফ্রান্সে পারমাণবিকে ২ ডলার ৫৪ সেন্ট, কয়লায় ৩ ডলার ৩৩ সেন্ট ও
গ্যাসে ৩ ডলার ৯২ সেন্ট খরচ হয়।
বর্তমান বিশ্বে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তার ২৪ শতাংশই আসে পরমাণু শক্তি
থেকে। এগুলো সবই উন্নত দেশে অবস্থিত। বিশ্বে ২৮টি পরমাণুভিত্তিক ৪২০
বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মাঝে ফ্রান্সে ৫৯টি। ফ্রান্সে মোট বিদ্যুতের ৭৯
শতাংশ উৎপাদিত হয় পরমাণু শক্তি থেকে। বেলজিয়ামে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫৮টি।
দেশটির মোট বিদ্যুতের ৫৮ শতাংশই আসে পরমাণু শক্তি থেকে। সুইডেনে ৪৪ শতাংশ,
কোরিয়ায় ৪০, জাপানে ৫৫ ও যুক্তরাষ্ট্রে ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ পরমাণু
শক্তিনির্ভর। তবে ফুকুশিমার পর জাপান নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে এবং বিকল্প
শক্তির কথা চিন্তা করছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে চীনে ৯
হাজার, ভারতে ৪ হাজার ১২০ ও পাকিস্তানে ৪২৫ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ
উৎপাদিত হয়। ২০২০ সালের মধ্যে চীন ৪০ হাজার, ভারত ২০ হাজার ও পাকিস্তান ৭
হাজার মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। অনেকেই জানেন,
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতি
নিতে হয়। বাংলাদেশ এই অনুমতি পেয়েছিল ২০০৭ সালের জুনে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের
ভয়টা হচ্ছে এর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে। দক্ষ জনশক্তি আমাদের নেই। এর অর্থ,
দীর্ঘদিন রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা থেকে যাবে আমাদের। দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা
হচ্ছে জনবসতির ঘনত্ব। রূপপুরে যেখানে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, সেখানে
আশপাশে জনবসতি রয়েছে। এই জনবসতি সরিয়ে নেয়াটা হবে এক বড় সমস্যা। এছাড়া
বাংলাদেশে এমন কোনো বিরান এলাকা নেই, যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি
স্থাপন করা যায়। আমাদের বিদ্যুতের চহিদা বাড়ছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের
দুর্নীতি এখন মুখে মুখে। এ শীতেও লোডশেডিং হচ্ছে। আগামী গ্রীষ্মে লোডশেডিং
কোন পর্যায়ে যাবে, ভাবতেই আঁতকে উঠতে হয়। আমাদের কয়লার একটা বড় সম্ভাবনা
থাকলেও এটি উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক আছে। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এটিকে
আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কার
হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ
৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। কিন্তু উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ
গ্যাসের সমতুল্য; যা আমাদের ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত
করণে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখতে পারে।
সরকার পরমাণু শক্তিতে কেন গেল, তার একটা যুক্তি আছে। বর্তমানে বিদ্যুতের
যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সর্বত্র তা সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ধারণা করা
হচ্ছে, ২০২০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াটে।
তখন এ চাহিদা আমরা পূরণ
করব কীভাবে?
জ্বালানি আজ বিশ্বের অন্যতম একটি সমস্যা। সস্তায় জ্বলানী তেল পাওয়ার দিন
ফুরিয়ে আসছে। আমরা বর্তমানে এক ধরনের ‘অয়েল শক’-এ আক্রান্ত। তেল অনুসন্ধান ও
উত্তোলনের সর্বোচ্চ পয়েন্টটিতে আমরা পৌঁছে গেছি। এখন সাপ্লাই কমে যাচ্ছে
বিশ্ববাজারে, যাতে করে দাম বেড়ে যাচ্ছে। ৪০ বছর ধরে নতুন তেল খনি
অবিষ্কারের হার পড়তির দিকে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য জ্বালানি
গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, উন্নয়নের চাপ, কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা
প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। তেলের
দুষ্প্রাপ্যতা ও দামের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাসকূপগুলো নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এবং
বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবনে ব্যর্থতা বাংলাদেশের জ্বালানী নিরাপত্তা
পরিস্থিতিকে একটি বড় ধরনের
সংকটে ফেলবে। বাংলাদেশ এ ‘অয়েল শক’ সহজে কাটিয়ে উঠতে পারবে না। তাই এখন
থেকেই বিকল্প জ্বালানির কথা ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে পরমাণু জ্বালানিকেন্দ্র
স্থাপনের সিদ্ধান্তটি ভালো। তবে এর নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।
শুধু কেন্দ্র নির্মাণ করলেই চলবে না, রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করা, ওই দেশের
সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের মনোভাবও বিবেচনায় নিতে
হবে। রূপপুরে একাধিক ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ রয়ে গেছে। নদীর একেবারে পার্শ্ববর্তী
এই রূপপুর। চেরনোবিল ও ফুকুশিমা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। চেরনোবিলের
দুর্ঘটনাকবলিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই
এলাকা আজো নিরাপদ নয়। আর ফুকুশিমার দুর্ঘটনার পর এর আশপাশ ‘সিল’ করে দেয়া
হয়েছে। জার্মানি এরই মধ্যে কয়েকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে
দিয়েছে। বিষয়গুলো আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় নিলে ভালো করবেন।
Daily BONIK BARTA
19.01.13
0 comments:
Post a Comment