রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

‘আরব বসন্ত’ তৃতীয় ধাপে প্রবেশ করেছে

অতি সম্প্রতি মিসরে গণভোটে ইসলামি শরিয়াহ আইনভিত্তিক সংবিধান পাস হওয়ার পর স্পষ্ট করেই বলা যায় ‘আরব বসন্ত’ তৃতীয় ধাপে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে দিয়ে আরব বিশ্বের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে, সে প্রশ্ন থেকেই গেল। তেল ও জ্বালানি সম্পদ সমৃদ্ধ আরব বিশ্ব বিশ্ব রাজনীতিতে বরাবরই একটি ভূমিকা পালন করে এসেছে। তবে এখানে যে বৈশিষ্ট্য বিশ্ববাসীকে আকৃষ্ট করেছিল তা হচ্ছে এখানে একদিকে ছিল রাজতন্ত্র অন্যদিকে ছিল স্বৈরাচারী শাসক চক্র, যারা বছরের পর বছর ক্ষমতা ধরে রেখেছিল, যেখানে জনসাধারণের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ ছিল না। অনেকটা রাজতন্ত্রের মতোই তারা ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন। লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি (১৯৬৯ সাল থেকে), সিরিয়ায় আসাদ (২০০০ সাল থেকে), ইয়েমেনে আব্দুল্লাহ সালেহ (১৯৭৮ সাল থেকে), মিসরে মুবারক (১৯৮১ সাল থেকে) ছিলেন সেসব স্বৈরশাসক, যাদের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু তিউনেসিয়ায় সাধারণ এক ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বওকুজিজির (যিনি কম্পিউটার বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও ছিলেন বেকার) গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা, (২০১০ সালের ডিসেম্বর) পুরো আরব বিশ্বের দৃশ্যপটকে পাল্টে দিল। জন্ম হলো ‘আরব বসন্ত’র। পতন ঘটল তিউনেসিয়ার স্বৈরশাসক বেন আলির। ফেব্র“য়ারি (২০১১) মিসরের তাহরির স্কয়ারে হাজার হাজার মানুষের অবস্থান ধর্মঘট পদত্যাগ করতে বাধ্য করল হোসনি মোবারককে। একই ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ইয়েমেনে আলি আব্দুল্লাহ সালেহের পদত্যাগের মধ্যে দিয়ে। অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানে গাদ্দাফি উৎখাত না হলেও মার্কিনি হামলায় শেষ অবধি উৎখাত ও নিহত হলেন। আসাদ সিরিয়ায় টিকে আছেন বটে; কিন্তু তার পতনও সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর এভাবেই তৈরি হলো ‘আরব বসন্ত’র ইতিহাস। ষাটের দশকে সাবেক চেকোশ্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে সমাজতন্ত্রবিরোধী যে আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল তাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল প্রাগ বসন্ত হিসেবে। প্রাগ বসন্ত সেখানে কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারেনি। কিন্তু ‘আরব বসন্ত’ আরব বিশ্বে পরিবর্তন ডেকে এনেছে। স্বৈরশাসকদের পতন ঘটেছে। এটা ছিল বিপ্লবের প্রথম স্টেপ। দ্বিতীয় স্টেপে একজন সর্বজন গ্রহণযোগ্য নেতা দায়িত্ব নিয়েছেন। আর তৃতীয় স্টেপে ইসলামপন্থিরা ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে। যদি মিসরের দৃষ্টান্ত দেই, সেখানে ২০১১ সালের বিপ্লব হোসনি মুবারককে ক্ষমতাচ্যুত করে। দ্বিতীয় ধাপে ড. মুরসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। আর তৃতীয় ধাপে সেখানে গণভোটে একটি সংবিধান অনুমোদিত হয়েছে, যেখানে বলা আছে আইনের উৎস হবে শরিয়াহ। আগামী ফেব্র“য়ারি মাসে সেখানে নির্বাচন। মিসর ধীরে ধীরে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে।
একপর্যায়ে ইসলামপন্থিরা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দিচ্ছে এই অভিযোগ তুলে উদারপন্থি, ধর্মনিরপেক্ষ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্যরা সংসদ বয়কট করেছিল। এরপর কোনো রকম সংশোধনী ছাড়াই খসড়া সংবিধানটি সংসদে অনুমোদিত হয়েছিল। পরে খসড়া সংবিধানের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু বিরোধীদলীয় মোর্চ্চা ন্যাশনাল সালভেশন ফ্রন্ট এই গণভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মোহাম্মদ মুরসি কি ইসলামের শরিয়াহভিত্তিক একটি সমাজ বিনির্মাণের উদ্যোগ নেবেন মিসরে? তার দল ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস’ পার্টি। ইসলামিক ব্রাদারহুড একটি ‘ধর্মভিত্তিক’ রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে। মুরসি কি এখন এদিকেই মিসরকে চালিত করবেন? এই মুহূর্তে এটি স্পষ্ট নয়। তবে মুরসি অতটা কট্টরপন্থি নন। তিনি ইসলামিক। তিনি ইসলাম আর গণতন্ত্রকে এক কাতারে দেখতে চান। আর এ কারণে তিনি ‘ইসলামিক গণতন্ত্র’র কথা বলছেন। সম্ভবত মিসর ‘তুরস্ক মডেল’ অনুসরণ করবে। তুরস্কে ইসলামপন্থিরা জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। তুরস্কের সেনাবাহিনী ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শের অনুসারী। মিসরের সেনাবাহিনীও অনেকটা তাই। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তুরস্কের ক্ষমতাসীন এরদোগান সরকারের দ্বন্দ্বের কথা সবাই জানেন। সেনাবাহিনী তখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। যে কারণে সেখানে সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা কম। মুরসি এমনটি চাইবেন মিসরের জন্য। এ ক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সফল হবেন, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। উপরন্তু ইসরাইলের ব্যাপারে নয়া প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। কেননা ইসরাইলের আগ্রাসী নীতির কারণে গোটা আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক কখনো ভালো হয়নি। ১৯৭৮ সালে মিসরের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও এ সম্পর্ক কখনই উন্নত হয়নি। এমনকি মিসরের কট্টরপন্থিদের হাতে মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। যদিও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মুরসিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন এবং নয়া প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন তিনি সব চুক্তির প্রতি সম্মান জানাবেন। কিন্তু তার পরেও কথা থেকে যায়! কেননা ব্রাদারহুডের নেতৃত্ব এখনো পরিপূর্ণভাবে ‘ইসরাইলবিরোধিতা’ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। তারা যে প্রভাব খাটাবেন তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এখানেই এসে যায় ‘রিয়েল পলিটিকস’র বিষয়টি। মুরসি এই রিয়েল ‘পলিটিকস’ কতটুকু অনুসরণ করেন, সেটাই দেখার বিষয়। তবে আমি মোহাম্মদ মুরসির সাম্প্রতিক দেয়া বক্তব্যে কিছুটা আশাবাদী। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি একটি জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটি এই মুহূর্তে খুবই জরুরি। কেননা মিসর এখন একটি বিভক্ত সমাজ। একদিকে রয়েছে ইসলামিক কট্টরপন্থিরা, অন্যদিকে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মুবারক সমর্থকরা। ২০১১ সালে তেহরির স্কয়ারে ১৭ দিনের ‘বিপ্লব’ নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল মিসরে। দীর্ঘ ১৭ দিন দখলে রেখেছিল ‘বিপ্লবীরা’। মূলত তরুণরাই এই বিপ্লবের নায়ক। এরা সবাই যে ইসলামিক আদর্শকে পছন্দ করেন তা নয়, তারা মুবারকের অপশাসন (১৯৮১ সাল থেকে ক্ষমতায় ছিলেন) থেকে মিসরকে ‘মুক্ত’ করতে চেয়েছিলেন। ওই তরুণরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে বিপ্লবকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই তরুণ প্রজšে§র কেউ কেউ মুরসিকে সমর্থন করেছেন এটা সত্য। কিন্তু মিসর ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্র হোক, এটি তারা চাইবেন না। মিসর ‘বিপ্লব’ এ নারীরা একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। সেনাবাহিনীর হাতে অনেক তরুণী নিগৃহীতও হয়েছিলেন। এরা নিশ্চয়ই চাইবেন না মিসরে নারীদের অধিকার সংকুচিত হোক, বাধ্যতামূলক পর্দা প্রথা আরোপ করা হোক। মিসরের নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন। তারা আধুনিক মনস্ক। প্রেসিডেন্ট অঙ্গীকার করেছিলেন নতুন সরকারে কপটিক খ্রিস্টানদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং নয়া প্রধানমন্ত্রী হবেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। মুরসি বাস্তববাদী। তিনি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। তিনি আধুনিক মনস্ক একজন মানুষ। প্রকৌশল বিদ্যায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডক্টরেট ডিগ্রিও নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করছেন। তার রাজনৈতিক জীবনমাত্র ১২ বছরের। দীর্ঘ ৮৪ বছরের একটি সংগঠনের (ইসলামিক ব্রাদাহুড) প্রতিনিধি তিনি। দলে কট্টরপন্থি, উগ্রধর্মীয় আদর্শে বিশ্ববাসী এবং শরিয়াহ আইনভিত্তিক একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লোক অনেক রয়েছে। এদের ‘চাপ’ও থাকবে তার ওপর।
আরব বিশ্বে যে বসন্তের ঢেউ বইছিল তা এখন দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করল। তিউনেসিয়ার পর মিসর একনায়কতান্ত্রিক সরকারের উচ্ছেদের পর জনগণের ভোটে ইসলামপন্থিরা ক্ষমতাসীন হয়েছিল। এটা ছিল বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তর। তৃতীয় স্তরে কট্টরপন্থিদের অবস্থান শক্তিশালী হলো। গণভোটের পর ইসলামপন্থিরা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবে। এই মুহূর্তে তাদের পাল্লাটা ভারী। নয়া সংবিধানের আলোকে দু’মাস পর সেখানে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাতে ইসলামপন্থিরা বিজয়ী হবে, এটাই আশা করা যায়। মিসরে ইসলামপন্থিদের উত্থান ‘আরব বসন্ত’ পরবর্তী আরব বিশ্বে একটি নয়া ইতিহাস রচনা করল। তিউনেসিয়ায় ইসলামপন্থিরা এককভাবে মিসরের মতো ক্ষমতা পরিচালনা করতে না পারলেও তারা ক্ষমতার অংশীদার। লিবিয়ায় ইসলামপন্থিরা শক্তিশালী হচ্ছে। ইয়েমেনে আল কায়দার ঘাঁটি অনেক দিন থেকেই আছে। আর সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। স্পষ্টতই আরব বিশ্বের দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। ইসলামপন্থিরা সেখানে তখন ক্ষমতার অংশীদার। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে কি? অক্সফোর্ডের মিসরীয় বংশোদ্ভূত শিক্ষক তারিক রামাদান তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন ‘We are making a mistake, a very big mistake if we look at what we calls the Arab Awakening only by looking at the whole dynamics in political and not in economic terms.’ এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। অর্থনীতিতে যদি পরিবর্তন আনা না যায়, যদি বওকুজিজির মতো তরুণ গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির নিশ্চয়তা দেয়া না যায়, তাহলে তাহরীর স্কয়ার আবার উত্তপ্ত হবে। আরেকটি বিপ্লবের জন্য তৈরি হবে আরব বিশ্ব।
Daily Manobkontho
07.01.13

1 comments:

  1. ইয়েস, তারিক রমাদানের কথাটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।

    কলামটা পড়ে খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ স্যার!

    ReplyDelete