ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকা-ের এক সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরও তাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোচনার শেষ নেই। যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যে যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছিল, তার অবসান ঘটবে কি-না। এ নিয়ে নানা কথাবার্তা বলা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া সত্যিই কঠিন। ওসামার হত্যাকা-, হত্যাকা- নিয়ে ওবামা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য, পাকিস্তানের ভূমিকা ইত্যাদি নানা বিষয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ওসামার মৃত দেহের ছবি প্রকাশ না করা, দ্রুত ডিএনএ টেস্ট সম্পন্ন করা, মৃতদেহের প্রতি নূ্যনতম সম্মান না জানিয়ে তা আরব সাগরে দ্রুত ভাসিয়ে দেয়া ইত্যাদি নানা বিষয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে, যা কি-না বিতর্কের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে গত ৪ মে বহুল পঠিত ও নির্ভরযোগ্য একটি ম্যাগাজিন ঋড়ৎবরমহ চড়ষরপু একটি সিরিজ ছবি প্রকাশ করেছে (ঞযব করষষবৎং খধরৎ, ৪ গধু, ১১)। তাতে অ্যাবোটাবাদে যে বাড়িটিতে ওসামা বিন লাদেন থাকতেন বলে বলা হচ্ছে, ওই বাড়ির ও বাড়ির আশপাশের বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। একটি ছবি নিয়ে বিতর্ক ও নতুন জল্পনাকল্পনার জন্ম দিতে বাধ্য। ওই ছবিটি ২০০৫ সালের ১৫ জুনের তোলা। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ওই বাড়িটি, যেখানে ওসামা থাকতেন। সম্ভবত ছবিটি সিআইয়ের তোলা এবং ঋড়ৎবরমহ চড়ষরপু গধমধুরহব তা সংগ্রহ করেছে। পাঠক বোঝার চেষ্টা করুন ছবিটি ২০০৫ সালের এবং সিআইএ আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে ওসামা এখানে থাকতে পারেন। এর অর্থ কী? সিআইএ জানতো ওসামা বিন লাদেন কোথায় আছেন। ২০০৫ থেকে ২০১১ সময়টা অনেক লম্বা। ওই সময় ওসামাকে হত্যা বা গ্রেফতার করা হলো না কেন? আজ ২০১১ সালের মে মাসে তাঁকে হত্যা করা হলো এমন একটা সময় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র এক বছর এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থার কারণে বারাক ওবামার পুনরায় বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছিল! ওসামা মারা যাওয়ার সময় তার পকেটে পাওয়া গেল মাত্র ৫৫০ ইউরো! যিনি বিলিয়ন ডলারের মালিক, তার পকেটে কি-না মাত্র ৫৫০ ইউরো! ওসামা মারা গেছেন, এটা আল-কায়েদাও স্বীকার করেছে। তাকে কী 'বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য' বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল? এসব প্রশ্ন এখন উঠেছে। আর ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক। অ্যাবোটাবাদের মতো ছোট একটি শহরে একটি বাড়িতে তিনি থাকলেন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা এটা জানবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে এখানে আরো একটি প্রশ্ন উঠেছে। খোদ আইএসআই কী শেষ পর্যন্ত লাদেনের খবর জানিয়ে দিয়েছিল মার্কিন কর্তৃপক্ষকে? পাঠক, স্মরণ করার চেষ্টা করুন গেল ১১ এপ্রিল ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন আইএসআই প্রধান জেনারেল আহমেদ সুজা পাশা। জেনারেল পাশা সিআইএ প্রধান লিওন পেন্ট্রার সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিতও হয়েছিলেন। তাদের মাঝে কী ধরনের আলোচনা হয়েছে, তার বিররণ মিডিয়ায় জানান হয়নি। হতে পারে 'কোনো বড় ধরনের প্রাপ্তির আশায় আইএসআই লাদেনের খোঁজটি জানিয়ে দিল মার্কিন কর্তৃপক্ষকে। যদিও আইএসআই অস্বীকার করেছে যে, তারা লাদেনের আস্তানার ঠিকানা জানতো; কিন্তু এই বক্তব্য কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
সত্যিকার অর্থেই পাকিস্তানের ভাবমূর্তি আজ বিশ্বে যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিল যে, পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের 'প্রমট' করছে। লাদেনের ঘটনায় এটা এখন প্রমাণিত হলো। ভারত এখন দাবি করছে যে ২০০৮ সালের মুম্বাই সন্ত্রাসী কর্মকা-ের হোতারা পাকিস্তানে লুকিয়ে আছে। ভারত তাদের গ্রেফতার ও ভারতের কাছে হস্তান্তরের দাবি করেছে। বিশ্ব আসরে ভারতের এ দাবি আরও শক্তিশালী হবে এখন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাকে এখন বিশ্বব্যাপী ভিন্ন চোখে দেখা হবে। আগামীতে গোয়েন্দ সংস্থার কর্মকর্তারা যদি ইউরোপ তথা আমেরিকায় নিষিদ্ধ হন আমি আবাক হব না। পাক প্রধানমন্ত্রী গিলানির সরকারের জন্যও এটা খারাপ সংবাদ। দুটো কারণে গিলানি সরকারকে এখন 'কঠিন পরীক্ষার' মুখোমুখি হতে হবে। প্রথমত, বিরোধী দল বিশেষ করে ইসলামিক দলগুলো এটাকে ইস্যু করবে এবং সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করবে। নওয়াজ শরিফ এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছেন। দ্বিতীয়ত, মার্কিন ৪টি হেলিকপ্টার তার টার্গেট এ (এবৎড়হরসড়- লাদেনের কোড নাম) যখন হামলা করলো, তখন পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। এটা স্পষ্টতই পাকিস্তানের সাবধানতা ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ এই অভিযোগটি তুলেছেন। এর পেছনে যুক্তি আছে। মৌলবাদী সংগঠনগুলো এটাকেও ইস্যু করেছে ইতিমধ্যে। এমনিতেই সরকারের অবস্থান বেশ নড়বড়ে। চালকবিহীন ড্রোন বিমান হামলা সেখানে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এ যাবত প্রায় ২০০ ড্রোন হামলা পাকিস্তানের ভেতরে পরিচালিত হয়েছে। বলা হয়েছে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এই বিমান হামলা হচ্ছে। এর পেছনে সত্যতা যাই থাকুক, বাস্তবতা হচ্ছে এসব হামলায় পাকিস্তানি নাগরিকরা মারা যাচ্ছেন। এটা তো একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করার শামিল। পাক সরকার এর বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বলা যেতে পারে পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন চালকবিহীন ড্রোন বিমান হামলা ঠেকাতে। সরকারের জন্য এটা ভালো নয়। আরো একটি বিষয়, যা নিয়ে আমি চিন্তিত, তা হচ্ছে পাকিস্তান কী শেষ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবে। লদেনের মৃত্যুর খবর জানাজানি হওয়ার পর লাহোরে বড় ধরনের জানাজা হয়েছে। লস্করই তালিবান নেতা হাফিজ মোহাম্মদ সাঈদ এই জানাজা পরিচালনা করেন। সেখান থেকে প্রতিশোধের কথা উচ্চারিত হয়েছে। প্রতিশোধের কথা বলেছে তেহরিকই তালিবান নামে আরেকটি সংগঠন। কোয়েটায় লাদেনের সমর্থনে মিছিল বের হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার_ পাকিস্তানে এই জঙ্গিবাদী মনোভাব আরো শক্তিশালী হলো। এরা পাকিস্তানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। ধীরে ধীরে পাকিস্তানে সনাতন রাজনীতির 'মৃত্যু' ঘটতে পারে এবং মৌলবাদী চিন্তা চেতনা পাকিস্তানে আরো শক্তিশালী হতে পারে। ফলশ্রুতিতে ঋঅঞঅ অঞ্চল এক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, অথবা আফগানিস্তানের সঙ্গে মিশে গিয়ে বৃহত্তর একটি 'পাখতুনিস্তান' গঠন করতে পারে। শুধুমাত্র ইসলামাবাদ আর লাহোর শহরকেন্দ্রিক ছোট্ট এক পাকিস্তান তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা সামরিক নেতৃত্ব আজ কতটুকু বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন, সেটাই দেখার বিষয় এখন। সত্যিকার অর্থেই পাকিস্তান আজ বড় ধরনের এক সংকটের মুখোমুখি।
লাদেনের মৃত্যু হয়েছে। সেই সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে একটি অধ্যায়ের। ওসামা বিন লাদেন তাকে ফিরে একটি 'মিথ' তৈরি করেছিলেন। তবে অনেক প্রশ্নেরই কোনো জবাব হয়ত কোনোদিনই পাওয়া যাবে না এবং বিশ্ববাসী হয়তো কোনোদিনই জানবে না কে বা কারা লাদেনকে কেন এবং কোন কাজে 'তৈরি' করেছিল। যে ব্যক্তি সারাবিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যার সুপরিকল্পিত পরিকল্পনায় ৯/১১-এর জন্ম হয়েছিল, তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে কোনো ইন্টারনেট বা টেলিফোন ছাড়া অ্যাবোটাবাদে একাকী থাকবেন, এটা বিশ্বসযোগ্য নয়। যিনি শত শত 'যোদ্ধা' তৈরি করেছেন, যারা তার একটি মাত্র নির্দেশে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাতে পারে, নেতা হিসেবে লাদেনের তো তাদের সঙ্গেই থাকার কথা? ইসলামের 'শত্রুদের' বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ করার কথা, যেমনি করেছিলেন তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরণ? যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় লাদেন বাস করলেন স্ত্রী-সন্তানসহ কোনো ধরনের শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা ছাড়া? এটা কী নতুন করে কোনো প্রশ্নের জন্ম দেবে না?
লাদেনের এই মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ' এর অবসান ঘটাবে না। ইয়েমের, আলজেরিয়া, মালি, ইরাক, আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানে আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক আরো শক্তিশালী হবে। তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের সমবেদনা আরো বাড়বে। মৃত লাদেন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। লাদেনকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাব আরো স্পষ্প হলো। এর মধ্যে দিয়ে এটা আবারো প্রমাণিত হলো আগ্রাসন ও বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব করার যে মানসিকতা। সেই মানসিকতার প্রশ্নে বুশ আর ওবামার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বুশ যে যুক্তিতে ইরাকে আক্রমণ চালিয়েছিল, আজ ওবামা অনেকটা একই ধারাবাহিকতায় একটি স্বাধীন দেশের (পাকিস্তান) স্বাধীনতাও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করলেন। এটাই হচ্ছে স্নায়ুযুদ্ধোত্তর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য দিক। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে একক পরাশক্তি হেসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করবে। ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর কায়রো সফর করেছিলেন। সেখানে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে মনে হয়েছিল তিনি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন একটি মাত্রা দিতে চান; কিন্তু লাদেনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (হেগে) বিচারের মুখোমুখি না করে, তাকে হত্যা করা_ কোনো আন্তর্জাতিক আইন তা অনুমোদন করে না। তাই মার্কিনি ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আল-কায়েদা প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলছে। এখন আমাদের শুধু অপেক্ষার পালা- প্রতিশোধটি কেমন এবং কোন পর্যায়ে যায়, তা দেখার। একজন ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু উত্থাপিত সব প্রশ্নের কোনো সমাধান দিলো না।
সত্যিকার অর্থেই পাকিস্তানের ভাবমূর্তি আজ বিশ্বে যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিল যে, পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের 'প্রমট' করছে। লাদেনের ঘটনায় এটা এখন প্রমাণিত হলো। ভারত এখন দাবি করছে যে ২০০৮ সালের মুম্বাই সন্ত্রাসী কর্মকা-ের হোতারা পাকিস্তানে লুকিয়ে আছে। ভারত তাদের গ্রেফতার ও ভারতের কাছে হস্তান্তরের দাবি করেছে। বিশ্ব আসরে ভারতের এ দাবি আরও শক্তিশালী হবে এখন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাকে এখন বিশ্বব্যাপী ভিন্ন চোখে দেখা হবে। আগামীতে গোয়েন্দ সংস্থার কর্মকর্তারা যদি ইউরোপ তথা আমেরিকায় নিষিদ্ধ হন আমি আবাক হব না। পাক প্রধানমন্ত্রী গিলানির সরকারের জন্যও এটা খারাপ সংবাদ। দুটো কারণে গিলানি সরকারকে এখন 'কঠিন পরীক্ষার' মুখোমুখি হতে হবে। প্রথমত, বিরোধী দল বিশেষ করে ইসলামিক দলগুলো এটাকে ইস্যু করবে এবং সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করবে। নওয়াজ শরিফ এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছেন। দ্বিতীয়ত, মার্কিন ৪টি হেলিকপ্টার তার টার্গেট এ (এবৎড়হরসড়- লাদেনের কোড নাম) যখন হামলা করলো, তখন পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। এটা স্পষ্টতই পাকিস্তানের সাবধানতা ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ এই অভিযোগটি তুলেছেন। এর পেছনে যুক্তি আছে। মৌলবাদী সংগঠনগুলো এটাকেও ইস্যু করেছে ইতিমধ্যে। এমনিতেই সরকারের অবস্থান বেশ নড়বড়ে। চালকবিহীন ড্রোন বিমান হামলা সেখানে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এ যাবত প্রায় ২০০ ড্রোন হামলা পাকিস্তানের ভেতরে পরিচালিত হয়েছে। বলা হয়েছে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এই বিমান হামলা হচ্ছে। এর পেছনে সত্যতা যাই থাকুক, বাস্তবতা হচ্ছে এসব হামলায় পাকিস্তানি নাগরিকরা মারা যাচ্ছেন। এটা তো একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করার শামিল। পাক সরকার এর বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বলা যেতে পারে পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন চালকবিহীন ড্রোন বিমান হামলা ঠেকাতে। সরকারের জন্য এটা ভালো নয়। আরো একটি বিষয়, যা নিয়ে আমি চিন্তিত, তা হচ্ছে পাকিস্তান কী শেষ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবে। লদেনের মৃত্যুর খবর জানাজানি হওয়ার পর লাহোরে বড় ধরনের জানাজা হয়েছে। লস্করই তালিবান নেতা হাফিজ মোহাম্মদ সাঈদ এই জানাজা পরিচালনা করেন। সেখান থেকে প্রতিশোধের কথা উচ্চারিত হয়েছে। প্রতিশোধের কথা বলেছে তেহরিকই তালিবান নামে আরেকটি সংগঠন। কোয়েটায় লাদেনের সমর্থনে মিছিল বের হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার_ পাকিস্তানে এই জঙ্গিবাদী মনোভাব আরো শক্তিশালী হলো। এরা পাকিস্তানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। ধীরে ধীরে পাকিস্তানে সনাতন রাজনীতির 'মৃত্যু' ঘটতে পারে এবং মৌলবাদী চিন্তা চেতনা পাকিস্তানে আরো শক্তিশালী হতে পারে। ফলশ্রুতিতে ঋঅঞঅ অঞ্চল এক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, অথবা আফগানিস্তানের সঙ্গে মিশে গিয়ে বৃহত্তর একটি 'পাখতুনিস্তান' গঠন করতে পারে। শুধুমাত্র ইসলামাবাদ আর লাহোর শহরকেন্দ্রিক ছোট্ট এক পাকিস্তান তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা সামরিক নেতৃত্ব আজ কতটুকু বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন, সেটাই দেখার বিষয় এখন। সত্যিকার অর্থেই পাকিস্তান আজ বড় ধরনের এক সংকটের মুখোমুখি।
লাদেনের মৃত্যু হয়েছে। সেই সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে একটি অধ্যায়ের। ওসামা বিন লাদেন তাকে ফিরে একটি 'মিথ' তৈরি করেছিলেন। তবে অনেক প্রশ্নেরই কোনো জবাব হয়ত কোনোদিনই পাওয়া যাবে না এবং বিশ্ববাসী হয়তো কোনোদিনই জানবে না কে বা কারা লাদেনকে কেন এবং কোন কাজে 'তৈরি' করেছিল। যে ব্যক্তি সারাবিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যার সুপরিকল্পিত পরিকল্পনায় ৯/১১-এর জন্ম হয়েছিল, তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে কোনো ইন্টারনেট বা টেলিফোন ছাড়া অ্যাবোটাবাদে একাকী থাকবেন, এটা বিশ্বসযোগ্য নয়। যিনি শত শত 'যোদ্ধা' তৈরি করেছেন, যারা তার একটি মাত্র নির্দেশে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাতে পারে, নেতা হিসেবে লাদেনের তো তাদের সঙ্গেই থাকার কথা? ইসলামের 'শত্রুদের' বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ করার কথা, যেমনি করেছিলেন তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরণ? যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় লাদেন বাস করলেন স্ত্রী-সন্তানসহ কোনো ধরনের শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা ছাড়া? এটা কী নতুন করে কোনো প্রশ্নের জন্ম দেবে না?
লাদেনের এই মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ' এর অবসান ঘটাবে না। ইয়েমের, আলজেরিয়া, মালি, ইরাক, আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানে আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক আরো শক্তিশালী হবে। তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের সমবেদনা আরো বাড়বে। মৃত লাদেন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। লাদেনকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাব আরো স্পষ্প হলো। এর মধ্যে দিয়ে এটা আবারো প্রমাণিত হলো আগ্রাসন ও বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব করার যে মানসিকতা। সেই মানসিকতার প্রশ্নে বুশ আর ওবামার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বুশ যে যুক্তিতে ইরাকে আক্রমণ চালিয়েছিল, আজ ওবামা অনেকটা একই ধারাবাহিকতায় একটি স্বাধীন দেশের (পাকিস্তান) স্বাধীনতাও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করলেন। এটাই হচ্ছে স্নায়ুযুদ্ধোত্তর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য দিক। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে একক পরাশক্তি হেসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করবে। ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর কায়রো সফর করেছিলেন। সেখানে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে মনে হয়েছিল তিনি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন একটি মাত্রা দিতে চান; কিন্তু লাদেনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (হেগে) বিচারের মুখোমুখি না করে, তাকে হত্যা করা_ কোনো আন্তর্জাতিক আইন তা অনুমোদন করে না। তাই মার্কিনি ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আল-কায়েদা প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলছে। এখন আমাদের শুধু অপেক্ষার পালা- প্রতিশোধটি কেমন এবং কোন পর্যায়ে যায়, তা দেখার। একজন ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু উত্থাপিত সব প্রশ্নের কোনো সমাধান দিলো না।
পূর্বে প্রকাশ @ দৈনিক ডেসটিনি, ১১/০৫/১১
0 comments:
Post a Comment