রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রতিহিংসার রাজনীতির চালচিত্র







মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আরো দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিন করে ২০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। এটা ছিল ১৭ জানুয়ারির সংবাদপত্রের খবর। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ- পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা, মারধর, হত্যাচেষ্টা ও চুরি। মামলা দুটি করা হয়েছে কলাবাগান ও পল্টন থানায়। এর আগে পল্টন থানায় দায়ের করা আরেক মামলায় গাড়ি ভাঙচুর ও বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগ তুলে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। সেই থেকে তিনি কারাগারে। এই একটি ছোট্ট ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশের প্রতিহিংসার রাজনীতি আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। মির্জা ফখরুল একটি বড় রাজনৈতিক দলের মহাসচিব। অতীতে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কয়জন সজ্জন ব্যক্তি এখনো আছেন এবং যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই, মির্জা ফখরুল তেমন একজন ব্যক্তি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে যখন গাড়ি ভাঙচুর, মারামারি, হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়, তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি খারাপ দিকই উন্মোচিত হয়। মন্ত্রী থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে যদি দুর্নীতির অভিযোগ থাকে, সেই অভিযোগে তাঁর বিচার হতেই পারে। কিন্তু তিনি গাড়ি ভাঙচুর করবেন! দলের একজন সিনিয়র নেতা, তিনি গাড়ি ভাঙচুর করবেন! এটাও আমাদের শুনতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ আজ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। যে রাজনীতি হওয়া উচিত জনকল্যাণমূলক, সে রাজনীতি এখন স্থান করে নিয়েছে প্রতিহিংসার। রাজনীতিতে বৈরিতা, বিরোধ থাকবেই। কিন্তু সেই বৈরিতা আজ চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
আমরা আমাদের সংবিধান নিয়ে গর্ব করি। বিশেষ করে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বেশ কিছু ধারা রয়েছে, যা আমাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করেছে। এ ক্ষেত্রে ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), অনুচ্ছেদ ৩২ (জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অঙ্গীকার), অনুচ্ছেদ ৩৬, ৩৭, ৩৮ (চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা) ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১১ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করতে পারি, যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড কিংবা বিএনপির মহাসচিবকে গ্রেপ্তার ইত্যাদি ঘটনায় সংবিধানের এসব ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে 'অধিকার' আমাদের জানিয়েছে, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৬৪ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নির্যাতিতদের মধ্যে পুলিশের হাতে ৫০ জন, র‌্যাবের হাতে পাঁচজন, বিজিবির হাতে দুজন এবং জেল কর্তৃপক্ষের হাতে দুজন নির্যাতনের শিকার হয়েছে (আমার দেশ, ২৩ ডিসেম্বর ২০১২)। পুলিশের এই ভূমিকা সংগত কারণেই আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। এমনিতেই রাজনীতি যখন উত্তপ্ত, দেশ যখন সংঘাতের মুখোমুখি, তখন এই পরিসংখ্যান আমাদের বড় ধরনের হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়।
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধ লিখে প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেন। সেটা ১৯৭৪ সালের কথা। তারপর কেটে গেছে ৩৮টি বছর। কিন্তু এই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কি নিশ্চিত হয়েছে? র‌্যাব এখন অনেকের কাছেই একটি আতঙ্কের নাম। র‌্যাবের অনেক ভালো অর্জন নষ্ট হয়ে গেছে দু-একটি ঘটনায়। সর্বশেষ ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলামের হাতকড়া পরা অবস্থায় মৃতদেহ পাওয়া গেল কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার আদাবাড়ী মনোহরপুর গ্রামের পেঁয়াজক্ষেতের পাশে। অভিযোগ র‌্যাবের বিরুদ্ধে। র‌্যাব তা অস্বীকার করলেও পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে র‌্যাবের পরিচয়ে কয়েক ব্যক্তি তাঁকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর মৃতদেহ পুলিশের হাতকড়া লাগানো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ বলছে, এ ধরনের হাতকড়া বাইরে কিনতে পাওয়া যায়। কী ভয়াবহ কথা! প্রকাশ্যে বা গোপনে যদি এ ধরনের হাতকড়া পাওয়া যায়, তাতে তো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সতর্ক হওয়ার কথা। তারা এটা বন্ধ করছে না কেন? রফিকুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। তাঁর ব্যবসায়িক বিরোধ, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি, সম্পত্তি ইত্যাদি প্রশ্ন তাঁর হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এখন পুলিশ কিংবা র‌্যাবেরই দায়িত্ব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত মোটিভ খুঁজে বের করা। আমরা চাই না র‌্যাবের সব অর্জন দু-একটি ঘটনায় ম্লান হয়ে যাক। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা আজও আমরা করতে পারলাম না। আমাদের এতগুলো সংস্থা, রাষ্ট্র জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে র‌্যাব, পুলিশসহ বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার পেছনে; কিন্তু ফলাফল কী? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বারবার র‌্যাবের নাম এসেছে। অতীতে যাঁদের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, তাঁরা সমাজের উঁচুস্তরের কেউ নন। বরং প্রায় সবার বিরুদ্ধেই খুন, হত্যা, চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। তাঁরা কেউই সমাজের ভালো মানুষ ছিলেন না। তার পরও তাঁদের এই মৃত্যু প্রত্যাশিত নয়। এই অস্বাভাবিক মৃত্যু আমরা কামনা করতে পারি না। কিন্তু ইলিয়াস আলীর ঘটনাকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব? ইলিয়াস আলী সাধারণ কেউ নন। সাবেক ছাত্রনেতা ও বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতাদের একজন। তিনি 'হারিয়ে' গেলেন। আমরা কেউ তার খোঁজ পেলাম না। র‌্যাব তো কত কিছুই করল। তাঁর বাসায় সিসি ক্যামেরা বসানো হলো। জানা গেল না কারা তাঁকে ধরে নিয়ে গেল। কেনই বা নিল। কী তাঁর অপরাধ। তাঁকে 'গুম' করার অভিযোগে হরতাল হলো। কিন্তু ইলিয়াস আলী আর ফিরে এলেন না।
রাজনীতিতে বৈরিতা থাকবেই; কিন্তু তা যেন হিংসাত্মক রূপ না নেয়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা কত মারাত্মক হতে পারে, তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ১৯৯৪ সালে আফ্রিকার একটি দেশ রুয়ান্ডায়। হুতু-তুতসির দ্বন্দ্বে লাখ লাখ মানুষকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছিল। আইন, মানবতা, সংবিধান সেখানে কাজ করেনি। এই প্রতিহিংসাপরায়ণতা ওই দেশটিকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। আমরা হুতু-তুতসিদের দেশে পরিণত হতে চাই না। রাজনীতি হোক জনকল্যাণমূলক, মানুষকে সেবা করার যে মহান ব্রত- সেটাই হোক রাজনীতি। এই রাজনীতি করে গেছেন মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অগাধ সম্পত্তির মালিক তাঁরা কেউ হননি। ভাসানী কুঁড়েঘরে থেকেই রাজনীতি করেছেন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ব্যাংকে অগাধ টাকা, ঢাকা শহরে প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক ভাসানী ছিলেন না। তাঁর পরিবারের সদস্যদের অনেককেই দুঃখকষ্টের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। ভাসানী যে রাজনীতি করে গেছেন, সেই রাজনীতিতে প্রতিহিংসাপরায়ণতার কোনো স্থান ছিল না। বঙ্গবন্ধুর এক ডাকে, তাঁর অঙ্গুলিহেলনে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে যেত। তিনি মানুষকে ভালোবেসে রাজনীতি করে গেছেন। অথচ আজ রাজনীতিকে ঘিরে প্রতিহিংসার প্রবণতা খুব বেশি। মির্জা ফখরুলের দৃষ্টান্ত দিয়ে আমরা বোঝাতে চেয়েছি, বাংলাদেশে প্রতিহিংসার রাজনীতির ব্যাপ্তি ঘটেছে। মির্জা ফখরুলের পাশাপাশি রুহুল কবীর রিজভীর নামও উল্লেখ করা যায়, যিনি নিজ অফিসেই অবরুদ্ধ জীবন যাপন করছেন। এই প্রবণতা বর্তমান সময়ে বাড়লেও অতীতে চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও ওই প্রতিহিংসার রাজনীতিকে আমরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখেছি।
পরস্পরকে অবিশ্বাস আমাদের দেশে যে সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, এই সংস্কৃতি ধারণ করে আমরা গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। বরং গণতন্ত্রচর্চা এ দেশে মুখ থুবড়ে পড়বে। হেনরি ডেভিড থরোর একটি উক্তি মনে পড়ে গেল। তিনি লিখেছিলেন, There will never be a really free and enlightened state until the state comes to recognize the individual as a higher and independent power, from which all its own power and authority are derived and treats him accordingly। বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, রাষ্ট্র যে পর্যন্ত ব্যক্তিকে উচ্চতর ও স্বাধীন ক্ষমতা হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়, যা তার নিজের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উৎস এবং যে পর্যন্ত ব্যক্তির সঙ্গে সে অনুসারে আচরণ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত সত্যিকারের কোনো মুক্ত ও জ্ঞানালোকিত রাষ্ট্র হবে না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের একজন কবি ও দার্শনিক ছিলেন থরো। বাংলাদেশে যে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, তাতে আমরা জ্ঞানালোকিত রাষ্ট্র গঠন করতে পারব না। মুখে যত কথাই বলি না কেন, আমরা গণতন্ত্রকেও বিনির্মাণ করতে পারব না; যদি না প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে পারি।
Kalerkontho ( Rajniti )22.01.13

0 comments:

Post a Comment