রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান আশার কথা বলছে না

বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন আগামী ২১ জানুয়ারি। কিন্তু চলতি সপ্তাহে অর্থনীতির যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান Bipartisan Policy Center যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, তাতে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির কালো দিকটাই ফুটে উঠেছে। জানুয়ারির শুরুতেই তথাকথিত ‘ফিসক্যাল ক্লিফ’ বা ‘খাদে পড়ার’ হাত থেকে মার্কিন অর্থনীতিকে আপাতত রক্ষা করতে পারলেও সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে ফেডারেল সরকারকে ট্যাক্স রিটার্ন পরিশোধ করতে হবে ৮৬ বিলিয়ন ডলার; স্বাস্থ্যসেবা তথা মেডিকেয়ারের বিল পরিশোধ করতে হবে ৭৩ বিলিয়ন; সোস্যাল সিকিউরিটি বিল ৬১ বিলিয়ন; ঋণের সুদ ৩৮ বিলিয়ন; প্রতিরক্ষা খাতের বিল পরিশোধ ২৯ বিলিয়ন; ফুড স্ট্যাম্প, হাউজিং; ওয়েলফেয়ার খাতে ২২ বিলিয়ন, কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি ২০ বিলিয়ন, শিক্ষা খাতে ১৭ বিলিয়ন এবং অন্যান্য খাতে ১০৬ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। মোট অর্থ পরিশোধ করতে হবে ৪৫২ বিলিয়ন ডলার। অথচ রেভিনিউ আসবে মাত্র ২৭৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ১৭৫ বিলিয়ন ডলার। তাহলে কোত্থেকে এ ঘাটতি মেটাবেন বারাক ওবামা? এরই মধ্যে একটি বড় ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে ওবামা প্রশাসন। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত (২০১২) এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এর একটা অংশ নেয়া হয়েছে চীনের কাছ থেকে। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সম্ভাবনা দুটি। এক. চীনকে ঋণের অংশ পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ, দুই. সোস্যাল সিকিউরিটির অর্থ প্রদানে অসম্মতি। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, যুক্তরাষ্ট ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে গ্রিসের মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে দেশটি। গ্রিসের অর্থনৈতিক বিপর্যয় পুরো ‘ইউরো জোন’কে ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিয়েছে। একসময় ইউরোপের মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিয়ে গর্ব করত। কিন্তু সমাজে অসমতা ও বৈষম্যের কারণে সেই গর্বের জায়গাটা এখন দুর্বল হয়ে গেছে। গ্রিস ও ইতালির অর্থনৈতিক পরিস্থিতির রেশ ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভক্তির কথা প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি এ বিভক্তির পক্ষে। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত গরিব দেশগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। এরা ঋণ গ্রহণ করে পরিশোধ করতে পারছে না। প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেকার সমস্যা বাড়ছে। শ্রেণীবৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। জার্মানি ইউরোপে একটি ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও দেশটিতে দরিদ্রের হার ৬ শতাংশ আর বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সুইজারল্যান্ড ইইউয়ের সদস্য নয়। এখানে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৮ আর ৭ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বেলজিয়ামে এ হার যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ ও ১৫ শতাংশ। পর্তুগাল ঋণ সমস্যায় জর্জরিত। এখানে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৩ ও ১৮ শতাংশ। শুধু ইউরোপের কথা কেন বলি; অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ানের মতো শিল্পোন্নত দেশেও ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর খবর পাওয়া যায় না। এসব দেশেও বেকারত্ব বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ মুহূর্তে শুধু নিউইয়র্কে অকুপাই মুভমেন্ট সীমিত আকারে পরিচালিত হলেও অন্যত্র এর কোনো খবর পাওয়া যায় না।


দ্বিতীয় মেয়াদে বারাক ওবামার দায়িত্ব গ্রহণ তাই সঙ্গত কারণেই একটি প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে তরুণ প্রজন্মের কাছে। তারা চাকরি চায়। সবার জন্য চায় স্বাস্থ্যসেবা। মার্কিন জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের কোনো হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেই। ওবামা স্বাস্থ্যসেবায় কিছু কাটছাঁট করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। এখন দেখার বিষয়, তিনি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কত দূর যান। ১৬ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের আর্থিক ঘাটতি নিয়ে ওবামা তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করবেন। তিনি নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন— এ ঘাটতি তিনি ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনবেন। ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার কর্মসূচি তার রয়েছে। মোটরগাড়িশিল্প বাঁচাতে প্রণোদনা দেয়া সরকারের সফলতা বলে মনে করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয় না। ২০১৪ সালে তিনি আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেবেন। ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির শান্তিপূর্ণ সমাধান চান তিনি। এতে ইসরায়েলি নেতৃত্ব যে খুশি হবেন না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওবামা জাতীয় নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সামরিক ব্যয় বাড়ানোর বিপক্ষে ওবামা। বরং আগামী এক দশকে এ খাতে ব্যয় প্রতি বছর গড়ে ৪৮ কোটি ডলার কমাতে চান তিনি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা, তা এ মুহূর্তে বলা না গেলেও দু-একটা ঘটনায় ইঙ্গিত মিলছে যে— ওই সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অতি সম্প্রতি যে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দিতে পারে। যদিও অনেক দিন থেকে বলা হচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুত টিকফা চুক্তি করতে চাচ্ছিল। বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রেও কালক্ষেপণ করেছে। একই সঙ্গে শ্রমিকের অধিকার লঙ্ঘন, শ্রমিক নেতা আমিনুলের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারার ব্যর্থতা, সর্বোপরি ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সরকার বিষয়গুলো কখনই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। ফলে ‘ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ’ সম্প্রতি যে চিঠি ইস্যু করেছে, তাতে জিএসপি সুবিধা বাতিলের কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ ৪৮০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে, তার মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ এই জিএসপি সুবিধা পায়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে আসছি, তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার। কোনো কোনো মহল থেকে আমাদের আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল যে, তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা দেয়া হবে। এখন সব ভেস্তে যেতে বসেছে। যুক্তরাষ্ট্র একজন নয়া বাণিজ্যমন্ত্রী ও একজন নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাচ্ছে। বাংলাদেশ সংক্রান্ত প্রচলিত নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে না বলে ধারণা।


ওবামার দ্বিতীয় দফা দায়িত্ব গ্রহণ নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারীদের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। এতে অভিবাসী ও অবৈধ অভিবাসীদের জন্য সুযোগ আরো বাড়ল। ওবামার জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হবে— অর্থনীতিকে ‘বিপদের’ হাত থেকে রক্ষা করা। ‘ফিসক্যাল ক্লিফে’র ব্যাপারে সিনেট ও কংগ্রেস নীতিগতভাবে এক হলেও এখানে বলা হয়নি— যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণের কী হবে? ওই ঋণ যে অর্থনীতিতে একটি অস্থিরতা তৈরি করবে, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। অর্থনীতির ‘পাগলা ঘোড়া’কে তিনি যদি বাগে আনতে না পারেন, তাহলে অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাবেন। যে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি হোয়াইট হাউসে থেকে গেলেন, অতি দ্রুত সেই জনপ্রিয়তা তিনি হারাতে পারেন।


পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে একটি বড় ধরনের অসমতা তৈরি হয়েছে। ১৫ শতাংশ মানুষ সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ শতাংশ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৮-৯ শতাংশ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১২ সালের শেষে এটি ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ১০ শতাংশ আমেরিকান মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ গ্রহণ করে। একভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ শতাংশের মালিক। যুক্তরাষ্ট্রের ধনী-গরিব বৈষম্য সাম্প্রতিক কালে অনেক বেড়েছে। এ বৈষম্য ওবামা হুট করে কমিয়ে আনতে পারবেন না। এটা সত্য; তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা শিক্ষা-ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য সেটা হবে বড় পাওয়া। বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ওবামা দায়িত্ব নিলেন। এখন দেখতে হবে, অর্থনীতি উদ্ধারে তিনি কী ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

Daily BONIK BARTA

12.01.13


0 comments:

Post a Comment