রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সরকার জনস্বার্থে কি সব কাজ করে

সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ। অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে হোঁচট খেয়েছে সরকার। সরকারের আয় ব্যাপক হারে বাড়ানোর লক্ষ্যে নির্ধারণ করে বাজেট ঘোষণা করা হলেও তখন উন্নয়ন বাজেটে চার হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করা হচ্ছে। কিন্তু এটা কি জনস্বার্থে করা হচ্ছে? ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ নিচ্ছে। এতে সংগত কারণেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। আর এ কারণে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও জাতীয় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাছাড়া সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবের দামও বেড়ে যাবে। গত ৩ জানুয়ারি ২০১৩, সরকার পঞ্চম দফায় জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। এর যে একটি নেতিবাচক দিক আছে, আমরা তা ভেবেও দেখি না। বলা হয়, পার্শ্ববর্তী দেশে জ্বালানি তেলের দাম আমাদের চেয়ে বেশি। এটা সত্য। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে এ যুক্তি তো বিবেচনায় নেয়া যাবে না। অর্থাৎ ভারতে মধ্যবিত্তের বেতন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক আমাদের চেয়ে তিনগুণ বেশি বেতন পান। উপরন্তু তুলনামূলক বিচারে ওদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসিপত্রের দাম আমাদের চাইতে কম। বেতন বেশি হওয়ায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা আমাদের চাইতে অনেক বেশি। সে কারণে ওখানে জ্বালানি তেলের দাম বেশি হলেও তা মধ্যবিত্তকে তেমন স্পর্শ করে না। সব কিছুর দামই ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে, যা আমাদের দেশে নেই। আমাদের দেশে সরকার যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, সে সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। তাই যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হচ্ছে সরকার কি জনস্বার্থে এসব কাজ করে?
আমাদের সংবিধানে যেখানে জনসাধারণের ন্যূনতম মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সেখানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে, তাতে তা সংবিধানবর্ণিত মৌলিক অধিকার খর্বের শামিল। আমরা পরিসংখ্যান দিয়েও আমাদের যুক্তির পক্ষে কথা বলতে পারি। কোনো পরিসংখ্যানই সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করবে না। এটা নির্বাচনের বছর। সরকারের এমন কোনো কিছু করা ঠিক নয়, যা জনজীবনকে আক্রান্ত করতে পারে। সরকার তো জনগণের অভিভাবক। সরকারের উচিত জনস্বার্থে কাজ করা। কিন্তু সরকার যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাতে জনস্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না।
সরকার চার বছর পার করল গত ৬ জানুয়ারি ২০১৩। গত বছর অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের সাফল্য নেই, বরং দুর্নীতিতে বাংলাদেশ একরকম ‘রেকর্ড’ করেছে। দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। হলমার্ক, ডেসটিনি আর পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির রেকর্ড, দুর্নীতির সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা জড়িত। অথচ লোকদেখানো তদন্ত রিপোর্টে অত্যন্ত সুকৌশলে সরকারের কর্মকর্তাদের বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে। মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে উঠলেও অভিযুক্ত সেই মন্ত্রীকে বাঁচিয়ে দিয়েছে দুদক। দুজন কর্মকর্তা গ্রেফতার হলেও বাকিরা থেকে গেছেন পর্দার অন্তরালে। ডেসটিনি, শেয়ারবাজার ও হলমার্ক অর্থ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়নি। সেসব ঘটনা থেকেই প্রমাণ হয়, সরকার দুর্নীতিকে ‘সহ্য’ করছে। সরকার ও দুদকের কর্মকাণ্ড টিআই’র রিপোর্টকেই সমর্থন করে, যেখানে বলা হয়েছিল বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। দুর্নীতি দমনে সরকারের ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। সেই সঙ্গে মানবাধিকার হরণ ও মিডিয়া দলন ছিল সর্বকালের শীর্ষে। দুজন শীর্ষ সাংবাদিক সাগর ও রুনিকে রাতের আঁধারে খুন করা হলো। সাংবাদিকরা সারাবছর আন্দোলন করলেন, কিন্তু প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার করা হলো না। বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকাণ্ড ছিল গত বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তন এনেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধানের ঘটনা বছরজুড়ে আলোচিত হলেও সরকার ছিল নির্বিকার। একজন জনপ্রিয় নেতা এভাবে ‘অদৃশ্য’ হয়ে আছেন, আর রাষ্ট্র তাকে খুুঁজে পাবে না-এটা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় ব্যর্থতা। অতীতে কখনো এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।
ইলিয়াস আলীর পাশাপাশি ঢাকার ৫৬নং ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলামের হাতকড়া পড়া অবস্থায় পেঁয়াজ ক্ষেত থেকে লাশ পাওয়া গেল কুষ্টিয়ায়। অভিযোগ ছিল র‌্যাবের বিরুদ্ধে। কিন্তু র‌্যাব বলেছে, তারা তাকে অপহরণ করেনি। তাহলে কে করল? এটা বের করার দায়িত্বও তো র‌্যাবের। র‌্যাব যদি এটা বের করতে না পারে, তাহলে র‌্যাবের কর্মকাণ্ড প্রশ্নের মুখে থাকবে। বিদেশে র‌্যাবের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে-এটা যেন আমরা বিবেচনায় নেই। সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তন এনেছেন। উদ্দেশ্য একটাই, আস্থা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সেই আস্থা তো ফিরে আসেইনি; বরং আস্থায় ঘাটতি বেড়েছে। ১৭ জন সাংবাদিক হত্যা, ৩ সম্পাদককে গ্রেফতার, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে বর্তমানে সরকার গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর অত্যাচারের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এদিকে জ্বালানি তেলে ভর্তুকির নামে মূল্যবৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ালেও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। এ শীতেও প্রতিদিন একাধিকবার লোডশেডিং হচ্ছে। অতীতে কখনো শীতের সময় লোডেশেডিং হয়নি। তাহলে ভর্তুকির টাকা যাচ্ছে কোন পকেটে? প্রকৃত অর্থে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর টাকা চলে যাচ্ছে কিছু ব্যক্তির হাতে-যারা তথাকথিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনা করছেন। বর্তমানে দেশে মোট রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৩২। বেশিরভাগই ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল দিয়ে চালাতে হয়। সরকার এ খাতে ভর্তুকি দেয়। কোনো কোনো কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হলেও রাজনৈতিক বিশ্বে কোনো ভর্তুকি দিতে হয়নি। সেক্ষেত্রে ২০১১ সালে ভর্তুকি দিয়েছে ৬ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। আর ২০১২ সালে এ ভর্তুকির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার অঙ্ককেও ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। শুধু লুটপাটের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের কোনো উদ্যোগ গত এক বছরে পরিলক্ষিত হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ ছিল অসহায়। তাদের জিম্মি করে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি সুবিধা নিয়েছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ ছিল অসহায়। শীতের দিনেও শীতের সবজির দাম ছিল আকাশছোঁয়া। মধ্যস্বত্বভোগীরা কাঁচাবাজার থেকে প্রতিদিন ‘লুট’ করেছেন কোটি কোটি টাকা। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আদৌ কোনো উদ্যোগ নেয়নি; বরং সুবিধাভোগীদের উৎসাহ জুগিয়েছে। ওইসব সুবিধাভোগী প্রত্যক্ষভাবে সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে জড়িত।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ৭.৪১ ভাগ, সেখানে ২০১২ সালে তা দাঁড়ায় ১৩ ভাগে। একই সময় ২০০৯ সালে জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৬ দশমিক ১৯ ভাগ। আর ২০১২ সালে এ হার ছিল শতকরা ৬ দশমিক ৪২ ভাগ। জানুয়ারিতে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির হার যেমন বৃদ্ধি পায়, ঠিক তেমনি বৃদ্ধি পাবে জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির হারও। সরকারের এ সিদ্ধান্তে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কৃষকের। লিটারপ্রতি ৭ টাকা দাম বাড়ায় প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে গত বছরের চেয়ে প্রায় ১ টাকা বেশি হবে। বোরো উৎপাদনে প্রায় ৪১ শতাংশ খরচ হয় সেচ কোজে। ডিজেলের দাম বাড়ায় এ ব্যয় বেড়ে ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। অঙ্কের হিসাবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা কৃষকের পকেট কাটা যাবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনগণকে বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে অন্তত ৯০০ কোটি টাকা। এই তথ্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মতে। কর্পোরেশনের মতে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে ৩৫০ কোটি, আর কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎবিহীন অঞ্চলে জনগণকে বাড়তি গুনতে হবে অন্তত ৩১৬ কোটি টাকা (সকালের খবর, ৫ জানুয়ারি)। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন এ অঙ্ক আরো বেশি। আর তা যে জনজীবনের মূল্যস্ফীতিতে উসকে দেবে, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। সুতরাং যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে সরকারের দায়িত্বটি আসলে কী? শুধুই কি জনস্বার্থবিরোধী কর্মসূচি নেয়া? সংবিধান তো রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের এ দায়িত্বটি দেয়নি যে, তারা বারবার মূল্যবৃদ্ধি করে জনস্বার্থবিরোধী কর্মসূচি নেবে। জনস্বার্থে সরকারের কাজ করার কথা। কিন্তু সরকার সেই কাজটি করেনি। হলমার্ক, ডেসটিনি, পদ্মা সেতুর কেলেঙ্কারিতে যারা জড়িত, তাদের শাস্তি দেয়নি সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। দেশজুড়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হলেও তা বন্ধ করতে পারেনি সরকার। সারাদেশে একের পর এক ‘গুমে’র ঘটনা ঘটেছে, তা রোধ কিংবা এর পেছনের কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি সরকার। সাংবাদিক হত্যার রহস্যও উদ্ঘাটিত হয়নি। সব মিলিয়ে সরকার ব্যর্থ। তাই বিভিন্ন পত্রিকার জরিপে যখন প্রকাশ পায়, বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে (৫ জানুয়ারি), তখন সরকার এটা যদি উপলব্ধি করেন, তাহলে ভালো করবেন। তা না হলে দেশ একটি বড় ধরনের সঙ্কটে পড়বে। সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিবি) ত্রৈমাসিক নিউজ বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, দেশে সাম্প্রতিক সময়ের অবনতিশীল ও সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে। লাগাতার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাষ্ট্রের ব্যাপক আর্থিক অপচয়ও হচ্ছে। তাই রাষ্ট্রের যখন আর্থিক ক্ষতি হয়, তখন তা জনস্বার্থে প্রভাব পড়বেই। সবাইকে নিয়েই রাষ্ট্র। সরকার ও বিরোধী দল মিলেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি-যেখানে গণতন্ত্র চর্চাকে আমরা প্রাধান্য দিয়েছি। তাই সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। একটি সমঝোতায় যেতে হবে। আর এ সমঝোতা আমাদের স্বার্থেই হতে হবে।
Daily MANOBKONTH
27.01.13

0 comments:

Post a Comment