আমি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় মর্মাহত। প্রতিবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। ভিসির সকল অপকর্ম তদন্তের দাবি রাখে। তাকে ক্ষমতায় রেখে তদন্ত কাজ করা যাবে না। অবিলম্বে সেখানে একজন নয়া উপাচার্য নিয়োগ করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ও সে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অশান্ত হওয়ার পেছনে কাজ করছে ভিসিদের অদক্ষতা, দুর্নীতি, পারিবারিককরণ, দলবাজি আর গোষ্ঠীপ্রীতি। মিডিয়ায় রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অভিযোগ করেছিল, যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তারা অনেকেই পড়াতে পারেন না। এ ধরনের অভিযোগ আমি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুনেছি। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগ্যতা, মেধা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এর চেয়েও যা দুঃখজনক, তা হচ্ছে, ঢাকার বাইরে প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি হচ্ছে অনেকটা তার 'পৈতৃক' প্রতিষ্ঠান। যাকে খুশি তাকে তিনি নিয়োগ দিলেন। রোকেয়া, পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা এই কাজটি করেছেন। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তো তার মেয়ে, ভাই, ডজনখানেক আত্মীয়-স্বজন, সবাইকে 'চাকরি' দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় তো কোনো 'ফ্যাক্টরির' মতো সবাইকে চাকরি দেওয়ার জায়গা নয়। কেমন ভিসি জলিল সাহেব, যিনি নিজ প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিজের মেয়েকে চাকরি দিয়েছেন! শুধু তাই নয় বিধিবহির্ভূতভাবে 'নর্থ বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ' নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানটি আবার ৬টি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়া শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু উপাচার্য মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। আরও মজার ব্যাপার, এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক স্বয়ং ভিসি ও তার মেয়ে। ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসে ভিসি সাহেব সার্টিফিকেট দিচ্ছেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে। অতীতে কোনো ভিসি এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে মনে হয় না। এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাসে ভিসি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, আবদুল মতিন চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তারা ছিলেন এক একটা প্রতিষ্ঠান। আজ জলিল মিয়াদের মতো ভিসিদের কারণে ভিসি নামক প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের উপক্রম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও কম যান না। জোট সরকারের আমলে রাজশাহীতে আন্দোলন সংঘটিত করেছিলেন। ইউজিসি যখন রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছিল, তিনি চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, আমি যেন ওই তদন্ত কমিটিতে থাকি। অথচ সেই ভিসি সোবহান সাহেবই কি-না অভিযুক্ত হলেন ১৭৯ জন অতিরিক্ত কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিণত হয়েছে কর্মচারী নিয়োগের একটি জায়গা হিসেবে। অতীতেও এমনটি হয়েছে। এখনও হচ্ছে। এখানে আঞ্চলিকতা অনেক শক্তিশালী। ওই আঞ্চলিকতা শিক্ষক তথা কর্মচারী নিয়োগে প্রাধান্য পায়।
এ দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সংখ্যা ৩৪। ৩৪ জন ভিসি ও বেশ কয়েকজন প্রো-ভিসি রয়েছেন। ভিসিরা সরকার সমর্থকদের মধ্য থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা ভিসি হয়েছেন কী তাদের পরিচয়? ভিসি হওয়ার পর কতটুকু যোগ্যতা তারা রাখেন? অনেকের সম্পর্কেই খারাপ খবর পাচ্ছি। জাবির ভিসি মুক্তিযোদ্ধা। এ জন্য তিনি আলাদা সম্মান পেতেই পারেন। কিন্তু ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে তার একটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতি বয়কট করল 'বিশ্ববিদ্যালয় দিবস'। যতদিন থেকে 'বিশ্ববিদ্যালয় দিবস' পালন শুরু হয়েছে কোনো দিন এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এবার ঘটল। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটা ভিন্ন জায়গা। এখানে বিভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষক তথা কর্মচারীরা থাকেন। তাদের সবাইকে নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার। সবাইকে নিয়েই কাজ করা প্রয়োজন। ভিসি সাহেবরা দলীয় স্বার্থে, ব্যক্তিগত স্বার্থে, প্রায় ক্ষেত্রেই এসব সব সিদ্ধান্ত নেন, যা তাকে বিতর্কিত করে। দলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জায়গা বিশ্ববিদ্যালয় নয়। শুধু দল করলেই শিক্ষক হবেন, অফিসার হবেন, নিজ এলাকা তো কথাই নেই, চাকরি পাবেন। এই প্রবণতা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো কোনো সংবাদ নয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, ভিসি সাহেবরা প্রায় সবাই এ কাজটিই করছেন। তবে আমি নিঃসন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে ধন্যবাদ জানাব। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কম।
শিক্ষামন্ত্রীর জন্য আমার দুঃখ হয়। তিনি সজ্জন ব্যক্তি। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি অসহায়। গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন। তার অসহায়ত্ব আমি বুঝি। ভিসি সাহেবরা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ দেশে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যতের স্বার্থে ভিসিদের অগাধ ক্ষমতা, অনিয়ম, দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা দরকার। মঞ্জুরি কমিশনের কঠোর হওয়া প্রয়োজন। গত চার বছরে মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকাণ্ডে আমি হতাশ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দুর্নীতি তদন্তে মঞ্জুরি কমিশনের তদন্ত দল সেখানে গিয়েছিল। কিন্তু ফলাফল কী? আমরা একটা কথা ভুলে যাই_ বিশ্বব্যাংক থেকে উচ্চশিক্ষা খাতে আমরা ঋণ নিয়েছি। এই টাকা কীভাবে ব্যয় হচ্ছে তা বিশ্বব্যাংক ভবিষ্যতে তদন্ত করে দেখতে পারে। সুতরাং গবেষণায় স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি চার স্তরবিশিষ্ট একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে (লিখিত পরীক্ষা, পরীক্ষার ফলাফল, মৌলিক পরীক্ষা ও ডেমো) এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন। ইউজিসি এ ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করতে পারে। প্রয়োজনে পিএসসি মডেলে একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যার কাজ হবে শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করা। দ্বিতীয়ত, ভিসি নিয়োগে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা। ইউজিসির চেয়ারম্যান থাকবেন এই সার্চ কমিটির প্রধান। সিনিয়র শিক্ষাবিদরা এই কমিটির সদস্য হবেন। রোকেয়া ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থিতিশীলতা ও শিক্ষার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার স্বার্থে এটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
Daily SAMAKAL
15.01.13
0 comments:
Post a Comment