সংবিধানে কোনো ধরনের সংশোধনী ছাড়াই নির্বাচন আয়োজন করার পেছনে একটি ঐকমত্যে পেঁৗছানো সম্ভব। যেমন ৫টি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এক. প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে দু\'দলের ৫ জন করে সদস্য নিয়ে একটি সরকার, যাদের দায়িত্ব শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা। নিরপেক্ষতার স্বার্থে ওই ১০ সদস্যের কেউই নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অথবা দুই. স্পিকারের নেতৃত্বে দু\'দলের ৫ জন করে সদস্য নিয়ে একটি সরকার। উভয় ক্ষেত্রে তারা তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে বাধ্য থাকবেন এবং নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রেও স্পিকারসহ কেউই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। অথবা তিন. সাংবিধানিক অধিকারী (অর্থাৎ যারা শপথ নিয়েছেন) ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সরকার, যারা নিরপেক্ষতার স্বার্থে নির্বাচনের পরপরই দায়িত্ব থেকে অব্যাহিত নেবেন। অথবা চার. সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এক ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি সরকার, যেখানে সচিবরা সাময়িকভাবে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করবেন। অথবা পাঁচ. তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা আপিল বিভাগের তিন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি \'এলডার্স কাউন্সিল\', যারা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এ ৫টি বিকল্পের যে কোনো একটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে এর কোনো কিছুরই প্রয়োজন হতো না, যদি আমরা নির্বাচন প্রশ্নে একটি ঐকমত্যে পেঁৗছতে পারতাম। আমরা সেই ঐকমত্যে পেঁৗছতে পারিনি।
গণতন্ত্র আমাদের একটা কথা শিখিয়েছে। আর তা হচ্ছে, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন। সে সঙ্গে জনগণের প্রতি আস্থা রাখাটাও জরুরি। সরকার যদি জনগণের পক্ষে কাজ করে থাকে, তাহলে তাদের জনগণের আস্থা হারানোর কোনো ভয় নেই। সরকার এই জানুয়ারিতে চার বছর পার করেছে। সরকার একটা তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার সময়ের পরিস্থিতি, বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল আর আজকেইবা কেমন। সুশাসনের ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। সরকারের অর্জনগুলো ম্লান হয়ে গেছে অনেক ব্যর্থতার কারণে। এটা সত্য, বৈশ্বিক অর্থনীতির ঢেউ বাংলাদেশে তেমন একটা লাগেনি। নিঃসন্দেহে বলতে পারি, গ্রিস বা স্পেনের মতো পরিস্থিতি এ দেশে এখনও সৃষ্টি হয়নি। রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ভালো। প্রবৃদ্ধি একদম খারাপ নয়। কিন্তু শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি সরকারের ভাবমূর্তি দেশ-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ছাত্রলীগের ভূমিকা, ক্যাম্পাসগুলোতে ভিসিদের \'নিয়োগ বাণিজ্য\' একজন ক্লিন শিক্ষামন্ত্রীর ভূমিকাকে উজ্জ্বল করেনি। ইউজিসির ভূমিকাও এখানে চোখে লাগার মতো নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল শক্ত অবস্থানে যাওয়ার। কিন্তু সরকার যায়নি। কেন যায়নি_ সে প্রশ্ন ভিন্ন। সাত দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। অথচ বিদ্যুতের দাম বাড়ালে যে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে ব্যাপারে সরকার উদাসীন। এটা সরকারের সুশাসনে ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে জনসাধারণকেই সুযোগ দেওয়া উচিত তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের। গণতন্ত্রের এ মূল স্পিরিটটি আমাদের দেশে অনুপস্থিত।
চলতি ২০১৩ সালে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকলে ওই একটি ইস্যুতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে দরকার একটি সরকার, যাদের কাজ হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। এ ক্ষেত্রে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকারও হতে পারে। নামে কিছু যায়-আসে না। মূল বিষয়টি হচ্ছে, ওই সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রী একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন বটে; কিন্তু তার জট খোলেনি। কেননা, সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই একটি সরকারের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেই প্রস্তাবের গ্রহণযোগ্যতাও পায়নি। আমরা সবসময়ই একটা ভুল করি। আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কথা বলি; কিন্তু সবসময়ই পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আদলে আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বিনির্মাণ করতে চাই। আমাদের ভুলটা সেখানেই। পশ্চিমা সমাজ যেভাবে বিকশিত হয়েছে: সেখানকার সংস্কৃতি, শিক্ষা, সুশাসন, বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব_ সর্বোপরি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আজ তাদের এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সেখানে ভোট ডাকাতি, ভোট জালিয়াতি ব্যাপক অর্থে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অতীতে ফ্লোরিডার কেলেঙ্কারি সেখানকার নির্বাচন প্রক্রিয়াকে কালিমালিপ্ত করেছিল। তাই বলে একটি \'ফ্লোরিডা\'র ঘটনা নিয়ে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়নি। এমনকি আমরা ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্তরেও যেতে পারিনি। আমরা ইতিমধ্যে ৪১ বছর পার করে ফেলেছি। ভারতের নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী। আইন সেখানকার কমিশনকে অনেক শক্তিশালী করেছে; কিন্তু আমরা তা পারিনি। আমাদের সদিচ্ছার অভাব ছিল। অনেকেই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলেন। কিন্তু এখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। আমাদের সরকার অতীত ও বর্তমানে, কেউই সত্যিকারার্থে নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য বিগত নির্বাচন কমিশন সদস্যরা বারবার বিদেশে গেছেন। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা তারা কোথায়, কীভাবে ব্যবহার করেছেন, আমরা জানি না। কিন্তু রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা তাতে খরচ হয়েছে। সংবিধানে নির্বাচন কমিশনে সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।কিন্তু আমরা ভুলে যাই সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যায় না। আর্থিক ভিত্তি, জনবল ইত্যাদির জন্য নির্বাচন কমিশন সরকারের ওপর নির্ভরশীল। সরকারের প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর পড়ে। এমনি এক পরিস্থিতিতে একটি ফর্মুলার কথা বলেছেন ড. আকবর আলি খান। তার সঙ্গে আমরা দ্বিমত করতেই পারি; কিন্তু আলোচনা হতে ক্ষতি কী! বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করুক। এটা সংসদে উত্থাপিত হলে ভালো হয়, যাতে পুরো জাতি তা জানতে পারে। এতে আলোচনার একটা সূত্রপাত হতে পারে বলে আমার ধারণা। আমাদের প্রত্যাশা এটাই যে, সরকার নির্বাচন প্রশ্নে বিরোধী দলের সঙ্গে \'সংলাপ\' করুক। আমরা ২০১৩ সালকে একটি স্থিতিশীল বছর হিসেবে দেখতে চাই।
Daily SAMAKAL
08.01.13
0 comments:
Post a Comment