রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সরকারের কাজটি আসলে কী?


গত ৩ জানুয়ারি সরকার পঞ্চম দফা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর যে প্রশ্নটি খুব জোরে সোরেই উচ্চারণ করা যায়, তা হচ্ছে সরকারের কাজটি আসলে কী? আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির দৃষ্টান্ত দেখিয়ে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়াল। এটা আমরা শুনি। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম তো বিশ্বে কমেছে। এখন তো সরকারের দাম কমানোর কথা। অথ্চ এখন সরকার দাম বাড়ালো। তাই খুব সঙ্গত কারণেই গ্যাসের দামও বাড়বে। বিদ্যুৎ-এর দাম বাড়বে। সরকার যত যুক্তিই দিক না কেন, এটা অনেকটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। চলতি বছর নির্বাচনের বছর। সরকার বাধ্য করছে বিরোধী দলকে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দিতে। সরকারের কোনো সিদ্ধান্তই জনগণের পক্ষে যায়নি। কিংবা জনস্বার্থে করা হয়নি। বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লো। সরকারের মন্ত্রীরা বোকার মতো বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশের চাইতে আমাদের জ্বালানি তেলের দাম কম। কিন্তু মন্ত্রী সাহেবরা যে কথাটি বলেন না, তা হচ্ছে ভারতের সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আর আমাদের ক্রয় ক্ষমতা এক নয়। সেখানে মানুষের আয় বেশি, বেতন বেশি, ক্রয় ক্ষমতা অনেক বেশি। সেই আয়ের তুলনায় জিনিসপত্রের দাম খুব বেশি নয়। তারা তাদের আয় দিয়ে ভালোভাবে চলতে পারেন। এখন তাদের জ্বালানি তেলের দাম দিয়ে আমাদের জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ বা তুলনা করা যাবে না। আমাদের ক্রয় ক্ষমতা ভারতের সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার চাইতে অনেক কম। এখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়লো। তাতে করে সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে তা প্রভাব ফেলবে। পরিবহন খরচ বাড়বে। তাতে করে বেড়ে যাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। একজন মন্ত্রীর, একজন এমপির তাতে ক্ষতি না হওয়ারই কথা। ক্ষতি হয় আমাদের মতো আমজনতার, যাদেরকে নির্দিষ্ট আয়ে চলতে হয়। এতে করে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আরো কমে যায়।
সরকার চার বছর পার করলো গত ৫ জানুয়ারি। গেল বছর কোনো একটি ক্ষেত্রেও সরকারের সাফল্য নেই। বরং দুর্নীতিতে বাংলাদেশ একরকম ‘রেকর্ড’ করেছে। দুর্নীতির কারণ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। হলমার্ক, ডেসটিনি আর পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির রেকর্ড, দুর্নীতির সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে  সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা জড়িত। অথচ লোক দেখানো তদন্ত রিপোর্টে অত্যন্ত সুকৌশলে সরকারের কর্মকর্তাদের বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে। মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে উঠলেও, অভিযুক্ত সেই মন্ত্রীকে বাঁচিয়ে দিয়েছে দুদক। দু’জন কর্মকর্তা গ্রেফতার হলেও বাকিরা থেকে গেছেন পর্দার অন্তরালে। ডেসটিনি, শেয়ার বাজার ও হলমার্ক অর্থ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়নি। এইসব ঘটনা থেকেই প্রমাণ হয় সরকার দুর্নীতিকে ‘প্রমোট’ করছে। সরকার ও দুদকের কর্মকাণ্ডে টিআই’র রিপোর্টকেই সমর্থন করে, সেখানে বলা হয়েছিল বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। দুর্নীতি দমনে সরকারের ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। সেই সাথে মানবাধিকার হরণ ও মিডিয়া দলন ছিল সর্বকালের শীর্ষে। দু’জন শীর্ষ সাংবাদিক সাগর ও রুনিকে রাতের আঁধারে খুন করা হলো। সাংবাদিকরা সারা বছর আন্দোলন করলেন। কিন্তু প্রকৃত খুনীদের গ্রেফতার করা হলো না। বিশ্বজিৎ দাসের হত্যকাণ্ড ছিল গেল বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন এনেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধানের ঘটনা সারা বছর জুড়ে আলোচিত হলেও সরকার ছিলেন নির্বিকার। একজন জনপ্রিয় নেতা এভাবে ‘অদৃশ্য’ হয়ে যাবেন, আর রাষ্ট্র তাকে খুঁজে পাবে না, এটা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় ব্যর্থতা। অতীতে কখনো এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।
 পৃথিবীর কোনো দেশে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কোনো মহিলাকে গ্রেফতার করা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে। ১৭ জন সাংবাদিক হত্যা, ৩ সম্পাদককে গ্রেফতার, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে বর্তমান সরকার গণমাধ্যম কর্মীদের উপর অত্যাচারের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও বহির্বিশ্বে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে সরকার। একদিকে জ্বালানি তেলে ভর্তুকির নামে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ালেও, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। এই শীতেও প্রতিদিন একাধিকবার লোডশেডিং হচ্ছে। অতীতে কখনো শীতের সময়ে লোডশেডিং হয়নি। তাহলে ভর্তুকির টাকা যাচ্ছে কোন পকেটে? প্রকৃত অর্থে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর টাকা চলে যাচ্ছে কিছু ব্যক্তির হাতে, যারা তথাকথিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করছেন। বর্তমানে দেশে মোট রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ৩২। অধিকাংশই ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল দিয়ে চালাতে হয়। সরকার এ খাতে ভর্তুকি দেয়। কোনো কোনো কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় এদের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। যেখানে ২০০৬ সালে বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে কোনো ভর্তুকি দিতে হয়নি, সে ক্ষেত্রে ২০১১ সালে ভর্তুকি দিয়েছে ৬ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। আর ২০১২ সালে এই ভর্তুকির পরিমাণ ১০ হাজার টাকার অঙ্ককেও ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই রেন্টাল ও কুইক কেণ্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। শুধুমাত্র লুটপাটের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের কোনো উদ্যোগ গত এক বছরে পরিলক্ষিত হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ ছিল অসহায়। তাদেরকে জিম্মি করে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি সুবিধা নিয়েছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ ছিল অসহায়। শীতের দিনেও শীতের সবজির দাম ছিল আকাশছোঁয়া। মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা কাঁচাবাজার থেকে প্রতিদিন ‘লুট’ করেছেন কোটি কোটি টাকা। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আদৌ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং সুবিধাভোগীদের উৎসাহ যুগিয়েছে। এইসব সুবিধাভোগীরা প্রত্যক্ষভাবে সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠনের সাথে জড়িত। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ৭.৪১ ভাগ, সেখানে ২০১২ সালে তা দাঁড়ায় ১৩ ভাগে। একই সময় ২০০৯ সালে জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ১৯ ভাগ। আর ২০১২ সালে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৪২। জানুয়ারিতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি বছর দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির হার যেমনি বৃদ্ধি পাবে, ঠিক তেমনি বৃদ্ধি পাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হারও। সরকারের এই সিদ্ধান্তে, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কৃষকদের। লিটার প্রতি ৭ টাকা দাম বাড়ায় প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে গত বছরের চেয়ে প্রায় ১ টাকা বেশি হবে। বোরো উৎপাদন প্রায় ৪১ শতাংশ খরচ হয় সেচকাজে। ডিজেলের দাম বাড়াতে এ ব্যয় বেড়ে ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। অঙ্কের হিসেবে প্রায় ৮০ কোটি টাকা কৃষকের পকেট কাটা যাবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনগণকে বাড়তি ভাড়া গুণতে হবে অন্তত ৯০০ কোটি টাকা। এই তথ্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মতে। কর্পোরেশনের মতে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে ৩৫০ কোটি, আর কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎবিহীন অঞ্চলে জনগণকে বাড়তি গুণতে হবে অন্তত ৩১৬ কোটি টাকা (সকালের খবর, ৫ জানুয়ারি)। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন এ অঙ্ক আরো বেশি। আর তা যে জনজীবনকে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে, তা কাউকে বলে দিতে হয় না।
সুতরাং যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে সরকারের দায়িত্বটি আসলে কী? শুধুই কী জনস্বার্থ বিরোধী কর্মসূচি নেয়া? সংবিধান তো রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের এই দায়িত্বটি দেয়নি যে, তারা বারে বারে মূল্যবৃদ্ধি করে জনস্বার্থ বিরোধী কর্মসূচি নেবে। জনস্বার্থে সরকারের কাজ করার কথা। কিন্তু সরকার সেই কাজটি করেনি। হলমার্ক, ডেসটিনি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে যারা জড়িত, তাদের শাস্তি দেয়নি সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। সারা দেশ জুড়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হলেও তা বন্ধ করতে পারেনি সরকার। সারা দেশে একের পর এক ‘গুম’ এর ঘটনা ঘটেছে তা রোধ কিংবা এর পেছনের কারণ  উদঘাটন করতে পারেনি সরকার। সাংবাদিক হত্যার রহস্যও উদঘাটিত হয়নি। সব মিলিয়ে সরকার ছিল ব্যর্থ। তাই দৈনিক সমকালের জরিপে যখন প্রকাশ পায় বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে (৫ জানুয়ারি), তখন সরকার যদি এটা উপলব্ধি করেন, তাহলে ভালো করবেন।
11.1.13

0 comments:

Post a Comment