পৌর নির্বাচন নিয়ে যা 'ঘটল' মিডিয়ায় যা প্রকাশিত হয়েছে, কিংবা চ্যানেলগুলোতে যা সম্প্রচারিত হয়েছে তা সরকার কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টি যখন অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করে এবং ইসি ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করে তখন সরকারের গুরুত্ব দেয়া উচিত। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আমাদের সংবিধানের ১১ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে, 'প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।' আমরা বার বার সাংবিধানিক প্রাধান্যের কথা বলি। তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই ১১ নাম্বার অনুচ্ছেদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন একটি প্রশ্ন থাকবেই, পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ১১ নাম্বার ধারার মূল স্পিরিটটি কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে? আমরা যতই বলি ইসি স্বাধীন এবং সংবিধানে দোহাই দিই না কেন (১১৮-৪), বাস্তবতাই বলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। আমরা যে অর্থে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে তাদের 'অধিকারচর্চা' করতে দেখি আমাদের এখানে কাগজে-কলমেই তাদের 'স্বাধীন' সীমাবদ্ধ। ইসিকে অর্থের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফলে এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়। ইসি নিজে কোনো 'বাজেট' প্রণয়ন করতে পারে না। ইসির নিজের কোনো 'ক্যাডার' কর্মকা- নেই, যারা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিজেরা পরিচালনা করতে পারে। পৌর নির্বাচনে প্রায় ৭০ লাখ ভোটার ছিল। জড়িত ছিল কয়েক কোটি মানুষ। এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। সরকারের সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন ছিল আর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত হয়ে গেলে, তা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কেননা আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে 'দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা' ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমলারা ভালো পোস্টিং, সুযোগ-সুবিধা নেয়ার আশায় অনেকটা জ্ঞাতসারেই সরকারি দলের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। এ প্রবণতা খারাপ। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এ প্রবণতা অনেক বেশি বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এ 'প্রবণতা' বড় ধরনের প্রতিবন্ধক।
৫ জানুয়ারি (২০১৪)-পরবর্তী বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে তিনটি নির্বাচন হয়েছে। পাঁচ পর্যায়ে উপজেলা নির্বাচন, তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচন। তিনটি নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান আর সহিংসতা নির্বাচনী স্পিরিটকে ধ্বংস করেছে। এখানে সুস্থ নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হয়নি। অথচ নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই একজন প্রার্থী তার গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ পাবেন। কিন্তু জাল ভোট প্রদান করলে সে সুযোগটা আর থাকে না। এবং তা গণতন্ত্রের স্পিরিটকেও ধ্বংস করে। তাই আগামী একাদশতম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নূ্যনতম ইস্যুতে একটি ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন। না হলে দেশে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে এবং এ থেকে আমরা মুক্তি পাব না।
বিএনপির জন্য সুযোগ এসেছে মূলধারার রাজনীতিতে আরো সক্রিয় হওয়ার। বিএনপির টার্গেট থাকা উচিত ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচন। পৌর নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে, তার পরও বিএনপিকে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভাবতে হবে। দল গোছাতে হবে। কর্মীদের উজ্জীবিত করতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি কোনো সুবিধাই ঘরে তুলতে পারেনি। সরকার সব ক্ষেত্রে তার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে সংসদে বিএনপির অনুপস্থিতিতে। নির্বাচন বয়কটের পেছনে যুক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তাদের অনুপস্থিতিতে যে সুযোগটি তৈরি হয়েছে, আওয়ামী লীগ তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে। 'খালি মাঠে কোনো দলকেই গেল' করতে দেয়া উচিত নয় বিএনপির।
বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সে সংস্কৃতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। একটিকে বাদ দিয়ে যেমনি গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না, ঠিক তেমনি এ দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্কই অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের আশঙ্কাকে রোধ করতে পারে। তাই পৌর নির্বাচনটিকে গুরুত্বহীন ভাবলে আমাদের চলবে না। এ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সরকারের অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক না কেন, সরকার যে মাঠ পর্যায়ে এখন তার ক্ষমতার বলয় সম্প্রসারিত করতে পারল, এতে কারো দ্বিমত থাকা আর উচিত নয়। সরকারি দল যখন শত অভিযোগের পরও মাঠ পর্যায়ে তার ক্ষমতা সম্প্রসারিত করতে পারে, তখন সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন এখন অতীত। এ 'অতীত' নিয়ে আমরা যদি পরস্পরকে দোষারোপ করি, তাতে আমরা মূল লক্ষ্যে পেঁৗছাতে পারব না। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ দেশটিতে উন্নয়নের সুফল যদি প্রতিটি মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে চাই, তাহলে সব দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। পরস্পরকে দোষারোপ করে দেয়া বক্তব্য, আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার পথে প্রধান অন্তরাই নয়, বরং তা সহিংসতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
পৌরসভা নির্বাচন সবার জন্যই একটি পরীক্ষা। সরকার যদি 'জাল ভোট প্রদানের' সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারে, তা সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করবে বটে, কিন্তু তাতে করে সত্যিকার অর্থে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণ করা যাবে না। আর তা একটি বাজে মেসেজ পেঁৗছে দেবে গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে। আর পৌরসভা নির্বাচন, এর আগে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি সনাতন রাজনীতির ধারায় ফিরে এসেছে। সহিংস ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে যে সরকারকে উৎখাত করা যায় না, এটা প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং সরকার পরিবর্তনের একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন। সব দল এ লক্ষ্যে কাজ করবে, এ প্রত্যাশা এখন সবার। Daily Jai Jai Din 12.01.16
0 comments:
Post a Comment