রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আদৌ কি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে?

গত ৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঢাকায় একাধিক জনসভার আয়োজন করে। দুটি বড় দলই এ দিনটি পালন করেছে ভিন্নভাবে। যেখানে আওয়ামী লীগ এ দিনটি পালন করেছে 'গণতন্ত্রের বিজয়' দিবস উপলক্ষে, সেখানে বিএনপি এ দিনটি পালন করেছে 'গণতন্ত্র হত্যা' দিবস উপলক্ষে। কিন্তু ওইদিন বেগম জিয়া একটি 'সংলাপ' ও দ্রুত একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আহ্বান জানালেও আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা বেগম জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ফলে ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন সামনে রেখে এ দুটি বড় দলের মধ্যে যে বিভেদ, বিদ্বেষ আর আস্থাহীনতা, তা রয়ে গেল। এমনকি ৩০ ডিসেম্বর দেশে পৌরসভা নির্বাচন হয়ে গেছে। ওই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বিএনপি থাকলেও একটি ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান আর সহিংসতার মধ্য দিয়ে পৌরসভা নির্বাচনটি শেষ হয়েছে বটে, কিন্তু আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতির জন্য রেখে গেছে একটা বড় প্রশ্ন। এর মধ্য দিয়ে আগামী দিনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা, সে প্রশ্ন থাকলই। বিএনপি ইতোমধ্যে পৌর নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে। সংবাদপত্রগুলো ৩১ ডিসেম্বর বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের যে ছবি ছেপেছে তা একটি শুদ্ধ নির্বাচনের ধারণাকে সমর্থন করে না। কিন্তু তার পরও এ নির্বাচন অনেক 'সাফল্য' দাবি করতে পারে। এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। মিডিয়ার কারণে দুপুরের আগেই কোথাও কোথাও সহিংসতা, জাল ভোট প্রদান, ভোট কেন্দ্র দখলের খবর এলেও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের কথা বলেনি। বরং দুবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে তাদের 'প্রতিবাদ' লিপিবদ্ধ করেছে। এর মধ্য দিয়ে 'সব দলের অংশগ্রহণ' নিশ্চিত করে নির্বাচন কমিশন একটি বাহ্বা নিতেই পারে। নির্বাচনে নারীরা সেই সকালেই প্রায় প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এটা নিঃসন্দেহে একটা প্লাস পয়েন্ট। এবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কোনো খবর আমরা পাইনি। অথচ আমাদের অভিজ্ঞতা বলে অতীতে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগে ও পরে বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর লোকদের ওপর হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এবার তেমনটি হয়নি। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। এবারো বেসরকারি নির্বাচক পর্যবেক্ষকরা প্রায় সবাই পৌর নির্বাচনকে শতকরা একশভাগ শুদ্ধ হয়েছে বলে স্বীকার করেননি। তবে বলেছেন, তুলনামূলক বিচারে ভালো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে শতকরা ৭৩ ভাগ ভোট পড়েছে। এটা নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু ছোট ছোট 'ঘটনা' যেমনি বড় অর্জনকে মস্নান করে দেয়, ঠিক তেমনি পৌর নির্বাচন সম্পন্ন করতে ইসির সফলতার চেয়ে ইসির সীমাবদ্ধতাই বেশি ফুটে উঠেছে। এ নির্বাচনের পর এ প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে এ দেশে আগামীতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদৌ সম্ভব কিনা? ৫ জানুয়ারির (২০১৪) জাতীয় সংসদ (দশম) নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন (শেষের তিনটি) এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচন প্রমাণ করল নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেটা ছিল সংসদীয় রাজনীতির একটি 'কালো অধ্যায়'। তখন এর সঙ্গে যোগ হলো সাতজন মেয়রের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের খবর। এটা কোনো ভালো খবর নয়। ইসি এ ব্যাপারে আদৌ তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ ঘটনা ইসির ভূমিকাকে আবারো প্রশ্নবিদ্ধ করল। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতির এখতিয়ার বলে নিজ স্বাক্ষরে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিলেন। অন্যদিকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি আমলারা। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে রিটার্নিং তথা সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের ওপর যে এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক চাপ ছিল তা কি অস্বীকার করা যাবে?
পৌর নির্বাচন নিয়ে যা 'ঘটল' মিডিয়ায় যা প্রকাশিত হয়েছে, কিংবা চ্যানেলগুলোতে যা সম্প্রচারিত হয়েছে তা সরকার কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টি যখন অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করে এবং ইসি ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করে তখন সরকারের গুরুত্ব দেয়া উচিত। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আমাদের সংবিধানের ১১ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে, 'প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।' আমরা বার বার সাংবিধানিক প্রাধান্যের কথা বলি। তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই ১১ নাম্বার অনুচ্ছেদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন একটি প্রশ্ন থাকবেই, পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ১১ নাম্বার ধারার মূল স্পিরিটটি কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে? আমরা যতই বলি ইসি স্বাধীন এবং সংবিধানে দোহাই দিই না কেন (১১৮-৪), বাস্তবতাই বলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। আমরা যে অর্থে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে তাদের 'অধিকারচর্চা' করতে দেখি আমাদের এখানে কাগজে-কলমেই তাদের 'স্বাধীন' সীমাবদ্ধ। ইসিকে অর্থের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফলে এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়। ইসি নিজে কোনো 'বাজেট' প্রণয়ন করতে পারে না। ইসির নিজের কোনো 'ক্যাডার' কর্মকা- নেই, যারা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিজেরা পরিচালনা করতে পারে। পৌর নির্বাচনে প্রায় ৭০ লাখ ভোটার ছিল। জড়িত ছিল কয়েক কোটি মানুষ। এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। সরকারের সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন ছিল আর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত হয়ে গেলে, তা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কেননা আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে 'দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা' ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমলারা ভালো পোস্টিং, সুযোগ-সুবিধা নেয়ার আশায় অনেকটা জ্ঞাতসারেই সরকারি দলের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। এ প্রবণতা খারাপ। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এ প্রবণতা অনেক বেশি বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এ 'প্রবণতা' বড় ধরনের প্রতিবন্ধক।
৫ জানুয়ারি (২০১৪)-পরবর্তী বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে তিনটি নির্বাচন হয়েছে। পাঁচ পর্যায়ে উপজেলা নির্বাচন, তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচন। তিনটি নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান আর সহিংসতা নির্বাচনী স্পিরিটকে ধ্বংস করেছে। এখানে সুস্থ নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হয়নি। অথচ নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই একজন প্রার্থী তার গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ পাবেন। কিন্তু জাল ভোট প্রদান করলে সে সুযোগটা আর থাকে না। এবং তা গণতন্ত্রের স্পিরিটকেও ধ্বংস করে। তাই আগামী একাদশতম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নূ্যনতম ইস্যুতে একটি ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন। না হলে দেশে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে এবং এ থেকে আমরা মুক্তি পাব না।
বিএনপির জন্য সুযোগ এসেছে মূলধারার রাজনীতিতে আরো সক্রিয় হওয়ার। বিএনপির টার্গেট থাকা উচিত ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচন। পৌর নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে, তার পরও বিএনপিকে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভাবতে হবে। দল গোছাতে হবে। কর্মীদের উজ্জীবিত করতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি কোনো সুবিধাই ঘরে তুলতে পারেনি। সরকার সব ক্ষেত্রে তার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে সংসদে বিএনপির অনুপস্থিতিতে। নির্বাচন বয়কটের পেছনে যুক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তাদের অনুপস্থিতিতে যে সুযোগটি তৈরি হয়েছে, আওয়ামী লীগ তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে। 'খালি মাঠে কোনো দলকেই গেল' করতে দেয়া উচিত নয় বিএনপির।
বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সে সংস্কৃতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। একটিকে বাদ দিয়ে যেমনি গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না, ঠিক তেমনি এ দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্কই অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের আশঙ্কাকে রোধ করতে পারে। তাই পৌর নির্বাচনটিকে গুরুত্বহীন ভাবলে আমাদের চলবে না। এ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সরকারের অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক না কেন, সরকার যে মাঠ পর্যায়ে এখন তার ক্ষমতার বলয় সম্প্রসারিত করতে পারল, এতে কারো দ্বিমত থাকা আর উচিত নয়। সরকারি দল যখন শত অভিযোগের পরও মাঠ পর্যায়ে তার ক্ষমতা সম্প্রসারিত করতে পারে, তখন সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন এখন অতীত। এ 'অতীত' নিয়ে আমরা যদি পরস্পরকে দোষারোপ করি, তাতে আমরা মূল লক্ষ্যে পেঁৗছাতে পারব না। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ দেশটিতে উন্নয়নের সুফল যদি প্রতিটি মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে চাই, তাহলে সব দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। পরস্পরকে দোষারোপ করে দেয়া বক্তব্য, আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার পথে প্রধান অন্তরাই নয়, বরং তা সহিংসতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
পৌরসভা নির্বাচন সবার জন্যই একটি পরীক্ষা। সরকার যদি 'জাল ভোট প্রদানের' সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারে, তা সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করবে বটে, কিন্তু তাতে করে সত্যিকার অর্থে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণ করা যাবে না। আর তা একটি বাজে মেসেজ পেঁৗছে দেবে গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে। আর পৌরসভা নির্বাচন, এর আগে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি সনাতন রাজনীতির ধারায় ফিরে এসেছে। সহিংস ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে যে সরকারকে উৎখাত করা যায় না, এটা প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং সরকার পরিবর্তনের একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন। সব দল এ লক্ষ্যে কাজ করবে, এ প্রত্যাশা এখন সবার। Daily Jai Jai Din 12.01.16

0 comments:

Post a Comment