সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় একচিলতে আলো দেখা গিয়েছিল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তিনটি জনসভা করেছিল। জনসভা শেষ হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে। জনসভায় যেসব বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল, তা আশার সঞ্চার করেছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। বেগম খালেদা জিয়া ওইদিন গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করলেও আলোচনার মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যও ছিল অনেকটা ‘পজিটিভ’। তিনি ‘শান্তিপূর্ণ রাজনীতি’ এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশে নির্বাচন হলে, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। ওই নির্বাচনের জন্য একটি জীবনও হত্যার প্রয়োজন হবে না। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।’ সরকারি দল ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ আর বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করলেও কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। কোনো পটকা ফোটেনি। দুটি বড় দলই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনসভা করেছে। দুটি বড় দল ওইদিন শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করলেও গত ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় এই ‘মনোভাব’ কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে, তা প্রশ্নই রয়ে গেল। জনসভায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আবারও হতাশার জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহে খালেদা-তারেকের ষড়যন্ত্র ছিল।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘জিয়া অবৈধ রাষ্ট্রপতি, আর তার দলও অবৈধ।’ এ ধরনের বক্তব্য আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে কতটুকু সাহায্য করবে, সে প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে। গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ পৌর নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল এবং মিডিয়ায় যা প্রকাশিত হয়েছে কিংবা চ্যানেলগুলোতে যা সম্প্রচারিত হয়েছে, তা সরকার কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টি যখন অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করে এবং ইসি ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করে তখন সরকারের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আমাদের সংবিধানের ১১নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ আমরা বারবার সাংবিধানিক প্রাধান্যের কথা বলি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই ১১নং অনুচ্ছেদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন একটি প্রশ্ন থাকবেই পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ১১নং ধারার মূল স্পিরিটটি কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে? আমরা যতই বলি ইসি স্বাধীন এবং সংবিধানের দোহাই দিই না কেন (১১৮-৪), বাস্তবতাই বলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। আমরা যে অর্থে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে তাদের ‘অধিকার’ চর্চা করতে দেখি, আমাদের এখানে এটা কাগজ-কলমেই তাদের ‘স্বাধীনতা’ সীমাবদ্ধ। ইসিকে অর্থের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফলে এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়। ইসি নিজে কোনো ‘বাজেট’ প্রণয়ন করতে পারে না। ইসির নিজের কোনো ‘ক্যাডার কর্মকা-’ নেই, যারা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিজেরা পরিচালনা করতে পারে। পৌর নির্বাচনে প্রায় ৭০ লাখ ভোটার ছিল। জড়িত ছিল কয়েক কোটি মানুষ। এটা একটা বিশাল কর্মকা-। সরকারের সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন ছিল আর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত হয়ে গেলে, তা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কেননা আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা’ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ভালো পোস্টিং, সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার আশায় অনেকটা জ্ঞাতসারেই সরকারি দলের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। এই প্রবণতা খারাপ। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই প্রবণতা অনেক বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এই ‘প্রবণতা’ বড় ধরনের প্রতিবন্ধক।
৫ জানুয়ারি (২০১৪)-পরবর্তী বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে তিন তিনটি নির্বাচন হয়েছে। পাঁচ পর্যায়ে উপজেলা নির্বাচন, তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচন। তিনটি নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান আর সহিংসতা নির্বাচনী স্পিরিটকে ধ্বংস করেছে। এখানে সুস্থ নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হয়নি। অথচ ‘নির্বাচনী প্রতিযোগিতা’ হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই একজন প্রার্থী তার গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ পাবেন। কিন্তু জালভোট প্রদান করলে সেই সুযোগটা আর থাকে না। তা গণতন্ত্রের স্পিরিটকেও ধ্বংস করে। তাই আগামী একাদশতম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ইস্যুতে একটি ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন। না হলে দেশে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে এবং এ থেকে আমরা মুক্তি পাব না।
বিএনপির জন্য সুযোগ এসেছে মূল ধারার রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হওয়ার। বিএনপির টার্গেট থাকা উচিত ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচন। পৌর নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে, তারপরও বিএনপিকে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভাবতে হবে। দল গোছাতে হবে। কর্মীদের উজ্জীবিত করতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি কোনো সুবিধাই ঘরে তুলতে পারেনি। সরকার সর্বক্ষেত্রে তার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে সংসদে বিএনপির অনুপস্থিতিতে। নির্বাচন বয়কটের পেছনে যুক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তাদের অনুপস্থিতিতে যে সুযোগটি তৈরি হয়েছে, আওয়ামী লীগ তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে। নির্বাচনী মাঠে কোনো দল না থাকলে আওয়ামী লীগ ‘গোল’ করবে এটাই স্বাভাবিক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ‘ভুল’ করেছিল কিনা, তা আগামীতে ‘বিচার’ হবে। ইতিহাস একদিন নিশ্চয়ই তার মূল্যায়ন করবে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি নির্বাচন-পরবর্তী যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। আমাদের হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করে বৈকি! আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে বাকি আছে প্রায় ৩৬ মাস। সময়টা একেবারে কম নয়। তাই ন্যূনতম কতগুলো বিষয়ে আমাদের ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন। নির্বাচনই একমাত্র পথ, যার মাধ্যমেই সরকার পরিবর্তিত হতে হবে। বিএনপির এই উপলব্ধি নিশ্চয়ই ভালো লক্ষণ। কিন্তু নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ‘জালভোট’ আর ‘সিল মারার সংস্কৃতি’ থেকে আমরা যদি বেরিয়ে আসতে না পারি তা বহির্বিশ্বে আমাদের সম্মানই শুধু ক্ষুণœ করবে না, বরং ‘আস্থার সম্পর্ক’ গড়ে উঠতে সাহায্য করবে না।
আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন এখন অতীত। এই ‘অতীত’ নিয়ে আমরা যদি পরস্পরকে দোষারোপ করি, তাতে করে আমরা মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব না। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশটিতে উন্নয়নের সুফল যদি প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই, তাহলে সব দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। পরস্পরকে দোষারোপ করে দেওয়া বক্তব্য, আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার পথে প্রধান অন্তরায়ই নয়, বরং তা সহিংসতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। পৌরসভা নির্বাচন সবার জন্যই একটি শিক্ষা। সরকার যদি ‘জালভোট প্রদানের’ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারে, তা সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করবে বটে, কিন্তু তাতে করে সত্যিকার অর্থেই একটি সুস্থ নির্বাচনী সংস্কৃতি এ দেশ থেকে হারিয়ে যাবে। তাতে করে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব বলে আমার মনে হয় না। ২৩ ‘সিটের’ বিএনপির জনপ্রিয়তা কি বর্তমানে এ পর্যায়ে এসেছে? প্রশ্ন এখানেই। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস বলে অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এমনকি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপির ভোটপ্রাপ্তি ছিল শতকরা ৩৩ ভাগের ওপরে। সেই পরিসংখ্যানের সঙ্গে ‘২৩ সিট’-এর হিসাব মেলে না। একটি নির্বাচন হয়েছে। এটাকে ভালো বলা যাবে না। এই নির্বাচন এই অভিমতকে আরও শক্তিশালী করবে যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। আর ইসিও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তারপরও সব ‘ত্রুটি’কে ফেলে দিয়ে দুটি বড় দলের মধ্যে যদি একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য মঙ্গল। কিন্তু আমরা আবারও হতাশার মধ্যে পড়ে যাই, যখন দেখি সৈয়দ আশরাফের ‘শান্তিপূর্ণ রাজনীতি’ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যখন বলা হয় বিএনপি একটি অবৈধ দল। এটা সত্য উচ্চ আদালতের একটি অভিমত ছিল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের ব্যাপারে। উচ্চ আদালতের রায়ের সমালোচনা করা যায় না। এতে করে আদালত অবমাননা হতে পারে। কিন্তু বিএনপিকে একটি অবৈধ দল বলা যাবে কি? লাখ লাখ লোকের উপস্থিতি (৫ জানুয়ারি ২০১৬) কি প্রমাণ করে বিএনপি একটি অবৈধ দল! উপরন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে এই দলটির অবস্থান কি আমরা অস্বীকার করতে পারব? বিএনপি রাজনীতিতে ‘ভুল’ করতেই পারে! প্রতিটি রাজনৈতিক দলই ‘ভুল’ করে। আওয়ামী লীগও যে ‘ভুল’ করছে না, তাও বলা যাবে না! রাজনীতিতে ‘ভুল’ করলে তার জন্য মাসুল দিতে হয়। বিএনপি সেই মাসুুল দিচ্ছে এখন! কিন্তু বিএনপিকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যাবে না। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ইতোমধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ‘নানা অভিযোগ’ উঠেছে। কোনো কোনো মন্ত্রীর বক্তব্যে এমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সরকার হয়তো ‘নতুন এক বিএনপিকে’ দেখতে চায়, যেখানে নেতৃত্বে বেগম জিয়া ও তারেক রহমান থাকবেন না! এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা প্রমাণ করা যাবে না। কিন্তু বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমান বিএনপির নেতৃত্বে থাকবেন কিনাÑ এটা বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিষয়। সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য না করাই মঙ্গল। এতে করে বিভ্রান্তি বাড়তে পারে। সময়ই বলে দেবে এ দেশের রাজনীতিতে বিএনপির অবস্থান কী হবে! তবে বাস্তবতা হচ্ছে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির যে সম্ভাবনা ছিল, সেই সম্ভাবনা জাতীয় পার্টি পূরণ করতে পারেনি। সংসদে জাতীয় পার্টি আছে বটে, কিন্তু তাদের কর্মকা- সরকারি না বিরোধী দলে, তা আজ অবধি নিশ্চিত হয়নি। ফলে সংসদের বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে রয়ে গেছে প্রচ- এক ‘শূন্যতা’। গণতন্ত্রের স্বার্থেই প্রয়োজন একটি শক্তিশালী বিরোধী দল। বিএনপি এই ‘শূন্যতা’ পূরণ করতে পারে। কিন্তু বিএনপিকে অবৈধ দল হিসেবে আখ্যায়িত করলে আস্থার সম্পর্কটা আর থাকে না। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি দুটি বড় দল। এর বাইরে আরও দল রয়েছে, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। ফলে আস্থার সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলে গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে দুটি বড় দলসহ সব দলের মধ্যে বিরোধ যত দ্রুত কমিয়ে আনা যায়, ততই আমাদের সবার জন্য মঙ্গল।
Daily Amader Somoy
17.1.16
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment