রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কী বার্তা দিয়ে গেল কেসিসি নির্বাচন


খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত মঙ্গলবার। এই নির্বাচন নানা কারণে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, নির্বাচনটি যদি পূর্ণ সুষ্ঠু হতো, তাহলে সরকার তার জনসমর্থন বেড়েছে এটা প্রমাণ করতে পারত। দ্বিতীয়ত, দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তা প্রমাণ করা সহজ হতো। তৃতীয়ত, সামনে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। কেসিসি নির্বাচনের ফলাফল গাজীপুরে প্রভাব ফেলত। চতুর্থত, ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনকে বিতর্কহীন করতে নিঃসন্দেহে কেসিসি ও গাজীপুরের নির্বাচন একটা প্রভাব ফেলবে। পঞ্চমত, সরকার মনে করছে তাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মানুষ খুশি। তারাই পুনর্বার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাবে। ষষ্ঠত, বিদেশি বন্ধুদেরও সরকারের দেখানোর প্রয়োজন ছিল যে বিএনপি কেসিসি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং জাতীয় নির্বাচনেও বিএনপি অংশ নেবে। মোটামুটি এসব সমীকরণকে সামনে রেখেই সরকার কেসিসি নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। এখন কেসিসি নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর এর ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে।
একটি নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়েছে, এটা বোধকরি বলা যাবে না। ভোট কেন্দ্র দখল, প্রিসাইডিং অফিসারদের কোথাও কোথাও অসহায়ত্ব, সিল মারা সংস্কৃতি, পুনরায় ভোট গ্রহণের আহ্বান- নির্বাচনের এসব দৃশ্য আবার ফিরে এসেছে। তবে এ প্রবণতা যে ব্যাপক, তা বোধহয় বলা যাবে না। ভোটের ফলাফলের ব্যবধান বিশাল। আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এটা অবশ্য একদিক থেকে ভালো হয়েছে। খুলনায় মানুষ এখন কিছুটা হলেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখতে পাবেন। বিএনপি প্রার্থী যদি বিজয়ী হতেন(?) তাহলে হয়তো তাকে কোর্টের বারান্দাতেই থাকতে হতো কিছুটা সময়। এমনকি বরখাস্ত হওয়ার ঝুঁকিও ছিল! আমাদের অভিজ্ঞতা তো তা-ই বলে। এদিক থেকে অন্তত খুলনাবাসী আশ্বস্ত হতে পারেন এই ভেবে যে, তারা এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখতে পাবেন। খুলনা বিভাগীয় শহর হলেও সেখানে তেমন উন্নয়ন হয়নি বিগত বছরগুলোয়। খুলনা বরাবরই অবহেলিত ছিল। অথচ এ শহরের অনেক সম্ভাবনা ছিল। মংলা সমুদ্রবন্দর এখান থেকে কাছে হওয়ায় এ অঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। তৈরি পোশাক শিল্পও (আরএমজি) এখানে বিকশিত হতে পারত। তাও হয়নি। এ অঞ্চলের বেকার ও আধা বেকার জনশক্তিকে কাজে লাগানো যেতে পারত শিল্পায়নের মাধ্যমে। তাও হয়নি। এখন সরকারদলীয় প্রার্থী এখানে বিজয়ী হওয়ায় খুলনাবাসী নিশ্চয়ই এটা প্রত্যাশা করবেন যে, এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব হবে। নির্বাচিত মেয়র আবদুল খালেক নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন, মানুষ তার কাছ থেকে এখন অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। তিনি দলীয় বৃত্তের বাইরে থেকে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করবেন, এটাই মানুষের প্রত্যাশা।
নির্বাচন কেমন হয়েছে এটা আলোচনা করা অর্থহীন। কেননা ভোটের ব্যবধানটা অনেক বেশি। তবে প্রত্যাশিত নির্বাচন যে হয়নি, তা বলাই যায়। এর তো কোনো প্রয়োজন ছিল না। দুই বছরের একটি শিশুর ভোট দেয়া, ৪০টি কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্টকে ঢুকতে না দেয়া, ভোট কেন্দ্র দখল করে নৌকা মার্কায় সিল মারা, জাল ভোট, অনিয়মে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়ক ভূমিকা ইত্যাদি যে চিত্র আমরা কেসিসি নির্বাচনে দেখলাম, এটা নির্বাচন কমিশনকে ‘সন্তুষ্ট’ করলেও এই নির্বাচন একটা প্রশ্ন রেখে গেছে। আর সেটি হচ্ছে, নির্বাচনী সংস্কৃতির কি তাহলে ‘মৃত্যু’ হতে যাচ্ছে এ দেশে? ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’- নির্বাচনের এই যে সনাতন চিত্র, তা কি হারিয়ে গেল? কেন একটা দু’বছর বয়সের শিশুকে ভোট দিতে দেয়া হল? ভোট কেন্দ্রে যারা ছিলেন, তাদের দায়িত্বটা তাহলে পালিত হল কোথায়? এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা দেয়া উচিত ছিল।
৪০টি কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে না দেয়ার যে অভিযোগ, এর পেছনে সত্যতা কতটুকু? ইসি এরও একটা ব্যাখ্যা দিতে পারত? নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য যারা ছিলেন, তাদের ভূমিকাই বা কী? তারা কি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন? কোনো কোনো ভোট কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারার দৃশ্য তো টিভি ফুটেজে আমরা দেখেছি। এটা অস্বীকার করি কীভাবে? এর আদৌ প্রয়োজন ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা যথার্থ ছিল, এটাও বলতে পারছি না। বিএনপি তো নির্বাচনের আগেই দাবি তুলেছিল এদের প্রত্যাহারের। এটা যদি করা হতো, তাহলে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা আরও নিশ্চিত হতো। খুলনায় আবদুল খালেক নিঃসন্দেহে জনপ্রিয়। আমার ধারণা সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও তিনি জিততেন। তারপরও কেন এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটল? এ নির্বাচনও পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
কেসিসির নির্বাচন দিয়ে আমি জাতীয় নির্বাচনকে বিবেচনা করব না। তারপরও কথা থেকে যায়। এ নির্বাচন কতগুলো বিষয়কে সামনে নিয়ে আসবে এখন, যে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকেই। এক. দলীয় সরকারের অধীনে যখন ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তখন অতি উৎসাহী কর্মীরা এ ধরনের কর্মকাণ্ড করতে পারেন। সেক্ষেত্রে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখন সংবিধান যেভাবে আছে অর্থাৎ বর্তমান প্রধানন্ত্রীকে রেখে, যিনি দলীয় প্রধান, নির্বাচনটি হবে। একইসঙ্গে বর্তমানে যিনি সংসদ সদস্য, তাকে স্বপদে বহাল রেখেই তার এলাকায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে করে সংসদ সদস্য নিজে এবং তার সমর্থকরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করবেন। এটা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। বর্তমান সংসদ সদস্যকে রেখে নির্বাচন করলে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ‘নিরপেক্ষ’ থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যদিও বলা হচ্ছে, ওই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরাসরি নির্বাচন কমিশনের আওতায় থাকবেন। বাস্তব চিত্র হচ্ছে, তারা ওই সময় থাকবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। আর প্রশাসন থাকবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে। এদের পক্ষে কি তখন নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব? সবারই চাকরি হারানো, শাস্তি, বদলির ভয় থাকে।
একটি শক্ত নির্বাচন কমিশন আমরা এখনও গড়ে তুলতে পারিনি। আর বর্তমান সিইসিকে নিয়ে তো ‘বিতর্ক’ আছেই। তিনি যত ভালো ভালো কথাই বলুন না কেন, তার পক্ষে ‘নিরপেক্ষ’ থাকা সত্যিকার অর্থেই কষ্টকর। খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত। এর খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তারা তা পারল না। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন বলেন, ‘সেনাবাহিনী থাকলে খুলনায় এই দশা হতো না’, তখন তার এ কথাকে অস্বীকার করি কীভাবে? নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেনাবাহিনী মোতায়েন ছাড়া সুষ্ঠু ভোট প্রয়োগের সংস্কৃতি আমরা ফিরিয়ে আনব কীভাবে? সরকারি দলকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে’- এই মানসিকতা নিয়ে আমরা যদি আত্মতুষ্টিতে ভুগি, আমরা ভুল করব। গাজীপুরেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে আমি আশঙ্কা করছি। তাই সরকারের দায়িত্বটা এখানে বেশি।
আমার কাছে কেসিসি নির্বাচনের চেয়ে জাতীয় নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। সব দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের যে কথা বলা হচ্ছে, তার ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। বিএনপি এ নিশ্চয়তাটুকু চায়। দাতা দেশগুলোর প্রতিনিধিরাও এটা চায়। প্রায়ই তাদের প্রতিনিধিদের মুখ থেকে এ ধরনের কথা উচ্চারিত হয়। গত ১৫ মে জাতিসংঘের ঢাকায় নিযুক্ত আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পু এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এক শুনানিতে শেখ হাসিনার মানবিকতার যেমন প্রশংসা করা হয়েছে, তেমনি ওই শুনানিতে অংশ নেয়া জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছেন। গত ১৪ মে জেনেভায় এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয় (মানবজমিন, ১৬ মে ২০১৮)। এ ধরনের বক্তব্য এই প্রথম নয়, আগেও আমরা দেখেছি। বিএনপি বারবার বিদেশি দূতাবাসে যাচ্ছে। অভিযোগ করছে। তাদের অভিযোগের তালিকায় কেসিসি নির্বাচন যে যুক্ত হবে, তা বলাই বাহুল্য।
কেসিসি নির্বাচনের আয়োজন করে সরকার তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে বলে প্রমাণ করতে চাইলে তা কতটুকু সফল হবে, এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। বাস্তবতা হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপি এখনও একটি ফ্যাক্টর। দলটিকে কোনোমতেই বাদ দেয়া যাবে না। নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীও ছিলেন। কিন্তু মূল প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা থেকে তিনি ছিটকে পড়েছেন। এটাই বাস্তব চিত্র। জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিই ফ্যাক্টর। সুষ্ঠু রাজনীতির জন্য তাই এ দুটি বড় দলের মাঝে ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। কেসিসি নির্বাচনে আবারও প্রমাণিত হল এই ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ বড় ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি নিয়ে জাতীয় নির্বাচন কতটুকু সফল হবে, আমি বলতে পারব না। তবে বলতে পারি, সরকার যদি আবারও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তাতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে না। সরকার আরও একবার এ ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। কেসিসি নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির যে দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে, তা সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেনি। তাই আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। জাতীয় নির্বাচনের এখনও বাকি আছে সাত মাস। সময়টা একেবারে কম নয়। এখনও একটা ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া যায়। মনে রাখতে হবে, সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় জাতীয় নির্বাচন। আর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে সরকারের লাভটা সেখানেই। এখন কেসিসি নির্বাচন বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কী দলটি এই পথে হাঁটছে?
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Jugantor
19.05.2018

0 comments:

Post a Comment