রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি ও বিএনপির ভবিষ্যৎ

Image result for Begum Zia cartoon



রাজনীতিতে এই মুহূর্তে অন্যতম আলোচিত বিষয় হচ্ছে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির সম্ভাবনা। তবে খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নেবেন কি না সে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। প্যারোলে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সামনে আসে যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে ৬ এপ্রিল বললেন, প্যারোলের আবেদন হলে চিন্তা করবে সরকার। তবে তিনি এও জানিয়েছেন প্যারোলে মুক্তির জন্য সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে হবে। অনেকটা একই সুরে কথা বলেছেন তথ্যমন্ত্রী। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন আয়োজিত যুব সম্মেলন ২০১৯-এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে (৭ এপ্রিল) তিনি বললেন, আবেদন না করলে খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিবেচনা হবে। এর অর্থ পরিষ্কার খালেদা জিয়া যদি প্যারোলে মুক্তি পেতে চান, তাহলে তাকে আবেদন করতে হবে। কিন্তু তিনি কি তা করবেন? জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার শাস্তি হয়েছে। একই সঙ্গে ধর্মীয় উসকানি ও মানহানির দুটি মামলা চলমান। আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি মুক্তি পাবেন, সে সম্ভাবনা কম। খালেদা জিয়া অসুস্থ। অন্যের সাহায্য নিয়েই তাকে চলাফেরা করতে হয়। তিনি এখন বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য যদি তিনি আদেশ পেতে চান, তাহলে আইনের বিধান মতে তাকে আবেদন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আবেদন করলেই তিনি প্যারোলে মুক্তি পাবেন, তেমনটি নয়। এর সঙ্গেও একটি রাজনীতি আছে। অর্থাৎ তার মুক্তির বিষয়টির সঙ্গে রাজনীতির বিষয়টি জড়িত। তাহলে সেই রাজনীতিটি কী? বাজারে গুজব বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে যে ছয়জন নির্বাচিত হয়েছেন, তারা যদি সংসদে যোগ দেন। তাহলে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করবে সরকার। সবকিছু মিলিয়ে তাই নানা প্রশ্ন জনমানসে। যদিও বিএনপির নেতারা মনে করছেন প্যারোলে নয়। জামিন তার প্রাপ্য। ৭ এপ্রিল বিএনপির নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গণঅনশন করেছেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিকরাও গণঅনশনে অংশ নিয়েছেন। গণঅনশনে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলেছেন, খালেদা জিয়াকে তারা আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত করে ছাড়বেন।
অনেকগুলো প্রশ্ন এখানে আছে। খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি পাবেন কি না, তা নির্ভর করছে একান্তভাবেই তার ওপর। জিয়া পরিবার প্যারোলে মুক্তি চাচ্ছে, এখন কথাও হয়েছে। খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে। স্বাস্থ্য আর আগের মতো নেই। ছোট ছেলের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং রাজনীতি, বিশেষ করে বিএনপির আন্দোলনে ব্যর্থতা খালেদা জিয়াকে আরও বেশি হতাশাগ্রস্ত করে ফেলেছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। এটা বোধ করি, খালেদা জিয়া নিজেও উপলব্ধি করেন আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি হয়তো আর জামিন পাবেন না। এ ক্ষেত্রে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া তার জন্য মঙ্গল এই উপলব্ধিবোধ তার মাঝে আসতে পারে। তিনি বিদেশে বসে দলের নেতৃত্ব দেওয়া ও আন্দোলন সংগঠিত করাÑ এটাও তিনি চিন্তা করতে পারেন। আগে সুস্থতা নিশ্চিত করা, পরে রাজনীতি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব আর আজকের খালেদা জিয়াÑ এর মাঝে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তখন বয়স কম ছিল। দুটি বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যৌথ আন্দোলন করেছিল। আর আজ খালেদা জিয়া একা, সঙ্গে কোনো বড় দল নেই। উপরন্তু মাঝখানে চলে গেছে ২৯ বছর। বয়স বেড়েছে। হতাশা বেড়েছে। ব্যক্তি জীবনে বিপর্ষয় এসেছে বারবার। এটা ঠিক খালেদা জিয়া এখনও অবিসংবাদিত নেত্রী। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার বিকল্প খালেদা জিয়াই। কামাল হোসেন নন। বিএনপির একটি অংশ এবং ঐক্যফ্রন্টও চাইবে খালেদা জিয়া জেলে থাকুক। তাতে করে আন্দোলন করা সহজ। খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তিতে আন্দোলনে আর কোনো ‘ইস্যু’ থাকে না। তাই তো গণঅনশনে আমরা ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বক্তব্য দেখেছি তারা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে চান। এটা যে শুধু একটি সেøাগান, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। খালেদা জিয়া এক বছরের ওপরে জেলে আছেন। বিএনপি কিংবা ঐক্যফ্রন্ট আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেনি। কর্মীরা আন্দোলনের পক্ষে থাকলেও, বিএনপির নেতাদের আন্দোলনে দেখা যায় না। তারা বয়োবৃদ্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, আন্দোলনে তারা ব্যর্থ। তাই আন্দোলন নয়, বরং আইনি প্রক্রিয়াতেই খালেদা জিয়ার মুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। তাতেও তারা সফল হযনি। এই যখন পরিস্থিতি তখন বিএনপির নির্বাচিত ছয়জন সংসদ সদস্য এখন কী করবেন? সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান ইতোমধ্যে সংসদে যোগ দিয়েছেন। এখন বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যদি সংসদে যোগ না দেন, তাহলে সংসদে সদস্যপদ হারানোর ঝুঁকিতে তারা থাকবেন। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে তাদের সাংসদে যোগ দিতে হবেÑ না হলে তাদের সংসদ সদস্যপদ থাকবে না। তারা যদি যোগ না দেন (?), তাতে করেও আন্দোলনে কোনো গতি পাবে না। বরং সেখানে উপ-নির্বাচন হবে। সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দেওয়ার পেছনে যে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন, তাও বিবেচনায় নেওয়া যায়।
সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিতে পারবেন, কী পারবেন না, এই বিতর্কের আরও একটি দিক আছে। তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তার এলাকার জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে। এখন কি তিনি তার এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নটিই তুলে দিলেন সুলতান মনসুর। তিনি সংসদ তার এলাকার জনগণের কথা বলতে চান। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছেন। দলীয় শৃঙ্খলার কারণে সেই প্রতিনিধিত্বে বড় অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছিল। ৭০ অনুচ্ছেদের এটাই বড় সমস্যা। অনেকেই ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু এই অনুচ্ছেদ যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো সংসদ কেনা বেচার হাটে পরিণত হবে। টাকার বিনিময়ে সংসদ সদস্যরা বিক্রি হয়ে যেতে পারেন। দল ভাঙা ও নতুন দল গড়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হবে। যাদের হাতে টাকা আছে, তারা সাংসদদের ক্রয় করে সরকার গঠনে উদ্যোগী হবেন। এর মধ্য দিয়ে অস্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে পারে। গণতন্ত্রের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। তবে ৭০ অনুচ্ছেদকে আরও যুগোপযোগী করা যায়। যেমন ৭০ অনুচ্ছেদে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথাটা অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। না হলে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে পা দিয়েছে চলতি মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য ৪৮ বছর একেবারে কম সময় নয়। এই ৪৮ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। সামাজিক ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমরা ভারতের কাছ থেকেও এগিয়ে আছি। কিন্তু আমাদের একটা বড় বাস্তবায়ন হচ্ছেÑ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি অনেক। এই আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বটে। কিন্তু নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হলেও, নির্বাচনটি ছিল ত্রæটিযুক্ত। নির্বাচন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৮টি আসন পাওয়া অনেককেই অবাক করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রন্ট সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন দল তথা ফ্রন্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেই সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিলেন। আর মোকাব্বির খানও তাকে অনুসরণ করলেন। মোকাব্বির কিংবা সুলতান মনসুরের ভাগ্য এখন কীভাবে লিখিত হবে? তারা কী সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আগামী পাঁচ বছর থাকতে পারবেন? নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা এখন জনমনে। জাতীয় সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সদস্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বজায় ছিল। অষ্টম সংসদের শেষের দিকে তৎকালীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। আবু হেনার ক্ষেত্রেও তার সংসদ সদস্য পদ বহাল ছিল। সুলতান মনসুর ও মোকাব্বর খান এখন জানেন। আর জেনে শুনেই তারা সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন যতদূর জানি, সুলতান মনসুর নিজে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি সংস্কারবাদী হিসেবে নির্বাচিত ছিলেন। সংস্কারবাদী অনেক নেতাকেই আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুলতান মনসুরকে যদি ফিরিয়ে নেয় আমি অবাক হব না।
সুলতান মনসুর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সংসদে যোগ দিয়ে নৈতিকভাবে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চক্র বিএনপির ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়ে তিনি যদি এখন আবার তার নিজ দলে ফিরে যান, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সেটা হবে দুঃখজনক ঘটনা। রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের যে আস্থা থাকছে, এটা হবে তার একটা বড় দৃষ্টান্ত। মানুষ চায় রাজনীতিবিদরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দল বদল, সীমিত সুযোগের জন্য দল ত্যাগ কিংবা আবারও দলে ফিরে আসা কোনো ভালো খবর নয়।
রাজনীতি এই মুহূর্তে কেন্দ্রীভ‚ত খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে। খালেদা জিয়া কী সিদ্ধান্ত নেবেন, আমরা তা জানি না। এর সঙ্গে কোনো শর্ত থাকুক, আমরা তা চাই না। খালেদা জিয়ার সুস্থতা আমাদের কাম্য। তিন তিনবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি জাতীয় নেতা। তার সুস্থতা একদিকে, রাজনীতি অন্যদিকে। রাজনীতি তো মানুষের জন্যই। একজন গৃহবধূ থেকে তিনি রাজনীতিতে অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। বিএনপির তিনিই একমাত্র ভরসা। তার সুস্থতার জন্য যদি তাকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে যেতে (?) হয়। সেটাও তার নিজের জন্য ও দলের জন্যও মঙ্গল।
Daily Somoyer Alo
16.04.2019

0 comments:

Post a Comment