রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

দলীয় কলমে যোগদানপত্রে সই!


অস্ত্রবাজ একজন শিক্ষকের ছবি সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক! তিনি দশ মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন। অনলাইনে তার একটি ছবি ভাইরাল হয়ে গেছে। অস্ত্র হাতে তিনি নিশানা প্র্যাকটিস করছেন। স্থান ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের একটি জঙ্গলে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি, তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে সজীব হিসেবে, যিনি ইবি ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা। ঘটনাটা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের। ডেইলি স্টার (২৩ এপ্রিল ২০১৭) এবং যায়যায়দিন আমাদের জানাচ্ছে, এই শিক্ষকের নাম মতিয়ার। অনলাইন পত্রিকা বাংলা ট্রিবিউনে পরিসংখ্যান বিভাগের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসির বক্তব্য ছাপা হয়েছে। তাদের দু’জনের বক্তব্য মোটামুটি একই- মতিয়ার যেহেতু কোনো মামলায় ‘অভিযুক্ত’ হননি, সেক্ষেত্রে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে আইনগত কোনো বাধা নেই! সহকারী অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে নির্বাচনী বোর্ড হয়, তার সভাপতি থাকেন প্রো-ভিসি। মূলত মতিয়ারের নিয়োগে তিনিই সুপারিশ করেছেন এবং সিন্ডিকেট তা অনুমোদন করেছে। প্রশ্নটা একজন শিক্ষক ‘অভিযুক্ত’ হয়েছিলেন কিনা, তা নিয়ে নয়। প্রশ্নটা নৈতিকতার। হতে পারে বিভাগের সভাপতি কিংবা প্রো-ভিসি বিষয়টি জানতেন না। এখন তারা জেনেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারে। তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে। অভিযুক্ত ব্যক্তিটির কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারে।

বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে এ কারণে যে, এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। তিনি অস্ত্রের ট্রেনিং নিয়েছেন। ছবি তো সেকথাই বলে। তিনি একজন অস্ত্রবাজ। ক্যাডার। এখন এই মতিয়ার যখন ছাত্রদের পড়াবেন, তিনি কী মেসেজ দেবেন? তার ছাত্ররা কী শিখবে? একজন শিক্ষক তো ছাত্রদের কাছে ‘রোল মডেল’। ছাত্ররা একজন শিক্ষককে দেখে শেখে। তাকে অনুকরণ করে। তাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। অন্তত আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি তা-ই দেখেছি। এখন অস্ত্র হাতে ট্রেনিংরত অবস্থায় মতিয়ারের ছবি দেখে কি ছাত্ররা তাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে? ছাত্রদের মনে কি তার সম্পর্কে ঘৃণার জন্ম হবে না? সবচেয়ে বড় কথা, মতিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে গোটা জাতির কাছে ‘ছোট’ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে অনেক গুণী শিক্ষক ছিলেন এবং এখনও আছেন, যারা আমাদের সবার গর্বের। আমি তাদের সবার সঙ্গে মতিয়ারকে মেলাতে পারি না। আমাকে ক্ষমা করবেন মতিয়ার। আপনি পদত্যাগ করলে ভালো করবেন। অন্তত একটি কেলেঙ্কারি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষা পাবে। মতিয়ার, আমি বিশ্বাস করি আপনি অন্যত্র একটি চাকরি পাবেন। কেন আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও অসম্মানিত করবেন? একজন অস্ত্রবাজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার শিক্ষক হিসেবে নিশ্চয়ই দেখতে চাইবে না!

মতিয়ারের সংবাদটি যখন ছাপা হয়েছে, তখন আরও একটি তথ্য প্রকাশ পেয়েছে পত্রিকায়। একটি জনপ্রিয় দৈনিকের উপ-সম্পাদকীয় ছিল এরকম- ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে মীজানুর রহমান মডেল’ (২৭ এপ্রিল )। উপ-সম্পাদকীয়টি লিখেছেন সোহরাব হাসান। এর আগে ওই পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল। তাতে শিরোনাম ছিল ‘‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিশেষ কর্মকর্তা’ পদে ছাত্রলীগের ১২ জন।’’ উপাচার্যের বক্তব্যটি ছিল এরকম- ‘ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চাকরি দিতে আমি বাধ্য’। উপ-সম্পাদকীয়তে এটাকেই ‘মীজানুর রহমান মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সংবাদটি হচ্ছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি সম্প্রতি কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ১২ জন ছাত্রলীগ নেতাকে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য। যা বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে তা হচ্ছে উপাচার্যের ওই বক্তব্য। যদিও উপাচার্য মীজানুর রহমান পরে এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার আমলে তিনি জামায়াত-শিবিরের কাউকে নিয়োগ দেবেন না। মীজানুর রহমানকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। প্রায়ই টকশোতে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি যুবলীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। উপাচার্য হয়েও তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি উত্তর কুমিল্লা থেকে কাউন্সিলর হয়েছিলেন। কাউন্সিলর হিসেবে তার একটি ছবিও আমি তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছিলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। দ্বিতীয়বারের মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার আমলে অনেক নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে জগন্নাথে। এর কৃতিত্ব তিনি নিতেই পারেন। কিন্তু উপাচার্য হিসেবে তিনি জানেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানোগ্রামে ‘বিশেষ কর্মকর্তা’ হিসেবে কোনো পদ নেই। প্রতিটি পদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে অনুমোদন নিতে হয়। নতুন নতুন বিভাগ চালাতে শিক্ষকের পাশাপাশি স্টাফের দরকার। এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এ ধরনের নিয়োগে বিতর্ক বাড়ায়। কেন মীজানুর রহমান এই বিতর্কে নিজেকে জড়ালেন, আমি জানি না। প্রশাসক হিসেবে তিনি যোগ্য। কিন্তু বিতর্ক কেন? এমনিতেই শিক্ষক হিসেবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের নিয়েও নানা কথা আছে। তার নিজ দলের লোকেরাই তার বিরোধিতা করছেন। এটা তিনি জানেন। তিনি যদি মঞ্জুরি কমিশনের অনুমতি নিতেন, ভালো করতেন। যেহেতু নতুন নতুন বিভাগ হয়েছে, সুতরাং সেখানে স্টাফ নিয়োগ দিতে হবেই। কিছুদিন অপেক্ষা করতে হতো মাত্র। যে ১২ জনকে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, তারাই না-হয় নিয়োগ পেতেন! সেটাই ছিল মঙ্গলজনক। তিনি বিতর্ক এড়াতে পারতেন। আর যারা ‘বিশেষ কর্মকর্তা’ হিসেবে নিয়োগ পেলেন, তারাও বিতর্কিত হয়ে গেলেন! এ ধরনের সিদ্ধান্ত উপাচার্যের ভাবমূর্তি কতটুকু উজ্জ্বল করবে, আমি জানি না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় কিংবা বিভিন্ন উপ-সম্পাদকীয়তে তার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, আমি তাতে হতাশ হয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমার প্রিয় মানুষদের একজন। তার জন্য আমার দুঃখবোধ ছাড়া কিছুই আর থাকল না।

আসলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মকর্তা ও শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে যেসব সংবাদ পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, তাতে করে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে ইউজিসি প্রদত্ত ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক ২০১৩ ও ২০১৪’ প্রদান অনুষ্ঠানে বলেছেন, তার সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন। তিনি আরও বলেছেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা শিক্ষক তাদের লক্ষ্য রাখা উচিত ছেলেমেয়েরা কোথায় যাচ্ছে, তারা কী করছে, ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে কিনা, তা দেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে যাচ্ছে, সেদিকে দৃষ্টি দিতেই তিনি ওই কথাগুলো বলেছিলেন। এর আগে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের নজরদারিতে রাখা হবে বলে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল (যুগান্তর, ২৪ ফেব্রুয়ারি)। দুটো বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী চান শিক্ষার মানোন্নয়ন, আর আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি চায় অনুপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা। এই কাজটি কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো পালন করছে? একটি দৃষ্টান্ত দেই। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাহাঙ্গীরনগর) আমার বিভাগে একাধিক শিক্ষার্থীকে পাওয়া গেল, যারা নিয়মিত ক্লাস করে না। ইনকোর্স পরীক্ষা দেয় না। বিষয় সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। শুধু চূড়ান্ত পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দিয়ে চলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করা হলেও কর্তৃপক্ষ থাকল উদাসীন। সর্বশেষ ঘটনায় পাওয়া গেল একজন ছাত্রীকে, যে প্রথমবর্ষে একবার মাত্র ভর্তি হয়েছিল। তারপর আর ক্লাসে আসেনি। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওই ছাত্রী কি আদৌ কোনো জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কি সেই তথ্যটি আছে? বিষয়টি বিভাগীয় সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলেও কোনো ‘পদক্ষেপ’ নেয়া সমীচীন মনে করেনি কর্তৃপক্ষ! এর মধ্য দিয়ে কি আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্তকে একরকম চ্যালেঞ্জ করা হল না? তাই প্রশ্ন জাগে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাজটি তাহলে কী? প্রধানমন্ত্রী যে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন চান, তা তাহলে নিশ্চিত হবে কীভাবে? প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বিষয়টি তলিয়ে দেখুক।

শিক্ষার মানোন্নয়ন নয়, উপাচার্য মহোদয়রা চান শুধু শিক্ষক নিয়োগ! এসব শিক্ষক নিয়োগে মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন আছে কিনা, তা উপাচার্য মহোদয়রা দেখেন না। মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশকে উপেক্ষা করে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে ‘শিক্ষক’ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এটা কে দেখবে? দুদক একবার রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা নিয়োগ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছিল। ওই তদন্তের বর্তমান কী হাল, আমরা জানি না। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নতুন ওই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পারিবারিকীকরণ করেছিলেন। নিজের ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, সন্তানকে অবৈধভাবে সেখানে চাকরি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যও ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় থেকে টিএ/ডিএ উত্তোলন করেছিলেন। এ-সংক্রান্ত খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মেয়াদের শেষ সময়ে এসে তিনি বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগের উদ্যোগ নেন। এটা কোন পর্যায়ে আছে বলতে পারব না। প্রধানমন্ত্রীর দফতর সব বিষয়ে অনুসন্ধান করে কিনা, তাও আমার জানা নেই। কিন্তু একজন শিক্ষক হিসেবে আমি যা বুঝি তা হচ্ছে, ভালো শিক্ষক না হলে ভালো ছাত্র তৈরি হয় না। সিনিয়র শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মেধার ঘাটতি’ সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, উপাচার্যরা দলীয় কোটায় শিক্ষক নিয়োগ দিতেই ব্যস্ত! প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই পারিবারিকীকরণ হচ্ছে। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তার নিজ সন্তানকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিলেন। যিনি কোনোদিন মেধাবলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি, তিনি কিনা এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক! শুধু পারিবারিক কিংবা দলীয় ‘কোটায়’ কেন, এখন শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে টাকার বিনিময়েও! টিআইবি তদন্ত করেছিল, সুনির্দিষ্ট অভিযোগও এনেছিল। কিন্তু দুদক, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা মঞ্জুরি কমিশন- কেউ তদন্ত করেনি। তাই সিনিয়র সাংবাদিক সোহরাব হাসান এটাকে ‘মীজান ফর্মুলা’ বলেছেন। কিন্তু এই ‘ফর্মুলা’ তো সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যখন তার সন্তানকে শিক্ষক বানান, আমি তাতে অবাক হই না। কারণ তিনি একটি ‘ধারা’ অনুসরণ করেছেন মাত্র। গলদ তো সেখানেই!

প্রভাবশালীদের সন্তানরা এখন শিক্ষক হচ্ছেন, কর্মকর্তা হচ্ছেন। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য আমার কাছে নেই। শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তথ্য সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে (মানবকণ্ঠ, ১৩ এপ্রিল)। সেখানে বলা হয়েছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে, যারা সবাই প্রভাবশালীদের সন্তান। অপর একটি সংবাদ- পদ খালি নেই, তারপরও শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছে। এটিও জাহাঙ্গীরনগরের (সমকাল, ২২ মার্চ)। আমার নিজের বিভাগেই শিক্ষক এখন ১৮ জন। সব পদের বিপরীতে মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদনও নেই। টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ-সংক্রান্ত একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল (যায়যায়দিন, ২ এপ্রিল)। কিন্তু তারপরও এ ব্যাপারে মঞ্জুরি কমিশন কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু আমার মনে আছে, টিআইবির রিপোর্টের প্রতিবাদ করেছিল মঞ্জুরি কমিশন। অতি সম্প্রতি মঞ্জুরি কমিশনের একটি বিজ্ঞপ্তি আমার চোখে পড়েছে। কমিশন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, গণবিশ্ববিদ্যালয়ে (সাভার) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বিএড, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্র ভর্তির কোনো অনুমোদন নেই। ছাত্ররা যেন ওইসব বিভাগে ভর্তি না হয়। এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটাই কি শেষ? গণবিশ্ববিদ্যালয় যদি আইন ভঙ্গ করে থাকে, তাহলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হোক। আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে মঞ্জুরি কমিশন ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? তাহলে মঞ্জুরি কমিশন কি সত্যি সত্যিই কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল!

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা। শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার মান বৃদ্ধির কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। কিন্তু মান বৃদ্ধি হচ্ছে কই? এটা দেখবে কে? প্রধানমন্ত্রী এডুকেশন কাউন্সিল করার কথা বলেছেন। এই কাউন্সিলের কাজ কী হবে? শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো? তা যদি হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাব। শুধু অনুরোধ রাখব এই কাউন্সিলে যেন যোগ্য ও দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়া হয়। না হলে মঞ্জুরি কমিশনের মতো এটাও একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

একজন অস্ত্রবাজ শিক্ষককে দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। শেষ করতে চাই নয়াদিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ড. কবিতা এ শর্মার একটি বক্তব্য উল্লেখ করে। ঢাকায় তিনি এসেছিলেন বেসরকারি সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ষষ্ঠ সমাবর্তনে। তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনীতিকরণ উচ্চশিক্ষার মানের অবনতি ঘটাচ্ছে’ (সমকাল)। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। প্রধানমন্ত্রী চান শিক্ষার মানোন্নয়ন। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ, বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তানদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া- এসব আর যাই হোক, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটাবে না।
Daily Jugantor
06.05.2017

0 comments:

Post a Comment