রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিএনপির ভিশন ২০৩০ ও কিছু কথা


খালেদা জিয়া সম্প্রতি ভিশন ২০৩০ উপস্থাপন করেছেন। এটি বিএনপির একটি পরিকল্পনা, একটি রূপকল্প, যে রূপকল্প বিএনপি যদি ক্ষমতায় যেতে পারে, তাহলে বাস্তবায়ন করবে। একটি বড় দলের কাছ থেকে এ ধরনের পরিকল্পনা আশা করাই যায়। রূপকল্প বা ভিশন ২০৩০-এর অর্থ হচ্ছে, বিএনপি ২০৩০ সালকে টার্গেট করেছে। অর্থাৎ বিএনপি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করছে! একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির এই রূপকল্প ছিল। এটা নির্বাচনী ইশতেহার নয়। এটা বিএনপির একটি মহাপরিকল্পনা। বাংলাদেশকে বিএনপি কীভাবে দেখতে চায়, এই ভিশন ২০৩০-এ তা প্রতিফলিত হয়েছে। আওয়ামী লীগও এ ধরনের একটি মহাপরিকল্পনা দিয়েছিল। রূপকল্প ২০২১। সেই রূপকল্পেও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে ২০২১ সালে কীভাবে দেখতে চায়, তা জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিল। এ ধরনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যে কোনো বিবেচনায় প্রশংসার দাবি রাখে। তাই বিএনপি যখন ভিশন ২০৩০ উপস্থাপন করল, আমরা তাকে স্বাগত না জানিয়ে পারি না। বিএনপি বড় দল। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার দাবিদার। তাই ভিশন ২০৩০ নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। আমার বিবেচনায় ভিশন ২০৩০-এ অনেকগুলো ইতিবাচক দিক আছে। তবে কিছু কিছু নেতিবাচক দিক যে নেই, তা বলা যাবে না। আছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি সংসদের কথা বিবেচনায় নেওয়ার প্রস্তাব করেছে বিএনপি। সরাসরি প্রস্তাব করেননি খালেদা জিয়া। বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এটি কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়। এতে করে নানা জটিলতা তৈরি হবে। সংসদীয় এলাকায় কে প্রতিনিধিত্ব করবেন, তা নানা প্রশ্ন তৈরি করবে এবং দু’জন ‘সংসদ সদস্য’কে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হবে। এটা নিয়ে সুস্পষ্ট আইন থাকলেও ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে বাধ্য। অন্য যেসব দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ রয়েছে (ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি) তার সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহ্য মেলানো যাবে না। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। হতে পারে জনসংখ্যা বেশি। কিন্তু এই ছোট দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কাম্য নয়। খালেদা জিয়া যে যুক্তি দেখিয়েছেন, অর্থাৎ পেশাজীবীদের উচ্চকক্ষে স্থান দেওয়া, এটা তত্ত্বগতভাবে ভালো। কিন্তু এককক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় রাজনীতিতেও পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বিএনপি পেশাজীবীদের স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এতে করে সংসদীয় রাজনীতির মান আরও বাড়বে। বাংলাদেশে কোনো প্রদেশ নেই। জনসংখ্যার মাঝে জাতিগতভাবেও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ফলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব করারও কোনো প্রয়োজন নেই। তাই উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা একটি অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এতে করে সরকারি খাতের অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে চায় বিএনপি। ভিশন ২০৩০-এ আছে সে কথাও। কিন্তু এ ভারসাম্য কীভাবে আনা যাবে, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্ব নিশ্চিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অতি ক্ষমতাবান ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। এটা কীভাবে কমানো যায়, কীভাবে রাষ্ট্রপতিকে ‘বিন্দু’ ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য আনা যায়, তা যদি খালেদা জিয়া নিশ্চিত করতেন, তাতে করে সাধারণ মানুষ একটা স্পষ্ট ধারণা পেত। ভিশন ২০৩০-এ বলা হয়েছে, ‘অন্য কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করলে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। মুসলিম উম্মাহ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলবে বিএনপি।’ এই বক্তব্য অনেকটা সাদামাঠা বক্তব্য। বর্তমান সরকারও অনেকটা একই সুরে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। এ ক্ষেত্রে খুব একটা পার্থক্য নেই। খালেদা জিয়া বলেছেন, চীনের প্রস্তাবিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের সঙ্গে সংযুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই উদ্যোগ তো ইতোমধ্যে চীন নিয়েছে। এ নিয়ে মে মাসের মাঝামাঝি চীনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রীসহ একটি প্রতিনিধি দল যোগ দিয়েছে। চীনের সঙ্গে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যাপারে ভিশন ২০৩০-এ বিশেষ কিছু বলা নেই। সম্ভবত ভিশন ২০৩০-এ এটা একটা দুর্বল দিক। পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা নীতি এখানে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার যে ভিত্তি রচিত হয়েছে, সে ব্যাপারেও তেমন কোনো কথা নেই। তবে ভিশন ২০৩০-এ অনেক ভালো ভালো কথা আছে। খালেদা জিয়া ‘থ্রি-জি’, অর্থাৎ সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও সুসরকারের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে থ্রি-জির গুরুত্ব অনেক। এখন এই থ্রি-জিকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, বাংলাদেশে সুস্থ সরকার পরিচালনায় এই তিনটি সমস্যাই মূলÑ অর্থাৎ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, দুর্নীতি রোধ করা আর সুসরকার প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রেও যে প্রশ্নটি করা যায়, তা হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কীভাবে এটি করবে, তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। বিএনপির প্রস্তাবে সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা প্রবর্তন, সংসদে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি ও পাবলিক আন্ডারটেকিংস কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের পার্লামেন্টে এমনটি আছে। ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে নেওয়া হবে, এমন কথাও বলা হয়েছে। এমন নজিরও অন্যত্র আছে। আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পরিচালনার ভার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করা, ৩৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকায় বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা, দেশকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা, মাথাপিছু আয় ৫ হাজারে উন্নীত করাসহ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ডবল ডিজিটে উন্নীত করা, খাল খনন কর্মসূচি পুনরায় চালু করা, স্বাস্থ্যবীমা চালুসহ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি পুনঃপরীক্ষা ইত্যাদিসহ আরও বেশ কিছু প্রস্তাব রয়েছে ভিশন ২০৩০-এ। খালেদা জিয়া গ্রিন-এনার্জির কথা বলতে পারতেন। তা বলেননি। এমনকি সুন্দরবনের পাশে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে যে বিতর্ক, সে ব্যাপারেও খালেদা জিয়া কোনো মন্তব্য করেননি। আসলে ভিশন ২০৩০ নিয়ে মূল বিতর্ক কেন্দ্রীভূত এক জায়গায়Ñ আর তা হচ্ছে এটি এক ধরনের নির্বাচনী ইশতেহার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যে ভিশন ২০৩০ ব্যবহার করবে, এ ব্যাপারে দ্বিমত করার সুযোগ নেই।
অনেক কারণের জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচন প্রয়োজন। এ জন্য বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে হবে। আমার ধারণা বর্তমান সরকারও চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিক। পরপর দুটি নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ না নেয়, তাতে সরকারের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হবে না সত্য, কিন্তু বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি একটা প্রশ্নের মুখে থাকবে। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে। মামলার রায়ও হবে চলতি বছরে। এতে করে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার একটা প্রশ্ন আছে। খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে নাÑ এসব কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টি একান্তই আইনগত। তাই আদালতের কাছেই বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে আমরা যত কম কথা বলব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। তৃতীয়ত, জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলে, আবার সরকারে রেখে সরকার খুব লাভবান হয়েছে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে মেনে নেয়নি। বিএনপি সংসদে বিরোধী দলে থাকলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য দুটি বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধশিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফটপাওয়ার’ হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেন’-এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, এই অর্জন মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। এই প্রতিযোগিতা হতে হবে রাজনৈতিক ও কর্মসূচিভিত্তিক। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা এমনটি দেখতে পাই না। ভিশন ২০৩০ উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে, বলতে গেলে ওইদিন সন্ধ্যাবেলায়ই আমরা আওয়ামী লীগের নেতিবাচক মনোভাব পেয়েছি। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ভিশন ২০৩০ জাতির সঙ্গে তামাশা ও প্রতারণা। অনেক সিনিয়র মন্ত্রীও একই লাইনে কথা বলেছেন।’ এর প্রয়োজন ছিল না। বিএনপি একটি কর্মসূচি দিয়েছে। এর আগে আওয়ামী লীগও রূপকল্প ২০২১ দিয়েছিল। সব কর্মসূচিই যে ভালো তা বলা যাবে না। আওয়ামী লীগের রূপকল্পে যেমনি সীমাবদ্ধতা আছে, ঠিক তেমনি ভিশন ২০৩০-ও পূর্ণাঙ্গ নয়। তবে ভালো দিক হচ্ছে, দুটি বড় দলই তাদের পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে। আগামী নির্বাচনে এর একটি প্রতিফলন থাকবে। কোনটি ভাল, কোনটি খারাপÑ এভাবে সমালোচনা না করে বরং নির্দিষ্ট করে বলা উচিত দলগুলোর সীমাবদ্ধতা কোথায়। দুটি বড় দলই এখন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দিল। নিঃসন্দেহে এর ইতিবাচক দিক আছে।
Daily Amader Somoy
18.05.2017

0 comments:

Post a Comment