সম্প্রতি চীনের উদ্যোগে বেইজিংয়ে নতুন সিল্ক রুটখ্যাত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান
রোড’ কর্মসূচিসংক্রান্ত একটি শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। এ শীর্ষ সম্মেলনে ৩০
দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা যোগ দিয়েছিলেন। তাদের মাঝে ছিলেন রাশিয়ার
প্রেসিডেন্ট পুতিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও মধ্য এশিয়ার
সরকারপ্রধানরা। দক্ষিণ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের
সরকারপ্রধানরাও এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে
শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। তবে
ভারত এ সম্মেলনে যোগ দেয়নি। আন্তর্জাতিক আসরে চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’
(ওবিওআর) মহাপরিকল্পনা একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত
হলে বিশ্বের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে যাবে এবং বিশ্বে চীন অন্যতম
একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। অনেক কারণের জন্য ওবিওআরের গুরুত্ব রয়েছে
অনেক। প্রথমত, এ মহাপরিকল্পনার আওতায় চীনকে একদিকে মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকা
এবং অন্যদিকে ইউরোপের সঙ্গে সড়ক, রেলপথ ও সামুদ্রিক পথে সংযুক্ত করছে। ফলে
বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটা বড় পরিবর্তন আসবে। এর মধ্য দিয়ে বাণিজ্যে চীনের
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে- এটা সত্য। কিন্তু ওবিওআরের সঙ্গে সংযুক্ত
দেশগুলোও উপকৃত হবে। দ্বিতীয়ত, ৬০ থেকে ৬৫টি দেশ এ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’
কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। বিশ্বের অর্থনীতির তিন ভাগের এক ভাগ এর আওতায় আসবে।
বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক বসবাস করে এ অঞ্চলে এবং একই সঙ্গে বিশ্বে যে
জ্বালানি সম্পদের রিজার্ভ রয়েছে, তার মাঝে শতকরা ৭৫ ভাগ এ এলাকায় রয়েছে।
ফলে চীনের নেতৃত্বে ওবিওআর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক
এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা ভেঙে যাবে। তৃতীয়ত, ওবিওআর একটি মহাপরিকল্পনা।
এটা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের একটি বিশ্ব দর্শন। এতে প্রাথমিকভাবে ১
ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। ১৪-১৫ মে বেইজিংয়ে ওবিওআরের
যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, তাতে এ খাতে শি জিনপিং এক বিশাল অঙ্কের
অর্থ বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে বিশাল এক এলাকায় চীনা
অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এক নতুন ধরনের অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ
আমরা প্রত্যক্ষ করব একুশ শতকে। চীনা পণ্যের এক বিশাল বাজার গড়ে উঠবে
ওবিওআরভুক্ত দেশগুলোয়। চীনা বিনিয়োগ বাড়ার কারণে চীনের ওপর নির্ভলশীলতা
বাড়বে এসব দেশের। চতুর্থত, ওবিওআরভুক্ত দেশগুলো সুযোগ পাবে চীনের সঙ্গে
শুল্কমুক্ত এক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। চীনের সঙ্গে বর্তমানে ১২টি দেশের
‘ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট’ (এফটিএ) রয়েছে। এ দেশগুলো হচ্ছে সিঙ্গাপুর,
পাকিস্তান, চিলি, পেরু, কোস্টারিকা, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, হংকং ও
তাইওয়ান। আরও আটটি দেশের সঙ্গে এফটিএ নিয়ে আলোচনা চলছে। এ দেশগুলো হচ্ছে
জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, নরওয়ে ও কয়েকটি আঞ্চলিক সংস্থা।
বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ওবিওআর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেননি। কিন্তু সিনিয়র
মন্ত্রিপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব হয়েছে। বাংলাদেশ ওবিওআর কর্মসূচিকে
সমর্থন করছে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনা তৈরি হলো আগামীতে
চীনের সঙ্গে একটি এফটিএ করার। বলা ভালো, বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য চীনের
অনুকূলে। ফলে এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে এ থেকে বাংলাদেশ ফায়দা নিতে পারবে
ভবিষ্যতে। পঞ্চমত, প্রস্তাবিত ওবিওআরে মোট ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে।
প্রতিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে চীনের সংযুক্তি রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ওইসব
অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে চীন এগিয়ে আসবে। যেমন বলা যেতে পারে চীন-পাকিস্তান
অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) কথা। সিপিইসিতে প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ রাখা
হয়েছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ বিলিয়ন ডলার। এ
করিডোর চীনের খাসগরকে (জিয়াং জিয়াং প্রদেশ) পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের
গাওদার সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করেছে। এ করিডোর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত ‘আজাদ
কাশ্মীরের’ গিলগিট-বালটিস্তান হয়ে খাইবার পাখতুনখোয়া, পাঞ্জাব ও
বেলুচিন্তান প্রদেশের ভেতর দিয়ে গাওদারের সমুদ্রবন্দরে মিলিত হয়েছে। এ
অর্থনৈতিক করিডোরে সড়ক ও রেলপথ ছাড়াও গ্যাসের পাইপলাইন থাকবে।
চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ। চীন এ জ্বালানি সম্পদ নিয়ে যেতে চায় ইউনান প্রদেশে। এজন্যই চীন বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চলে সোনাদিয়ায় একটি গভীর বন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল, ভারতের আপত্তির কারণে যা সম্ভব হয়নি। এখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হওয়ায় মিয়ানমারে এটা নির্মিত হবে। অথবা মিয়ানমারের কোনো বন্দর ব্যবহার করে চীন ‘কানেকটেড’ হবে, যাতে গাওদার বন্দর ব্যবহার করে ইউনান প্রদেশে (কুনমিং যার রাজধানী) পণ্য নিয়ে যাওয়া যায় এবং একই পথ অনুসরণ করে চীনা পণ্য রফতানি করাও সম্ভব হবে। এতে সময় কম লাগবে এবং চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে। বাংলাদেশও এ থেকে উপকৃত হতে পারে। কেননা বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বিসিআইএমের (বাংলাদেশ-চীন, ইউনান প্রদেশ, ভারত ও মিয়ানমার) সদস্য। বিশ্বের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ এখানে বাস করে। বিশ্বের ৯ ভাগ এলাকা বিসিআইএমের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব জিডিপির ৭ দশমিক ৩ ভাগ এ অঞ্চলের। ভারত এবং বাংলাদেশ এ জোট থেকে লাভবান হতে পারে। কুনমিং থেকে কলকাতা পর্যন্ত বিসিআইএমের আওতায় সড়কপথ হবে। কুনমিং থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত সড়ক আছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক তৈরি করছে বাংলাদেশ। ভারতের সাতবোন রাজ্যগুলো কীভাবে বিসিআইএম করিডোর থেকে লাভবান হবে, তার একটি দৃষ্টান্ত দিই। সাতবোন রাজ্যের পণ্য কলকাতা সমুদ্রবন্দরে পৌঁছতে লাগে ৭ দিন। সেখান থেকে চীনের গন্তব্যে পৌঁছতে লাগে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ। এখন বিসিআইএম করিডোর ব্যবহার করে ভারত মাত্র ২ দিনে তার পণ্য ইউনান প্রদেশে পৌঁছে দিতে পারবে। এতে শতকরা ৩০ ভাগ খরচ কমে যাবে। ষষ্ঠ, ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এ আরও পাঁচটি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে। এ অর্থনৈতিক করিডোরগুলো ব্যবহার করে ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোও উপকৃত হবে। বিসিআইএম ও সিপিইসির বাইরে আরও যে চারটি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে চীন-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া-ইকোনমিক করিডোর, নিউ ইউরো এশিয়ান ব্রিজ, চীন-মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া অর্থনৈতিক করিডোর এবং চীন-ইন্দোচায়না পেনিনসুলা। লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে তার পার্শ¦বর্তী দেশগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে। আর এভাবেই চীন দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরো-এশিয়াসহ সুদূর ইউরোপের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত হবে। এটা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। একদিকে সড়কপথে যখন চীন সংযুক্ত হবে, তখন অন্যদিকেও ইউরোপ থেকে চীনের অন্য অঞ্চলে সমুদ্রপথে সংযুক্ত হবে। প্রথম ক্ষেত্রে (বেল্ট) চীনের জি’আন শহর থেকে সড়কপথে নেদারল্যান্ডসের রটারডাম পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। অপরদিকে রটারডাম থেকে ইতালির ভেনিস স্থলপথ এবং ভেনিস থেকে সমুদ্রপথে চীনের সমুদ্রবন্দর যুজউ পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ, যা চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু চীনের বর্তমান নেতৃত্ব এ অসাধ্য কাজটি হাতে নিয়েছে এবং দেশটি যখন ২০৪৯ সালে তার বিপ্লবের ১০০ বছরে পা দেবে, তখন এ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর মহাকর্মযজ্ঞ শেষ হবে।
পশ্চিমা গবেষকরা চীনের এ উদ্যোগকে চিহ্নিত করেছেন চীনের মার্শাল প্লান হিসেবে। পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ‘মার্শাল প্লান’ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। অনেকটা সে মডেলকে সামনে রেখেই চীন একুশ শতকে অবকাঠামো উন্নয়নে যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তাকেই অভিহিত করা হয়েছে ‘চীনের মার্শাল প্লান’ হিসেবে। এখন প্রশ্ন অনেকÑ এক, বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র চীনের এ মহাপরিকল্পনাকে কীভাবে দেখছে? কেননা আগামী ১০ বছরের মধ্যে চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হবে তখন দ্বিতীয়। চীনের এ অর্থনৈতিক আধিপত্যকে যুক্তরাষ্ট্র সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। দুই, উঠতি অর্থনীতির দেশ ভারত। ভারত চীনের এ উত্থানকে খুব ভালো চোখে দেখবে বলে মনে হয় না। তিন, ইউরোপের অবস্থান কী হবে? সম্প্রতি মে মাসে বেইজিংয়ে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। চীন প্রায় ১০০টির মতো দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তবে অনেক দেশই আসেনি। এমনিক যে ৬৮টি দেশ এই ওবিওআরে সংযুক্ত হবে, সেখান থেকেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব হয়নি। অনেক রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধান আসেননি। এর অর্থ পরিষ্কারÑ এ অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে চীনের ব্যাপারে এক ধরনের শঙ্কা আছে। ভারত সম্মেলনে যোগ দেয়নি। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। কেননা এটি বিতর্কিত গিলগিট-বালটিস্তানের ওপর দিয়ে গেছে, যা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ভারত মনে করে এটি তাদের। সম্মেলন শেষে যে ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ইউরোপের কোনো রাষ্ট্র স্বাক্ষর করেনি। তারা পরিশেষের সমস্যাটা বড় করে দেখছে। ফলে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর সাফল্য নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। ভারত-চীন দ্বন্দ্ব যদি আরও বেড়ে যায়, তাহলে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না। এক্ষেত্রে ছয়টি অর্থনৈতিক করিডোরের একটি বিসিআইএম করিডোর বিকশিত হবে না। ভারত মহাসাগরে দেশ দুইটি প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে। তবে এটা বলাই যায়, চীনের এ মহাপরিকল্পনা আগামীতে বারবার আলোচিত হতে থাকবেই। এখন যে অসন্তোষের জন্ম হয়েছে, তা নিরসনে চীন কী ভূমিকা নেয়, সে ব্যাপারেও লক্ষ থাকবে অনেকের।
Daily Alokito Bangladesh
21.05.2017
চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ। চীন এ জ্বালানি সম্পদ নিয়ে যেতে চায় ইউনান প্রদেশে। এজন্যই চীন বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চলে সোনাদিয়ায় একটি গভীর বন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল, ভারতের আপত্তির কারণে যা সম্ভব হয়নি। এখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হওয়ায় মিয়ানমারে এটা নির্মিত হবে। অথবা মিয়ানমারের কোনো বন্দর ব্যবহার করে চীন ‘কানেকটেড’ হবে, যাতে গাওদার বন্দর ব্যবহার করে ইউনান প্রদেশে (কুনমিং যার রাজধানী) পণ্য নিয়ে যাওয়া যায় এবং একই পথ অনুসরণ করে চীনা পণ্য রফতানি করাও সম্ভব হবে। এতে সময় কম লাগবে এবং চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে। বাংলাদেশও এ থেকে উপকৃত হতে পারে। কেননা বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বিসিআইএমের (বাংলাদেশ-চীন, ইউনান প্রদেশ, ভারত ও মিয়ানমার) সদস্য। বিশ্বের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ এখানে বাস করে। বিশ্বের ৯ ভাগ এলাকা বিসিআইএমের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব জিডিপির ৭ দশমিক ৩ ভাগ এ অঞ্চলের। ভারত এবং বাংলাদেশ এ জোট থেকে লাভবান হতে পারে। কুনমিং থেকে কলকাতা পর্যন্ত বিসিআইএমের আওতায় সড়কপথ হবে। কুনমিং থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত সড়ক আছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক তৈরি করছে বাংলাদেশ। ভারতের সাতবোন রাজ্যগুলো কীভাবে বিসিআইএম করিডোর থেকে লাভবান হবে, তার একটি দৃষ্টান্ত দিই। সাতবোন রাজ্যের পণ্য কলকাতা সমুদ্রবন্দরে পৌঁছতে লাগে ৭ দিন। সেখান থেকে চীনের গন্তব্যে পৌঁছতে লাগে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ। এখন বিসিআইএম করিডোর ব্যবহার করে ভারত মাত্র ২ দিনে তার পণ্য ইউনান প্রদেশে পৌঁছে দিতে পারবে। এতে শতকরা ৩০ ভাগ খরচ কমে যাবে। ষষ্ঠ, ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এ আরও পাঁচটি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে। এ অর্থনৈতিক করিডোরগুলো ব্যবহার করে ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোও উপকৃত হবে। বিসিআইএম ও সিপিইসির বাইরে আরও যে চারটি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে চীন-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া-ইকোনমিক করিডোর, নিউ ইউরো এশিয়ান ব্রিজ, চীন-মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া অর্থনৈতিক করিডোর এবং চীন-ইন্দোচায়না পেনিনসুলা। লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে তার পার্শ¦বর্তী দেশগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে। আর এভাবেই চীন দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরো-এশিয়াসহ সুদূর ইউরোপের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত হবে। এটা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। একদিকে সড়কপথে যখন চীন সংযুক্ত হবে, তখন অন্যদিকেও ইউরোপ থেকে চীনের অন্য অঞ্চলে সমুদ্রপথে সংযুক্ত হবে। প্রথম ক্ষেত্রে (বেল্ট) চীনের জি’আন শহর থেকে সড়কপথে নেদারল্যান্ডসের রটারডাম পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। অপরদিকে রটারডাম থেকে ইতালির ভেনিস স্থলপথ এবং ভেনিস থেকে সমুদ্রপথে চীনের সমুদ্রবন্দর যুজউ পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ, যা চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু চীনের বর্তমান নেতৃত্ব এ অসাধ্য কাজটি হাতে নিয়েছে এবং দেশটি যখন ২০৪৯ সালে তার বিপ্লবের ১০০ বছরে পা দেবে, তখন এ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর মহাকর্মযজ্ঞ শেষ হবে।
পশ্চিমা গবেষকরা চীনের এ উদ্যোগকে চিহ্নিত করেছেন চীনের মার্শাল প্লান হিসেবে। পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ‘মার্শাল প্লান’ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। অনেকটা সে মডেলকে সামনে রেখেই চীন একুশ শতকে অবকাঠামো উন্নয়নে যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তাকেই অভিহিত করা হয়েছে ‘চীনের মার্শাল প্লান’ হিসেবে। এখন প্রশ্ন অনেকÑ এক, বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র চীনের এ মহাপরিকল্পনাকে কীভাবে দেখছে? কেননা আগামী ১০ বছরের মধ্যে চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হবে তখন দ্বিতীয়। চীনের এ অর্থনৈতিক আধিপত্যকে যুক্তরাষ্ট্র সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। দুই, উঠতি অর্থনীতির দেশ ভারত। ভারত চীনের এ উত্থানকে খুব ভালো চোখে দেখবে বলে মনে হয় না। তিন, ইউরোপের অবস্থান কী হবে? সম্প্রতি মে মাসে বেইজিংয়ে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। চীন প্রায় ১০০টির মতো দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তবে অনেক দেশই আসেনি। এমনিক যে ৬৮টি দেশ এই ওবিওআরে সংযুক্ত হবে, সেখান থেকেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব হয়নি। অনেক রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধান আসেননি। এর অর্থ পরিষ্কারÑ এ অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে চীনের ব্যাপারে এক ধরনের শঙ্কা আছে। ভারত সম্মেলনে যোগ দেয়নি। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। কেননা এটি বিতর্কিত গিলগিট-বালটিস্তানের ওপর দিয়ে গেছে, যা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ভারত মনে করে এটি তাদের। সম্মেলন শেষে যে ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ইউরোপের কোনো রাষ্ট্র স্বাক্ষর করেনি। তারা পরিশেষের সমস্যাটা বড় করে দেখছে। ফলে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর সাফল্য নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। ভারত-চীন দ্বন্দ্ব যদি আরও বেড়ে যায়, তাহলে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না। এক্ষেত্রে ছয়টি অর্থনৈতিক করিডোরের একটি বিসিআইএম করিডোর বিকশিত হবে না। ভারত মহাসাগরে দেশ দুইটি প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে। তবে এটা বলাই যায়, চীনের এ মহাপরিকল্পনা আগামীতে বারবার আলোচিত হতে থাকবেই। এখন যে অসন্তোষের জন্ম হয়েছে, তা নিরসনে চীন কী ভূমিকা নেয়, সে ব্যাপারেও লক্ষ থাকবে অনেকের।
Daily Alokito Bangladesh
21.05.2017
0 comments:
Post a Comment