রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

চীন কি নতুন মডেলের ঔপনিবেশিক শক্তি হয়ে উঠবে?



চীন বিশ্বায়নের এক নতুন মডেল উপস্থাপন করেছে। চীনা অর্থ এখন আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে। এই অর্থ সেখানকার অবকাঠামো খাতে বড় পরিবর্তন আনছে। রেল যোগাযোগ, রাস্তাঘাট নির্মাণে চীনা অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি দৃষ্টান্ত দেই। বর্তমানে আফ্রিকাতে চীনা অর্থে এক হাজার প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীন সেখানে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২,২৩৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করছে। ৩,৩৫০ কিলোমিটার হাইওয়ে তৈরি করছে। প্রায় ৫৪টি আফ্রিকার দেশকে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত করছে। বছরে চীন ১৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে এসব দেশে। বলা হচ্ছে, প্রায় ১০ লাখ চীনা এখন আফ্রিকাতে বসবাস করেন। এত বিপুলসংখ্যক চীনা নাগরিকের উপস্থিতির কারণে সেখানে এক সঙ্কর জাতির জন্ম হয়েছে। বাবা চীনা, মা আফ্রিকান এ ধরনের সঙ্কর জাতি আফ্রিকান দেশগুলোয় বিকশিত হচ্ছে, যারা মূলত কৃষ্ণাঙ্গ হলেও বাবার চীনা নাম ও পদবি ব্যবহার করছে। চীনের এই ভূমিকাকে অনেকে এক ধরনের ‘চীনা উপনিবেশবাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। চীনের কাছে রয়েছে প্রচুর অর্থ। বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি এখন চীনের। এর পরিমাণ ১১,৩৯১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার (যুক্তরাষ্ট্রের ১৮,৫৬১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার)। কিন্তু ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে চীনের অবস্থান প্রথম, ২১,২৬৯ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার (আইএমএফ)। চীনের রিজার্ভের পরিমাণ ৩,৪০৫ বিলিয়ন ডলার। চীনের কাছে বিপুল অর্থ থাকায় তা এখন সর্বত্র বিনিয়োগ হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বেইজিং-এ ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে গেল। ২৮টি দেশের সরকারপ্রধানরা এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। এই মহাপরিকল্পনার আওতায় চীনকে একদিকে মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকা, অন্যদিকে ইউরোপের সঙ্গে সড়ক, রেলপথ ও সামুদ্রিক পথে সংযুক্ত করা হবে। এর ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটা বড় পরিবর্তন আসবে। এর মধ্য দিয়ে বাণিজ্যে চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা সত্য। কিন্তু ওবিওআর-এর সঙ্গে সংযুক্ত দেশগুলোও উপকৃত হবে। উল্লেখ্য, মোট ৬০ থেকে ৬৫টি দেশ এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। বিশ্বের অর্থনীতির তিন ভাগের এক ভাগ এর আওতায় আসবে। বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক বসবাস করে এই অঞ্চলে। এবং সেইসঙ্গে বিশ্বে যে জ্বালানি সম্পদের রিজার্ভ রয়েছে তার মাঝে শতকরা ৭৫ ভাগ এই এলাকায় রয়েছে। ফলে চীনের নেতৃত্বে ওবিওআর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে যাবে।

বলা ভালো, ওবিওআর একটি মহাপরিকল্পনা। এটা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর একটি বিশ্বদর্শন। এতে প্রাথমিকভাবে এক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। গেল ১৪-১৫ মে বেইজিং-এ ওবিওআর-এর যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, তাতে এ খাতে শি জিন পিং এক বিশাল অংকের অর্থ (প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডলার) বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে বিশাল এক এলাকায় চীনা অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এক নতুন ধরনের অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ আমরা প্রত্যক্ষ করব একুশ শতকে। চীনা পণ্যের এক বিশাল বাজার গড়ে উঠবে ওবিওআরভুক্ত দেশগুলোতে। চীনা বিনিয়োগ বাড়ার কারণে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে এসব দেশের। তখন ওবিওআরভুক্ত দেশগুলো সুযোগ পাবে চীনের সঙ্গে শুল্কমুক্ত এক বাজারব্যবস্থা গড়ে তুলতে। চীনের সঙ্গে বর্তমানে ১২টি দেশের ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ) রয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে- সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, চিলি, পেরু, কোস্টারিকা, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, হংকং ও তাইওয়ান। আরও ৮টি দেশ ও সংস্থার সঙ্গে এফটিএ নিয়ে আলোচনা চলছে। এই দেশগুলো হচ্ছে- জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা, নরওয়ে ও কয়েকটি আঞ্চলিক সংস্থা। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ওবিওআর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেননি। কিন্তু জুনিয়র মন্ত্রিপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব হয়েছে। বাংলাদেশ ওবিওআর কর্মসূচিকে সমর্থন করছে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনা তৈরি হল আগামীতে চীনের সঙ্গে একটি এফটিএ করার। বলা ভালো, বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য চীনের অনুকূলে। ফলে এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে এ থেকে বাংলাদেশ ফায়দা নিতে পারবে ভবিষ্যতে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রস্তাবিত ওবিওআর-এ মোট ৬টি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। প্রতিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে চীনের সংযুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে ওইসব অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে চীন এগিয়ে আসবে। যেমন বলা যেতে পারে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) কথা। সিপিইসিতে প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ বিলিয়ন ডলার। এই করিডোর চীনের খাসগরকে (জিয়াং জিয়াং প্রদেশ) পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাওদার সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এই করিডোর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত ‘আজাদ কাশ্মীরের’ গিলগিট-বালাটিস্তান হয়ে খাইবার পাখতুনখোয়া, পাঞ্জাব ও বেলুচিস্তান প্রদেশের ভেতর দিয়ে গাওদারের সমুদ্রবন্দরে মিলিত হয়েছে। এই অর্থনৈতিক করিডোরে সড়ক ও রেলপথ ছাড়াও গ্যাসের পাইপলাইন থাকবে। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ। চীন এই জ্বালানি সম্পদ নিয়ে যেতে চায় ইউনান প্রদেশে।

এ জন্যই চীন বাংলাদেশে কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চলে সোনাদিয়ায় একটি গভীর বন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। ভারতের আপত্তির কারণে যা সম্ভব হয়নি। এখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হওয়ায় মিয়ানমারে এটা নির্মিত হবে। অথবা মিয়ানমারের কোনো বন্দর ব্যবহার করে চীন ‘কানেকটেড’ হবে, যাতে করে গাওদার বন্দর ব্যবহার করে ইউনান প্রদেশের (কুনসিংযার রাজধানী) মধ্য নিয়ে যাওয়া যায় এবং একই পথ অনুসরণ করে চীনা পণ্য রফতানি করাও সম্ভব হয়। এতে সময় কম লাগবে এবং চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে। বাংলাদেশও এ থেকে উপকৃত হতে পারে। কেননা বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বিসিআইএমের (বাংলাদেশ-চীন-ইউনান প্রদেশ, ভারত ও মিয়ানমার) সদস্য। বিশ্বের জনগোষ্ঠীর ৪০ ভাগ মানুষ এখানে বাস করে। বিশ্বের ৯ ভাগ এলাকা বিসিআইএমের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব জিডিপির ৭ দশমিক ৩ ভাগ এই অঞ্চলের। ভারত এবং বাংলাদেশ এই জোট থেকে লাভবান হতে পারে। কুনমিং থেকে কলকাতা পর্যন্ত বিসিআইএমের আওতায় সড়কপথ হবে। কুনমিং থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত সড়ক আছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক তৈরি করছে বাংলাদেশ। ভারতের সাতবোন রাজ্যগুলো কীভাবে বিসিআইএম করিডোর থেকে লাভবান হবে, তার একটি দৃষ্টান্ত দেই। সাতবোন রাজ্যের পণ্য কলকাতা সমুদ্রবন্দরে পৌঁছতে লাগে ৭ দিন। সেখান থেকে চীনের গন্তব্যে পৌঁছতে লাগে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ। এখন বিসিআইএম করিডোর ব্যবহার করে ভারত মাত্র ২ দিনে তার পণ্য ইউনান প্রদেশে পৌঁছে দিতে পারবে। এতে শতকরা ৩০ ভাগ খরচ কমে যাবে। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এ আরও ৫টি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে। এই অর্থনৈতিক করিডোরগুলো ব্যবহার করে ইউরোপসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোও উপকৃত হবে। বিসিআইএম ও সিপিইসির বাইরে আরও যে ৪টি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে চীন-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া ইকোনমিক করিডোর, নিউ ইউরো এশিয়ান ব্রিজ, চীন মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া অর্থনৈতিক করিডোর এবং চীন-ইন্দোচায়না পেনিনসুলা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে। আর এভাবেই চীন দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরো-এশিয়াসহ সুদূর ইউরোপের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত হবে। এটা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। একদিকে সড়কপথে যখন চীন সংযুক্ত হবে, তখন অন্যদিকেও ইউরোপ থেকে চীনের অন্য অঞ্চল সমুদ্রপথে সংযুক্ত হবে।

প্রথম ক্ষেত্রে (বেল্ট) চীনের জি’আন শহর থেকে সড়কপথে হল্যান্ডের রটারডাম পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। অপরদিকে রটারডাম থেকে ইতালির ভেনিস স্থলপথ এবং ভেনিস থেকে সমুদ্রপথে চীনের সমুদ্রবন্দর ফুজউ পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ, যা চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু চীনের বর্তমান নেতৃত্ব এই অসাধ্য কাজটি হাতে নিয়েছে। এবং চীন যখন ২০৪৯ সালে তার বিজয়ের ১০০ বছরে পা দেবে, তখন এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের মহাকর্মযজ্ঞ শেষ হবে।

পশ্চিমা গবেষকরা চীনের এই উদ্যোগকে চিহ্নিত করেছেন চীনের মার্শাল প্ল্যান হিসেবে। পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র মার্শাল প্ল্যান নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। অনেকটা সেই মডেলকে সামনে রেখেই চীন একুশ শতকে অবকাঠামো উন্নয়নে যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তাকেই অভিহিত করা হয়েছে ‘চীনের মার্শাল প্ল্যান’ হিসেবে। এখন প্রশ্ন অনেকগুলো। বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই মহাপরিকল্পনাকে কীভাবে দেখছে? কেননা আগামী ১০ বছরের মধ্যে চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হবে তখন দ্বিতীয়। চীনের এই অর্থনৈতিক আধিপত্যকে যুক্তরাষ্ট্র সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। উঠতি অর্থনীতির দেশ ভারত। ভারত ও চীনের এই উত্থানকে খুব ভালো চোখে দেখবে বলে মনে হয় না। ইউরোপের অবস্থান কী হবে? বেইজিং-এ ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের শীর্ষ সম্মেলনে চীন প্রায় একশ’টির মতো দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তবে অনেক দেশই আসেনি। এমনকি যে ৬৮টি দেশ এই ওবিওআর-এ সংযুক্ত হবে, সেখান থেকেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব হয়নি। অনেক রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধান আসেননি। এর অর্থ পরিষ্কার- এই অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে চীনের ব্যাপারে এক ধরনের শঙ্কা আছে। ভারত সম্মেলনে যোগ দেয়নি। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। কেননা এটি বিতর্কিত গিলগিট-বালাটিস্তানের ওপর দিয়ে গেছে, যা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ভারত মনে করে এটি তাদের। সম্মেলন শেষে যে ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ইউরোপের কোনো রাষ্ট্র স্বাক্ষর করেনি। তারা পরিবেশের সমস্যাটা বড় করে দেখছে। ফলে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের সাফল্য নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। ভারত-চীন দ্বন্দ্ব যদি আরও বেড়ে যায়, তাহলে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না। এক্ষেত্রে ৬টি অর্থনৈতিক করিডরের একটি বিসিআইএম করিডর বিকশিত হবে না। ভারত মহাসাগরে দেশ দুটি প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হচ্ছে। তবে এটা বলাই যায়, চীনের এই মহাপরিকল্পনা আগামীতে বার বার আলোচিত হতে থাকবেই। তখন যে অসন্তোষের জন্ম হবে, তা নিরসনে চীন কী ভূমিকা নেয়, সে ব্যাপারেও লক্ষ থাকবে অনেকের। চীনের বর্তমান নেতৃত্ব বার বার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, ওবিওআরের মাধ্যমে চীন আগামীতে কোনো অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে না। কিন্তু চীনা অর্থনীতি যেভাবে বিকশিত হচ্ছে এবং চীনা পণ্য যেভাবে সারা বিশ্বের বাজার দখল করে রেখেছে, সেখানে চীনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আফ্রিকাতে চীনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সেখানকার জনগোষ্ঠীর মাঝে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আফ্রিকাতে চীনের এক ধরনের অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকাতেও চীনা প্রভাব বাড়ছে। সেখানে চীনা বিনিয়োগ বাড়ছে। চীনা বিশেষজ্ঞরা চীনের এই ভূমিকাকে চীনা বিশ্বায়ন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

এই চীনা বিশ্বায়ন কি এক ধরনের চীনা উপনিবেশবাদ তৈরি করবে বিশ্বে, যেমনটি এক সময় স্পেন, ব্রিটেন কিংবা ফ্রান্স করেছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। সিরিয়াস পাঠক মাত্রই জানেন, ১৬ শতক থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইউরোপীয় শক্তিগুলো বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগাল আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকাতে তাদের উপনিবেশ তৈরি করেছিল। দীর্ঘদিন তারা তাদের দখলদারিত্ব বজায় রেখেছিল। পরে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে কলোনিগুলো এক এক করে স্বাধীন হতে থাকে। বলাই বাহুল্য, উপনিবেশ তৈরি করার পেছনে বড় অর্থনৈতিক স্বার্থ কাজ করেছিল। একদিকে এশিয়া-আফ্রিকার কাঁচামাল তথা প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপারে উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোর আগ্রহ এবং পরবর্তী সময় ওইসব দেশে তৈরি তথা উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি করে উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো তাদের আধিপত্য বজায় রেখে আসছিল। উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো অতীতে কত টাকা লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে, এর অনেক তথ্য অনেক গবেষকের লেখায় আছে। আজ চীনের ভূমিকা কি তেমনি? ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বা ওবিওআর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পেছনে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ওবিওআর ৬টি অর্থনৈতিক করিডোর চীনকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করছে। আর মধ্য এশিয়ায় রয়েছে জ্বালানি সম্পদের বিশাল রিজার্ভ। বিশ্ব গ্যাস রিজার্ভের ৩২ দশমিক ৪ ভাগ রিজার্ভ রয়েছে ইউরো-এশিয়া তথা মধ্য এশিয়ায়। আর চীনের জ্বালানি ক্ষুধা রয়েছে, এটা সবাই জানে। একই কথা প্রযোজ্য আফ্রিকার ক্ষেত্রেও। সেখানে তেল রয়েছে (যেমন এঙ্গোলা, নাইজেরিয়া, জাম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা), সেখানে চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে। বাড়ছে চীনা নাগরিকদের উপস্থিতিও। যেমন এই মুহূর্তে দক্ষিণ আফ্রিকায় ২ লাখ, এঙ্গোলায় ৩০ হাজার, নাইজেরিয়ায় ৫০ হাজার ও জাম্বিয়ায় ৪০ হাজার চীনা নাগরিক বসবাস করেন। এর মধ্য দিয়ে চীন সেখানে এক নতুন উপনিবেশ তৈরি করছে। অর্থ এখানে একটি ফ্যাক্টর। চীনা তিনটি ব্যাংক এখন এসব দেশে বিশাল বিনিয়োগ করছে। চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ৯০০ প্রজেক্ট (৬০ দেশ)-এ নিয়োগ করেছে ৮৯০ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংক অব চায়নার বিনিয়োগের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন (২০১৬-২০১৮) ডলার। আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না ওবিওআর মহাপরিকল্পনায় বিনিয়োগ করেছে ১৫৯ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং বোঝাই যায় চীনা অর্থ কী ভূমিকা পালন করছে। তবে চীনা বংশোদ্ভূত ক্যালিফোনিয়ার সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড সি কং-এর মতে চীনের এই উত্থান নতুন কিছু নয়। তার মতে, China has been a hegemon and source of civili“ation for at least twenty centuries, its rise is not nwe (National Interest, may 23, 2017). এই মূল্যায়নের সঙ্গে হয়তো অনেকে একমত হবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্ব ব্যবস্থায় চীনের গুরুত্ব বাড়ছে। চীনের অর্থনৈতিক শক্তি, প্রযুক্তিগত মান চীনকে একুশ শতকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Jugantor
29.05.2017

1 comments:

  1. পশ্চিমা অাগ্রাসন কমাতে সহায়ক হবে প্র ক ল্প

    ReplyDelete