রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সমাধান কোন পথে

সর্বশেষ
দেশের দুই শেয়ারবাজারেই বেশিরভাগ কোম্পানির দাম ও সূচকের ঊর্ধ্বগতির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে আজকের লেনদেন
« পূর্ববর্তী সংবাদ

জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী পাস হওয়ার পর বিরোধী দল বিএনপি তথা চার দলের উদ্যোগে ৪৮ ঘণ্টার লাগাতার হরতাল পালিত হচ্ছে ৬ ও ৭ জুলাই। ইসলামী দলগুলোও ৩ জুলাই অর্ধদিবস হরতাল পালন করেছে। আগামী ১০ ও ১১ জুলাই তারা পালন করবে পূর্ণদিবস হরতাল। হঠাৎ করেই রাজনীতি অস্থির হয়ে উঠেছে। সংসদে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের কারণেই এই রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতা যে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনবে, তা অস্বীকার করার জো নেই।
এটা স্বীকার করতেই হবে যে সরকার খুব দ্রুততার সঙ্গে সংবিধান সংশোধন করেছে। এখানে একটা মৌলিক প্রশ্ন উঠেছে। আর তা হচ্ছে, উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো লেখা হয়নি। শুধু আংশিক রায় পাঠ করে (মূল বিষয়টি) সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। আর সেই আলোকেই এখন সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলো। আমরা যত দূর জানতে পেরেছি, সাত বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেননি। কোনো কোনো বিচারপতির দ্বিমত আছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে তাঁদের মতামত জানা যাবে। রায়টি হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে সরকার পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত। কিন্তু রায়ের মাত্র ৫১ দিনের মাথায় বিলুপ্ত করা হয়েছে ত্রয়োদশ সংশোধনী। ৪৬ দিনের মাথায় বাস্তবায়ন হয়েছে সপ্তম সংশোধনী মামলার রায়ও। আর পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় কার্যকর করতে সরকার এক বছর সময় নিয়েছিল। গত ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছেন। আর সপ্তম সংশোধনী মামলার রায় দেওয়া হয় গত ১৫ মে। দুটো মামলারই পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি।
স্পষ্টতই পঞ্চদশ সংশোধনীতে এমন বেশ কিছু বিষয় রয়েছে, যাতে মহাজোটের শরিক দলগুলোর মধ্যেও আপত্তি রয়েছে। যেমন 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম'_এটা রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে মহাজোটের শরিক বাম রাজনৈতিক দলগুলোর। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা, বিশেষ করে পরবর্তী দুটো সংসদ নির্বাচন (দশম ও একাদশ) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বাম দলগুলোর মৃদু প্রস্তাব ছিল। এর বাইরে চার মূলনীতি, বিশেষ করে, সমাজতন্ত্র বহাল রাখা (আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও এখন সমাজতন্ত্র নেই), মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক জোরদার ও সংরক্ষণ করার মূলনীতি বাদ দেওয়া, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা কিংবা অবৈধ ক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটা সমঝোতা প্রয়োজন ছিল, যা হয়নি। মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপিও বলেছেন সে কথা। এক সংবাদ সম্মেলনে (২ জুলাই) তিনি স্বীকার করেছেন, সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন ছিল। সমঝোতার কথা বলেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও। কিন্তু সমঝোতা কিভাবে হবে?
সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস এবং রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটা এখন সংবিধানের অংশ। এর বিরোধিতা করা যায় না। সংবিধান মেনেই রাজনীতি করতে হয়। বিএনপি তথা চার দল যতবারই হরতাল ডাকুক না কেন, এতে জনগণের দুর্ভোগ বাড়বে, কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হবে_এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। একটি সমঝোতার কথা বলেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেছেন 'অন্তর্বর্তী সরকারের' কথা। তিনি বলার চেষ্টা করেছেন বর্তমান সরকারের শেষ ৯০ দিন হবে অন্তর্বর্তী সরকার। এই ফর্মুলাও গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা ওই ৯০ দিন তো আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারই ক্ষমতায় থাকবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় তারা প্রভাব খাটাবে না_এর গ্যারান্টি কে দেবে? দলীয়ভাবে নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয় না, এর প্রমাণ শুধু মাগুরা উপনির্বাচনেই (১৯৯৪) আমরা পাইনি, বরং ভোলার উপনির্বাচনেও (২০১০) প্রমাণ পেয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা, ইউপি নির্বাচনও পুরোপুরি সুষ্ঠু হয়নি, এখানে সহিংস ঘটনা ঘটেছে এবং সরকারি দলের প্রভাব লক্ষ করা গেছে। আমাদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি। গণতন্ত্রকে আমরা শক্তিশালী করতে চাচ্ছি বটে, কিন্তু সেই গণতন্ত্রকে আমরা দেখছি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির দৃষ্টিতে। দল ও দলের আদর্শের ঊধর্ে্ব আমরা উঠতে পারিনি। তাই সংবিধান সংশোধনীর প্রশ্ন যখন এল, তখন সরকারি দল তাদের দলীয় স্বার্থের ঊধর্ে্ব উঠতে পারল না।
সত্যিকার অর্থেই সমঝোতার প্রশ্নটি এখন কঠিন। কেননা দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান এখন পরস্পরবিরোধী। কেউ কাউকে এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। অতীত থেকে আমরা এতটুকুও শিক্ষা নিইনি। দেয়ালের লিখন থেকেও আমরা এতটুকু শিখিনি। যাঁরা সরকারে থাকেন, তাঁদের কিছুটা সহনশীল হতে হয়। বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হয়। গণতন্ত্রের এই স্পিরিট আমাদের দেশে কার্যকর হচ্ছে না। তাই অবশ্যম্ভাবীভাবে ফিরে আসছে ২০০৬ সালের অক্টোবরের সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি(?)। আজ আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে না পারেন, তাহলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। তাই একটা সমঝোতা জরুরি।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে সামনে রেখেও এই সমঝোতা সম্ভব। এক. দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয়ভাবে হবে না। নির্বাচন পরিচালনা করবে একটি নিরপেক্ষ কাউন্সিল। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এই নিরপেক্ষ কাউন্সিল গঠিত হবে। বিকল্প হিসেবে সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির (সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি নন) নেতৃত্বে একটি 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠিত হতে পারে, যাঁরা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এই 'এলডার্স কাউন্সিল' তিন অথবা পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট হতে পারে। দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিরাই এই কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্ত হবেন। এ সংক্রান্ত একটি বিল সংসদে উপস্থাপিত হতে পারে। শরিক দলের কোনো সদস্য এই বিল উপস্থাপন করতে পারেন। সরকার এই প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে পারে। এতে করে সরকারের সৎ উদ্দেশ্য প্রমাণিত হবে। কিংবা বিরোধী দল হিসেবে সংসদে উপস্থিত এলডিপি সদস্য কর্নেল অলি আহমেদও এ ধরনের একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারেন। দুই. স্পিকার স্ব-উদ্যোগে দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনার একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি সরাসরি বিএনপির সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারেন। এতে বরফ গলতে পারে। তিন. রাষ্ট্রপতি নিজেও একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। সাংবিধানিকভাবে তাঁর কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু তিনি তো জাতির অভিভাবক। সংকট মুহূর্তে তাঁর একটি নিরপেক্ষ ভূমিকা জাতি আশা করতেই পারে। আমার বিশ্বাস, এর যেকোনো একটি সমঝোতার দুয়ার খুলে দিতে পারে।
আমি সরকারের ভূমিকাকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাই। সরকারকে অবশ্যই নমনীয় হতে হবে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সব কিছু সম্পন্ন করা ঠিক নয়। অতীত অভিজ্ঞতা বলে কেউ কখনো জোর করে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাস অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। এরশাদ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন বটে; কিন্তু গণ-অসন্তোষ তাঁকে ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। বেগম জিয়া ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অথচ প্রথমদিকে তিনি রাজি ছিলেন না। পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করেছিল। সেদিন শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ব্যাপারে ছিলেন সোচ্চার। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস! যিনি এক দিন নিজেকে দাবি করতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তক হিসেবে, তিনি নিজে এখন এই ব্যবস্থার বিরোধী। শেখ হাসিনা যদি আজ বিরোধী দলে থাকতেন, তিনি কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবসান চাইতেন? এটা একটা মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
সংসদে সরকারের 'ব্রুট মেজরিটি' রয়েছে। এই ব্রুট মেজরিটি অনেক সময় দলের জন্য মঙ্গলের পরিবর্তে অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে। ব্রুট মেজরিটির কারণে সরকার যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে না। পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে বলেই আমার ধারণা। সরকারের যদি ব্রুট মেজরিটি না থাকত, তাহলে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে দুইবার চিন্তা করত। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এখন একটা বাস্তবতা। ভালো হয়েছে, কি মন্দ হয়েছে, এই বিতর্কে না গিয়ে, জটিলতা না বাড়িয়ে বিরোধী দলের সহযোগিতা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়_এটাই বড় প্রশ্ন এখন। হার্ডলাইনে গিয়ে সমস্যার যেমনি কোনো সমাধান করা যায় না, ঠিক তেমনি গণতন্ত্রও বিনির্মাণ করা যায় না। পর পর হরতাল পালন করার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের যদি উপলব্ধি হয়, তাতেই জনগণের মঙ্গল নিহিত।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
www.tsrahmanbd.blogspot.com

0 comments:

Post a Comment