আগামী সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ইতোমধ্যে দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর (জানুয়ারি-২০১০) ফিরতি সফরে আসছেন মনমোহন সিং। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সফরটি যে গুরুত্বপূর্ণ তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। শুধু বাংলাদেশি পর্যবেক্ষকরাই নন, আন্তর্জাতিক পরিসরেও বিশ্লেষকরা লক্ষ্য রাখবেন এই সফরের দিকে। সাম্প্রতিক সময় দুদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা দুদেশের রাজধানী সফর করেছেন। এক্ষেত্রে ভারত এগিয়ে আছে একটু বেশি। ইতোমধ্যে ঢাকা সফর করে গেলেন সোনিয়া গান্ধী। ২৯ জুলাই এসে গেলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম। আগস্ট মাসে আসছেন ভারতের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সোনিয়া গান্ধীর সফরের আগে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা। কৃষ্ণার সফরের সময় দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। একটি বিনিয়োগ সংক্রান্ত আর দ্বিতীয়টি ভুটানের যানবাহন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ সংক্রান্ত। সোনিয়া গান্ধীর সফর কোনো রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। কিন্তু তার এই সফরের গুরুত্ব আনেক বেশি। কেননা তিনি কংগ্রেসের সভাপতি। ২০০৪ সালেই তিনি ইচ্ছা করলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু জাতির 'বৃহত্তর স্বার্থে' মনমোহন সিংকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সরকার ও মনমোহন সিংয়ের ওপর তার প্রভাব যথেষ্ট। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যাগুলো সম্পর্কে তিনি যে ওয়াকিবহাল নন, তা বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার আলাপচারিতায় এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেই আমরা ধরে নিতে পারি। তাই ধরে নিতে পারি তিনি ওই বিষয়গুলো নিয়ে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি কী? বলা হচ্ছে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে বেশ কটি চুক্তি হবে। চুক্তি নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে? কৃষ্ণা ঢাকায় বলেছিলেন ভারতের একটি রোল মডেলের কথা। এই 'রোল মডেল' কি শুধু ভারতের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য? আমরা ট্রানজিট দিলাম। কিন্তু আমাদের একটি সমস্যারও তো সমাধান হলো না। সীমান্তহাট চালু হয়েছে গত ২৩ জুলাই। এই সীমান্তহাট কি বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারবে? এটা কি লোক দেখানো না?
এই উদ্যোগ কি আমাদের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে না?
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বড় দেশ। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনী ভারতের। নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর দিক থেকে ভারতের অবস্থান ষষ্ঠ ও অষ্টম। আয়তনের দিক থেকে ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ দেশ। শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদনের দিক থেকে ভারতের অবস্থান দশম। আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলার। সুতরাং বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত তো একটা ভূমিকা রাখতেই পারে। আমরাও তা চাই। কিন্তু সেই ভূমিকাটি যদি হয় একতরফা, তখন তো প্রশ্ন উঠবেই। ভারত ১ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল। ঢাকায় চুক্তিও স্বাক্ষরিত হলো। কিন্তু নানা জটিলতায় সেই ঋণ আটকে আছে। যেসব শর্তে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে, তা নিয়েও কথা আছে। সেইসব শর্ত, ঋণের সুদ বাংলাদেশের অনুকূলে নয়। তাহলে এটা কি 'রোল মডেল?' বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সমস্যা একাধিক, আর একটিরও সমাধান হয়নি। অথচ বারবার বলা হচ্ছে সমাধান হবে। সীমান্তে বাংলাদেশি গুলি করে হত্যা করা বন্ধ হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় গত ২৬ মাসে ১৩৬ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের কথা দিয়েছিলেন সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে। গঙ্গার পানি বণ্টনের চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে (হাসিনা-দেবগৌড়া চুক্তি)। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী পানি আমরা পাইনি কোনোদিন। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তির কথা বলা হলেও, চুক্তি হয়নি (এখন শোনা যাচ্ছে মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় এই চুক্তি হবে)। বাংলাদেশ-ভারত ৬.৫ কিলোমিটার সীমানা আজো চিহ্নিত হয়নি। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল আমরা আজো ফেরত পাইনি। বাণিজ্য ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে। এই ভারসাম্য কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারতের নেই। বাংলাদেশের খাদ্য সঙ্কটের সময় ভারত বাংলাদেশকে চাল বিক্রি করার চুক্তি করলেও, সেই চাল ভারত বিক্রি করেনি। সমুদ্রসীমায় আমাদের অধিকার খর্ব করে ভারত আমাদের কয়েকটি অনুসন্ধানী বস্নকের ওপর তাদের অধিকার দাবি করেছে। দক্ষিণ তালপট্টি আমাদের এলাকা হলেও ১৯৮১ সালের ৯ মে ভারতীয় নৌবাহিনী এটা দখল করে নিয়েছিল। সেই থেকে এটা তাদের দখলে। তিনবিঘার পরিবর্তে আমরা বেরুবাড়ী দিয়েছিলাম। বাংলাদেশ তিনবিঘা 'লিজ' হিসেবে পেয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তিনবিঘার ওপর দিয়ে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা ঝুলে আছে। তাহলে এটা 'রোল মডেল' হলো কীভাবে? ভারত তো তার নিজের স্বার্থ দেখছে। ভারত তার পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করেছে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আলাদা আলাদা চুক্তি করে। নেপালের ৪টি নদীতে (কর্ণালী, পঞ্চেস্বর, সপ্তকোসি, বুড়িগন্ধকী) ও ভুটানের মানোস ও সাংকোশ নদীতে বহুমুখী ড্যাম নির্মাণ করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের ১২ লাখ একর জমির সেচ সমস্যার সমাধান করেছে। নেপালে রিজার্ভারে পানি ধরে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু এ জন্য দরকার ত্রিপক্ষীয় (বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল) উদ্যোগ। যোগাযোগের আপেক্ষিকতার কথা ভারত বললেও (বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলছেন এ কথা), জ্বালানি সঙ্কট সমাধানে কোনো আপেক্ষীয়, নিদেনপক্ষে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। ভারতের 'নেগেটিভ লিস্ট'-এর কারণে বাংলাদেশি পণ্যের কোনো বাজার নেই ভারতে। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব? কৃষ্ণ যে 'রোল-মডেলের' কথা বলে গেলেন, এটা কি তাহলে? 'রোল-মডেল' মানেই কি ভারতীয় স্বার্থ?
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ইদানীং নতুন একটি ধারণা বা ঈড়হপবঢ়ঃ এর কথা শুনছেন। এটি ্তুতড়হব ড়ভ চৎরারষবমবফ রহঃবৎবংঃ্থ। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ তার সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে (বিশেষ করে বেলারুস) সম্পর্কের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই তত্ত্বের কথা বলেছিলেন। এর অর্থ হচ্ছে সীমান্তবর্তী দেশের ওপর তার এক ধরনের স্বার্থ ও অধিকার রয়েছে। এক সময় বেলারুশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে স্বাধীন। বেলারুশ তার জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার কারণে রাশিয়া ও বেলারুশ একটি টহরড়হ ঝঃধঃব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। পূর্ণ একত্রীকরণের পথে এটা একধাপ। বেলারুশে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল চালুরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ অঞ্চলে রাশিয়া তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ঈড়ষষবপঃরাব ঝবপঁৎরঃু ড়ৎমধহরুধঃরড়হ গঠন করেছে, যা মূলত একটি সামরিক জোট। একটি বড় দেশের পাশে একটি ছোট দেশ থাকলে ওই বড় দেশটি ছোট দেশটির ওপর প্রভাব খাটায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন-আফগানিস্তান, ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া কিংবা ভিয়েতনাম-লাওসের বড় প্রমাণ। নিজেদের স্বার্থ ও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল (১৯৭৮), ভিয়েতনাম দখল করে নিয়েছিল কম্বোডিয়া (১৯৭৮)। দখলদাররা পুতুল সরকারও গঠন করে। ইতিহাসে বারবাক কারমাল (আফগানিস্তান) কিংবা হেং সামারিনের (কম্বোডিয়া) নাম এভাবেই উচ্চারিত হয়। পূর্ব ইউরোপের ইতিহাস না হয় নাই বা উল্লেখ করলাম। বাংলাদেশের অবস্থান তখন ভারতের ্তুতড়হব ড়ভ ঢ়ৎরারষবমবফ রহঃবৎবংঃ্থ-এর অন্তর্ভুক্ত। যারা ভারতের বৈদেশিক নীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন ভারত এক সময় 'ইন্ডিয়া ডকট্রিন' ও গুজরাল ডকট্রিন-এর কথা বলেছিল। 'ইন্ডিয়া ডকট্রিন'-এ বলা হয়েছিল ভারত এ অঞ্চলে অন্য কোনো বৃহৎ শক্তির 'নাক গলানো' পছন্দ করবে না। এ ডকট্রিন বা মতবাদে এ অঞ্চলের নিরাপত্তার সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তাকে এক করে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে গুজরাল ডকট্রিন-এ বলা হয়ছে ভারতের সাতবোন রাজ্যের (আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল) উন্নয়নে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে আমরা এই গুজরাল ডকট্রিন এখন বাস্তবায়ন করছি। গুজরাল ডকট্রিন হচ্ছে ইন্ডিয়া ডকট্রিন-এর সম্প্রসারিত পরিবর্তিত রূপ।
কৃষ্ণা চলে গেলেন। এরপর গেলেন সোনিয়া গান্ধী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরণ এবং সেপ্টেম্বরে আসছেন মনমোহন সিং। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন অন্যতম আলোচিত বিষয়। আমরা বারবার বলে আসছি আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব হতে হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের অনেক কিছু আছে বিশ্বকে দেয়ার। যে রোল মডেলের কথা কৃষ্ণা বলেছেন, তা হতে পারে যদি ভারত তার সহযোগিতার হাত আরো সম্প্রসারিত করে।
আমরা সব সমস্যার সমাধান চাই তিস্তার পানি বণ্টন থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধ পর্যন্ত। লোক দেখানো চুক্তি আমরা চাই না। মনমোহন সিং অনেক অভিজ্ঞ লোক। তার আগের বক্তব্যে অনেক মানুষ অখুশি হয়েছে। সেই বক্তব্য থেকে তিনি সরে এসেছেন বলেই মনে হয়। এখন এ দেশের মানুষ আরো খুশি হবে, যদি তিনি সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এসে একাধিক চুক্তি করে বিরাজমান সমস্যাগুলোর একটা সমাধান দিয়ে যান। আমরা অবশ্যই লোক দেখানো কোনো চুক্তি চাইবো না। কিন্তু যেটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে চুক্তির আগে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? তিস্তার চুক্তি নিয়ে জাতিকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। আমরা জানি না ওই চুক্তিতে আমাদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে। গঙ্গার পানি চুক্তি করে আমরা পানি পাইনি। এখন তিস্তার পানি চুক্তি করে যদি পানি না পাই, তাহলে তা হবে দুঃখজনক। ট্রানজিট চুক্তির বিষদ বিবরণ সংসদে উপস্থাপন করা হয়নি। তিস্তার চুক্তি বিবরণ কী, তাও আমরা জানি না। সংসদেও উপস্থাপিত হয়নি। তবে নয়াদিলি্লতে দুদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে নূ্যনতম ঐকমত্যে উপনীত হয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। যদি চুক্তি করে ভারতের স্বার্থ রক্ষিত হয়, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তির জন্য তা ভালো নয়। আমরা সমমর্যাদা চাই। মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হোক-আমরা এটা দেখতে চাই।
দৈনিক যায় যায় দিন, শুক্রবার ২৯ জুলাই ২০১১ ১৪ শ্রাবণ১৪১৮ ২৬ শাবান ১৪৩২
ড. তারেক শামসুর রেহমান অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি কী? বলা হচ্ছে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে বেশ কটি চুক্তি হবে। চুক্তি নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে? কৃষ্ণা ঢাকায় বলেছিলেন ভারতের একটি রোল মডেলের কথা। এই 'রোল মডেল' কি শুধু ভারতের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য? আমরা ট্রানজিট দিলাম। কিন্তু আমাদের একটি সমস্যারও তো সমাধান হলো না। সীমান্তহাট চালু হয়েছে গত ২৩ জুলাই। এই সীমান্তহাট কি বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারবে? এটা কি লোক দেখানো না?
এই উদ্যোগ কি আমাদের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে না?
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বড় দেশ। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনী ভারতের। নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর দিক থেকে ভারতের অবস্থান ষষ্ঠ ও অষ্টম। আয়তনের দিক থেকে ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ দেশ। শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদনের দিক থেকে ভারতের অবস্থান দশম। আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলার। সুতরাং বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত তো একটা ভূমিকা রাখতেই পারে। আমরাও তা চাই। কিন্তু সেই ভূমিকাটি যদি হয় একতরফা, তখন তো প্রশ্ন উঠবেই। ভারত ১ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল। ঢাকায় চুক্তিও স্বাক্ষরিত হলো। কিন্তু নানা জটিলতায় সেই ঋণ আটকে আছে। যেসব শর্তে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে, তা নিয়েও কথা আছে। সেইসব শর্ত, ঋণের সুদ বাংলাদেশের অনুকূলে নয়। তাহলে এটা কি 'রোল মডেল?' বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সমস্যা একাধিক, আর একটিরও সমাধান হয়নি। অথচ বারবার বলা হচ্ছে সমাধান হবে। সীমান্তে বাংলাদেশি গুলি করে হত্যা করা বন্ধ হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় গত ২৬ মাসে ১৩৬ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের কথা দিয়েছিলেন সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে। গঙ্গার পানি বণ্টনের চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে (হাসিনা-দেবগৌড়া চুক্তি)। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী পানি আমরা পাইনি কোনোদিন। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তির কথা বলা হলেও, চুক্তি হয়নি (এখন শোনা যাচ্ছে মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় এই চুক্তি হবে)। বাংলাদেশ-ভারত ৬.৫ কিলোমিটার সীমানা আজো চিহ্নিত হয়নি। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল আমরা আজো ফেরত পাইনি। বাণিজ্য ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে। এই ভারসাম্য কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারতের নেই। বাংলাদেশের খাদ্য সঙ্কটের সময় ভারত বাংলাদেশকে চাল বিক্রি করার চুক্তি করলেও, সেই চাল ভারত বিক্রি করেনি। সমুদ্রসীমায় আমাদের অধিকার খর্ব করে ভারত আমাদের কয়েকটি অনুসন্ধানী বস্নকের ওপর তাদের অধিকার দাবি করেছে। দক্ষিণ তালপট্টি আমাদের এলাকা হলেও ১৯৮১ সালের ৯ মে ভারতীয় নৌবাহিনী এটা দখল করে নিয়েছিল। সেই থেকে এটা তাদের দখলে। তিনবিঘার পরিবর্তে আমরা বেরুবাড়ী দিয়েছিলাম। বাংলাদেশ তিনবিঘা 'লিজ' হিসেবে পেয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তিনবিঘার ওপর দিয়ে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা ঝুলে আছে। তাহলে এটা 'রোল মডেল' হলো কীভাবে? ভারত তো তার নিজের স্বার্থ দেখছে। ভারত তার পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করেছে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আলাদা আলাদা চুক্তি করে। নেপালের ৪টি নদীতে (কর্ণালী, পঞ্চেস্বর, সপ্তকোসি, বুড়িগন্ধকী) ও ভুটানের মানোস ও সাংকোশ নদীতে বহুমুখী ড্যাম নির্মাণ করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের ১২ লাখ একর জমির সেচ সমস্যার সমাধান করেছে। নেপালে রিজার্ভারে পানি ধরে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু এ জন্য দরকার ত্রিপক্ষীয় (বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল) উদ্যোগ। যোগাযোগের আপেক্ষিকতার কথা ভারত বললেও (বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলছেন এ কথা), জ্বালানি সঙ্কট সমাধানে কোনো আপেক্ষীয়, নিদেনপক্ষে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। ভারতের 'নেগেটিভ লিস্ট'-এর কারণে বাংলাদেশি পণ্যের কোনো বাজার নেই ভারতে। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব? কৃষ্ণ যে 'রোল-মডেলের' কথা বলে গেলেন, এটা কি তাহলে? 'রোল-মডেল' মানেই কি ভারতীয় স্বার্থ?
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ইদানীং নতুন একটি ধারণা বা ঈড়হপবঢ়ঃ এর কথা শুনছেন। এটি ্তুতড়হব ড়ভ চৎরারষবমবফ রহঃবৎবংঃ্থ। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ তার সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে (বিশেষ করে বেলারুস) সম্পর্কের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই তত্ত্বের কথা বলেছিলেন। এর অর্থ হচ্ছে সীমান্তবর্তী দেশের ওপর তার এক ধরনের স্বার্থ ও অধিকার রয়েছে। এক সময় বেলারুশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে স্বাধীন। বেলারুশ তার জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার কারণে রাশিয়া ও বেলারুশ একটি টহরড়হ ঝঃধঃব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। পূর্ণ একত্রীকরণের পথে এটা একধাপ। বেলারুশে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল চালুরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ অঞ্চলে রাশিয়া তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ঈড়ষষবপঃরাব ঝবপঁৎরঃু ড়ৎমধহরুধঃরড়হ গঠন করেছে, যা মূলত একটি সামরিক জোট। একটি বড় দেশের পাশে একটি ছোট দেশ থাকলে ওই বড় দেশটি ছোট দেশটির ওপর প্রভাব খাটায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন-আফগানিস্তান, ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া কিংবা ভিয়েতনাম-লাওসের বড় প্রমাণ। নিজেদের স্বার্থ ও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল (১৯৭৮), ভিয়েতনাম দখল করে নিয়েছিল কম্বোডিয়া (১৯৭৮)। দখলদাররা পুতুল সরকারও গঠন করে। ইতিহাসে বারবাক কারমাল (আফগানিস্তান) কিংবা হেং সামারিনের (কম্বোডিয়া) নাম এভাবেই উচ্চারিত হয়। পূর্ব ইউরোপের ইতিহাস না হয় নাই বা উল্লেখ করলাম। বাংলাদেশের অবস্থান তখন ভারতের ্তুতড়হব ড়ভ ঢ়ৎরারষবমবফ রহঃবৎবংঃ্থ-এর অন্তর্ভুক্ত। যারা ভারতের বৈদেশিক নীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন ভারত এক সময় 'ইন্ডিয়া ডকট্রিন' ও গুজরাল ডকট্রিন-এর কথা বলেছিল। 'ইন্ডিয়া ডকট্রিন'-এ বলা হয়েছিল ভারত এ অঞ্চলে অন্য কোনো বৃহৎ শক্তির 'নাক গলানো' পছন্দ করবে না। এ ডকট্রিন বা মতবাদে এ অঞ্চলের নিরাপত্তার সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তাকে এক করে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে গুজরাল ডকট্রিন-এ বলা হয়ছে ভারতের সাতবোন রাজ্যের (আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল) উন্নয়নে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে আমরা এই গুজরাল ডকট্রিন এখন বাস্তবায়ন করছি। গুজরাল ডকট্রিন হচ্ছে ইন্ডিয়া ডকট্রিন-এর সম্প্রসারিত পরিবর্তিত রূপ।
কৃষ্ণা চলে গেলেন। এরপর গেলেন সোনিয়া গান্ধী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরণ এবং সেপ্টেম্বরে আসছেন মনমোহন সিং। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন অন্যতম আলোচিত বিষয়। আমরা বারবার বলে আসছি আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব হতে হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের অনেক কিছু আছে বিশ্বকে দেয়ার। যে রোল মডেলের কথা কৃষ্ণা বলেছেন, তা হতে পারে যদি ভারত তার সহযোগিতার হাত আরো সম্প্রসারিত করে।
আমরা সব সমস্যার সমাধান চাই তিস্তার পানি বণ্টন থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধ পর্যন্ত। লোক দেখানো চুক্তি আমরা চাই না। মনমোহন সিং অনেক অভিজ্ঞ লোক। তার আগের বক্তব্যে অনেক মানুষ অখুশি হয়েছে। সেই বক্তব্য থেকে তিনি সরে এসেছেন বলেই মনে হয়। এখন এ দেশের মানুষ আরো খুশি হবে, যদি তিনি সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এসে একাধিক চুক্তি করে বিরাজমান সমস্যাগুলোর একটা সমাধান দিয়ে যান। আমরা অবশ্যই লোক দেখানো কোনো চুক্তি চাইবো না। কিন্তু যেটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে চুক্তির আগে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? তিস্তার চুক্তি নিয়ে জাতিকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। আমরা জানি না ওই চুক্তিতে আমাদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে। গঙ্গার পানি চুক্তি করে আমরা পানি পাইনি। এখন তিস্তার পানি চুক্তি করে যদি পানি না পাই, তাহলে তা হবে দুঃখজনক। ট্রানজিট চুক্তির বিষদ বিবরণ সংসদে উপস্থাপন করা হয়নি। তিস্তার চুক্তি বিবরণ কী, তাও আমরা জানি না। সংসদেও উপস্থাপিত হয়নি। তবে নয়াদিলি্লতে দুদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে নূ্যনতম ঐকমত্যে উপনীত হয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। যদি চুক্তি করে ভারতের স্বার্থ রক্ষিত হয়, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তির জন্য তা ভালো নয়। আমরা সমমর্যাদা চাই। মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হোক-আমরা এটা দেখতে চাই।
দৈনিক যায় যায় দিন, শুক্রবার ২৯ জুলাই ২০১১ ১৪ শ্রাবণ১৪১৮ ২৬ শাবান ১৪৩২
ড. তারেক শামসুর রেহমান অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment