রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

টিপাইমুখ নিয়ে নতুন বিতর্ক

ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। গেল বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল যখন টিপাইমুখ বাঁধ দেখতে গিয়েছিল, তখন তারা নয়াদিলি্লতে ঊর্ধ্বতন ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। তখন তাদের বলা হয়েছিল ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। সংসদীয় প্রতিনিধি দলটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ২৯ জুলাই (২০১০) টিপাইমুখ বাঁধের নির্মাণাধীন এলাকায় যেতে পারেনি। তারা বাংলাদেশে ফিরে এসে বলেছিলেন ভারত টিপাইমুখে কোনো বাঁধ নির্মাণ করছে না। আমরা তখন আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু হাটে হাঁড়িটি ভেঙে দিলেন ভারতের নর্থ-ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রেমাচান্দ পংকজ। তিনি গত ১১ জুলাই স্থানীয় একটি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, টিপাইমুখে বরাক নদীতে প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেই। তিনি জানান, প্রস্তাবিত ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম টিপাইমুখ প্রকল্পের কাজ যথারীতি এগিয়ে নেয়া হবে (আমার দেশ, ১২ জুলাই, ২০১১)। প্রেমাচান্দের এই বক্তব্য বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। উল্লেখ্য, ভারতের মনিপুর রাজ্যের চোরা-চাঁদপুর জেলার তুইভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। ভারত প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপি ব্যয় করে এই বাঁধটি নির্মাণ করছে। আগামী ২০১২ সালের মধ্যে বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হবার কথা। শুধু বাংলাদেশেই নয়। খোদ আসাম ও মনিপুরের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এই বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করছে। তারা মনে করছেন এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ফলস্বরূপ অর্থনৈতিকভাবেও বিপন্ন হয় পড়বে এলাকার বাসিন্দারা। ভারতের পরিবেশবাদীরা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করলেও, আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গটস বলেছেন বৃহৎ নদী বাঁধ যেকোনো মূল্যে হচ্ছেই। কেউ বাঁধের কাজ আটকাতে পারবে না। এখন মুখ্যমন্ত্রী গটস কিংবা প্রেমাচান্দের বক্তব্যের পর এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, টিপাইমুখ বাঁধ হচ্ছেই।
বাঁধটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে বাংলাদেশ যে বড় ধরনের একটি পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ইতিমধ্যে বলা হচ্ছে, ৯৩০ মিটার দীর্ঘ ও ৯৬৯ মিটার উঁচু এই বাঁধটি চালু হলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রাকোনা ও নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রীষ্মকালে ৯৪৬ কিমি. এলাকা মরুভূমির ন্যায় শুকনো থাকবে এবং বর্ষাকালে হঠাৎ পানি ছাড়লে ব্যাপক বন্যা হবে। প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রভাবিত হবে এর কারণে। ভূমিকম্পের আশংকা বাড়বে। খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে এবং বেশ কিছু শাখা নদী মরে যাবে। বলা বাহুল্য, এই বাঁধটিতে প্রায় ১৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি আটকে রাখা হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। পানিসম্পদ মন্ত্রী এই বাঁধটির ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত না হলেও, টিপাইমুখ সফররত সংসদের পানিসম্পদ মন্ত্রাণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চেয়রম্যান আবদুর রাজ্জাক পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন এই ক্ষয়ক্ষতির কথা। ২০১০ সালের ২৮ জুলাই বিবিসির বাংলা বিভাগ টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে একটি প্রতিবেদন পরিবেশন করে। বাংলা বিভাগের প্রতিনিধি নিজে টিপাইমুখ এলাকায় গিয়েছিলেন এবং সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সাধারণ মানুষেরা, যারা বংশপরম্পরায় ওই এলাকায় বসবাস করে আসছেন, তারা অকপটে স্বীকার করেছেন তাদের জমি হারানোর কথা। বাঁধটি নির্মাণ করা হলে যে এলাকাগুলো সম্পূর্ণ পানির নিচে ডুবে যাবে, তার ৯৪ শতাংশ মনিপুরে আর বাকি ৬ শতাংশ মিজোরামে পড়েছে। মনিপুর হারাবে ৪৭৬০ হেক্টর বাগান, ২০৫৩ হেক্টর ধানি জমি, ১৭৮.২১ বর্গ কিমি. বনভূমি। আর আসাম, মনিপুর ও মিজোরাম একত্রে হারাবে মোট ৩১১ হাজার হেক্টর ভূমি। উভয় রাজ্যের ৬৭টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং মনিপুরের ১৬টি গ্রাম সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে পানির নিচে। এই পরিসংখ্যান মনিপুরের পরিবেশবাদীদের। আমরা বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা না হয় নাইবা বললাম। মনিপুরের পরিবেশবাদীরা গত বছর বাংলাদেশে এসেছিলেন। তারা বাংলাদেশে এসে তাদের সমস্যার কথা বলে গেছেন। বলে গেছেন বাংলাদেশকে টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে প্রতিবাদ জানাতে। এরপর সংসদের সরকারি প্রতিনিধি দল ভারতে গেল। তারা কিন্তু সেখানে গিয়ে মনিপুরের পরিবেশবাদীদের সঙ্গে কথা বলেননি। তাদের কী কথা বলা উচিত ছিল না? আমি নিশ্চিত যে, খোদ মনিপুরই যখন বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি, তখন বাংলাদেশ যে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এ কথাটা রাজ্জাক সাহেব সাহস করে ভারতীয় পক্ষকে বলেননি। বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী যখন নিজে ভারতীয় হাইকমিশনারের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেন, তখন আমি সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রীর উপরও আস্থা রাখতে পারি না। প্রতিনিধি দলে সংসদ সদস্য ছিলেন ছ'জন। এরা জনপ্রতিনিধি। জনগণ এদের ভোট দিয়ে সংসদ পাঠিয়েছে। কিন্তু তাদের তো সেই বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নেই। তারা কী বুঝবেন বাঁধ নির্মাণের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? বাঁধের এরিয়াল সার্ভে ম্যাপ, হাইড্রোলজিক্যাল ম্যাপ, জিয়োটেকটেনিক ডাটা বিশ্লেষক করার ও বোঝার জ্ঞান দরকার, তাদের তা নেই। এজন্য একাধিক কারিগরি বিশেষজ্ঞ থাকা প্রয়োজন ছিল। পানিসম্পদ সচিব প্রায় এক বছর হলো এ মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়েছেন। তারও এ ব্যাপারে জ্ঞান সীমিত। সেই অর্থ বিশেষজ্ঞ ছিলেন দুজন_ যৌথ নদী কমিশনের একজন সদস্য ও বুয়েটের পানিসম্পদ বিভাগের একজন অধ্যাপক। যেখানে যৌথ নদী কমিশনে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনা হয়নি, সেখানে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য প্রতিনিধি দলটিকে সহযোগিতা করতে পারেননি। বুয়েটের যিনি অধ্যাপক, তার কাছেও প্রচুর তথ্য ও উপাত্ত নেই। বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী স্বয়ং নিজে স্বীকার করেছেন ভারত বাঁধটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের হিসাব ছাড়া আর কোনো তথ্য দেয়নি। তাহলে এই তথ্য নিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক গবেষণা করেছেন বলে আমার জানা নেই। এ ক্ষেত্রে যারা এ বিষয় গবেষণা করেছেন এবং বিভিন্ন সেমিনারে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন, তাদের কয়েকজন ভারতে গেলে ভালো হতো। কিন্তু তা হয়নি। টিপাইমুখ বিতর্ক এড়ানোর জন্য সরকার এটি করলে ভালো করতো। আরো একটি কথা, টিপাইমুখ ব্যর্থ সফর শেষে প্রতিনিধি দল ঢাকায় ফিরে এসেছিল। গত এক বছরে আমরা আর টিপাইমুখ নিয়ে কিছু শুনিনি। ভারত আমাদের তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করলেও, সংসদীয় প্রতিনিধি দলের পক্ষে তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করাও সম্ভব ছিল না। তবে আমার বিশ্বাস, ভারত ওই প্রতিনিধি দলকে আলাদা কারিগরি তথ্য ও উপাত্ত দেয়নি। এদিকে গত (২০ জুলাই ২০১০) সংবাদপত্রে প্রাকশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতিকারক কোনো পদক্ষেপ ভারত নেবে না। টিপাইমুখে কোনো সেচ প্রকল্প হবে না। এমন কথাও আমাদের জানিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্যে আমরা কতটুকু আশ্বস্ত হতে পারি? গঙ্গার পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে অতীতে ভারত আমাদের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলে ভিন্ন কথা। গত ৫ জুলাই (২০১১) ছাপা হওয়া একটি সংবাদই এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট। ওই সংবাদে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া গঙ্গা পানি চুক্তির পর এ বছর পদ্মা নদীতে পানির প্রবাহ সবচেয়ে কম। ভারত ফারাক্কা পয়েন্টে আগেভাগেই পানি প্রত্যাহার ও ১ জানুয়ারি থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়ার ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন ভারতীয় মন্ত্রীর কথায় আমরা আস্থা রাখি কিভাবে? আমরা কখনো বলিনি টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে তা সেচকালে ব্যবহার করবে। ভারতের কাছারে বারাকের উজানে যুগেরতাল এলাকায় ভারত নির্মাণ করছে একটি ব্যারাজ, যার মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে অথবা সংরক্ষণ করে এ অঞ্চলের সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করবে। ভারতীয় মন্ত্রী কিন্তু যুগেরতাল প্রকল্পের ব্যাপারে কিছু বলেনি। আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই বাংলাদেশ সরকার যুগেরতাল ব্যারাজ নির্মাণের ব্যাপারটি নিয়ে ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন কি-না কখনো? না হলে, আলোচনাটা এখন জরুরি।
সংসদের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের টিপাইমুখ পরিদর্শনের পর এক বছর পার হয়েছে। এরই মধ্যে এলো প্রেমাচান্দের বক্তব্যটি। এখন রাজ্জাক সাহেব বিষয়টি কীভাবে নেবেন, আমি জানি না। তবে তিনি বাংলাদেশি হাইকমিশনের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। তিনি সংসদে একটি বক্তব্য রেখেছিলেন বটে। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা জানতে চাই, স্থায়ী কমিটির মূল্যায়ন কি? আমরা দেখতে চাই টিপাইমুখ গঙ্গা যুগেরতাল ব্যারাজের 'ডিটেইলড প্ল্যান'_ যা ভারতীয় পক্ষ আমাদের সরবরাহ করবে এবং আমাদের বিশেষজ্ঞরা এই 'ডিটেইলড প্ল্যান' নিয়ে পর্যালোচনা করবেন। ফারাক্কা চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে দিলি্ল আমাদের নদীগুলোর উজানে কোনো রকম স্থাপনা তৈরি করবে না। এখন আমাদের প্রশ্ন, ভারত এই চুক্তি সংযন করছে কি না? টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমাদের শঙ্কা, আরেকটি ভারতীয় পক্ষকে অবহিত করেছি কি-না তাও আমরা জবাব রাজ্জাকের মুখ থেকে জানতে চাই। আসলে ভারতের 'কূট-কৌশলের' কাছে আমরা শক্ত হাতে দাঁড়াতে পারি না। ভারত মুখে বলে এক কথা। কাজ করে উল্টোটি। সারা বিশ্বেই বড় বড় বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে। বিশ্বব্যাংক এ ধরনের প্রকল্পে সাধারণত অর্থায়ন করে না। বিশ্বজনমতকে আমরা আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। ভারতে অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যারা বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্গেও বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ করা যায়। মনিপুরের পরিবেশবাদীদের সঙ্গেও আমরা সম্পর্ক বাড়াতে পারি। এ কাজগুলো সরকার যদি না করে, তাহলে তা করতে হবে বিরোধী দলকে, সেই সঙ্গে স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক,
অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

1 comments:

  1. টিপাইমুখ নিয়ে এখন আর কোন আলোচনা হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের সাবধান থাকতে হবে যেন হুট করে কোন ঘটনা না ঘটে যাতে করে আমাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আলোকিত বাংলাদেশ

    ReplyDelete