আগামী ২৫ থেকে ২৭ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠেয় অটিজম-বিষয়ক সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী ঢাকায় আসছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ২৫ জুলাই বঙ্গভবনে সোনিয়া গান্ধীর হাতে তাঁর শাশুড়ির অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর এই সম্মাননা পদক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তুলে দেবেন। ২৯ জুলাই আসবেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম। তারপর আসছেন উপবিদেশমন্ত্রী। সব শেষে আসছেন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। এর আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ ঢাকা সফর করে গেলেন। মূলত আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং যে ঢাকায় আসছেন, এর খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করতেই তাঁর ঢাকায় আসা। তবে সোনিয়া গান্ধীর সফরও তাৎপর্যবহ। যদিও তিনি একটি সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশে আসছেন, কিন্তু তিনি ভারতের ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিনির্ধারণী স্তরে সংগত কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এরপর পর্যায়ক্রমে ভারতের অন্য মন্ত্রীদের বাংলাদেশ সফরও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণের সফরকালে দুটি চুক্তি হয়েছে। একটি যৌথ বিনিয়োগসংক্রান্ত আর দ্বিতীয়টি ভুটানের যানবাহন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশসংক্রান্ত। চুক্তি দুটি তুলনামূলক বিচারে গুরুত্বপূর্ণ কোনো চুক্তি নয়। তবে ঢাকা সফরকালে কৃষ্ণ দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। এক. বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এ অঞ্চলের রোল মডেল হবে। দুই. ট্রানজিটের আওতায় অস্ত্রশস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের কোনো আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এ দুটি বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বহুপক্ষীয় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ট্রানজিটের কথা বলা হলেও শুধু ভারত ট্রানজিট পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে ট্রানজিটের ফি নির্ধারণের আগেই ভারত এরই মধ্যে ট্রানজিট সুবিধা দিতে শুরু করেছে। পক্ষান্তরে ভুটান ও নেপাল ট্রানজিটের সুবিধা এখনো পায়নি। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, সাতবোন রাজ্যের বিদ্রোহ দমন করতে ভারত এই ট্রানজিট রুটে অস্ত্রশস্ত্র পরিবহন করতে পারে। ভারত ২৮ চাকার যে 'ওভার ডাইমেনশনাল কার্গো' (ওডিসি) এই রুটে চালাবে, তাতে কী পরিবহন করা হচ্ছে তা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা করতে পারবে কি না কিংবা তাতে শুল্ক আরোপ করতে পারবে কি না, সে ব্যাপারে এখনো একটি ধূম্রজাল রয়ে গেছে। কৃষ্ণের কথায় আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারলেও ভবিষ্যৎই বলে দেবে তাঁর কথার সত্যতা কতটুকু। তবে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হচ্ছে রোল মডেলের প্রসঙ্গটি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ২০১০ সালের জানুয়ারির পর থেকেই একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক একটি নতুন টার্ন নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ছিল ঐতিহাসিক। ওই সফরে তিনি বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছিলেন। এর মধ্যে একটি ছিল ট্রানজিট-সংক্রান্ত। কৃষ্ণ যখন রোল মডেলের কথা বলেন, তখন সংগত কারণেই নানা প্রশ্ন ওঠে। এর অর্থ কী? ভারত কি তার সুবিধা আদায়ের জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করবে?
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বড় দেশ। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনী ভারতের। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর দিক থেকে বিশ্বে ভারতের অবস্থান ষষ্ঠ ও অষ্টম। আয়তনের দিক থেকে ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ দেশ। শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদনের দিক থেকে ভারতের অবস্থান দশম। আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে। সুতরাং বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত তো একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতেই পারে। আমরাও তা চাই। কিন্তু সেই ভূমিকাটি যদি হয় একতরফা, তখন তো প্রশ্ন উঠবেই। ভারত এক মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল। ঢাকায় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। কিন্তু নানা জটিলতায় সেই ঋণ আটকে আছে। যেসব শর্তে ঋণ নেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও কথা আছে। সেসব শর্ত, ঋণের সুদ বাংলাদেশের অনুকূলে নয়। তাহলে এটি কি রোল মডেল? বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সমস্যা একাধিক এবং এর একটিরও এখন পর্যন্ত সমাধান হয়নি। অথচ বারবার বলা হচ্ছে, সমাধান হবে। সীমান্তে বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করা বন্ধ হয়নি (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় গত ২৬ মাসে ১৩৬ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ)। অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের কথা দিয়েছিলেন সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে। গঙ্গার পানি বণ্টনের চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে (হাসিনা-দেবগৌড়া চুক্তি)। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী পানি আমরা পাইনি কোনো দিন। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তির কথা বলা হলেও চুক্তি হয়নি (এখন শোনা যাচ্ছে, মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় এই চুক্তি হবে)। বাংলাদেশ-ভারত সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা আজও চিহ্নিত হয়নি। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়নি। বাণিজ্য ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে। এই ভারসাম্য কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারতের নেই। বাংলাদেশের খাদ্য সংকটের সময় বাংলাদেশে চাল বিক্রির চুক্তি করলেও সেই চাল ভারত বিক্রি করেনি। সমুদ্রসীমায় অধিকার খর্ব করে ভারত আমাদের কয়েকটি অনুসন্ধানী ব্লকের ওপর তাদের অধিকার দাবি করেছে। দক্ষিণ তালপট্টি আমাদের এলাকা হলেও ১৯৮১ সালের ৯ মে ভারতীয় নৌবাহিনী এটা দখল করে নিয়েছিল। সেই থেকে এটা তাদের দখলে। তিনবিঘার পরিবর্তে আমরা বেরুবাড়ী দিয়েছিলাম। বাংলাদেশ তিনবিঘা 'লিজ' হিসেবে পেয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তিনবিঘার ওপর দিয়ে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করার কথা। কিন্তু সেটাও ঝুলে আছে। তাহলে এটা রোল মডেল হলো কিভাবে? ভারত তার পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করেছে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আলাদা চুক্তি করে। নেপালের চারটি নদীতে (কর্ণালী, পঞ্চেশ্বর, সপ্তকোষী, বুড়িগন্ধকী) এবং ভুটানের মানোস ও সাংকোশ নদীতে বহুমুখী ড্যাম নির্মাণ করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের ১২ লাখ একর জমির সেচ সমস্যার সমাধান করেছে। নেপালে রিজার্ভারে পানি ধরে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু এ জন্য দরকার ত্রিপক্ষীয় (বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল) উদ্যোগ। যোগাযোগের বহুপাক্ষিকতার কথা ভারত বললেও (বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলছেন এ কথা) জ্বালানি সংকট সমাধানে কোনো বহুপক্ষীয়, নিদেনপক্ষে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না। কৃষ্ণ যে রোল মডেলের কথা বলে গেলেন, এটা কী তাহলে?
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ইদানীং নতুন একটি ধারণা বা পড়হপবঢ়ঃ-এর কথা শুনছেন। এটি হচ্ছে ুড়হব ড়ভ ঢ়ৎরারষবমবফ রহঃবৎবংঃ। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ তাঁর সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে (বিশেষ করে বেলারুশ) সম্পর্কের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই তত্ত্বের কথা বলেছিলেন। এর অর্থ হচ্ছে, সীমান্তবর্তী দেশের ওপর তাঁর এক ধরনের স্বার্থ ও অধিকার রয়েছে। একসময় বেলারুশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে স্বাধীন। বেলারুশ তার জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার কারণে রাশিয়া ও বেলারুশ একটি টহরড়হ ঝঃধঃব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। পূর্ণ একত্রীকরণের পথে এটা এক ধাপ। বেলারুশে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল চালুরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ অঞ্চলে রাশিয়া তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে Collective Security Organization গঠন করেছে, যা মূলত একটি সামরিক জোট। একটি বড় দেশের পাশে একটি ছোট দেশ থাকলে বড় দেশটি ছোট দেশটির ওপর প্রভাব খাটায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন-আফগানিস্তান, ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া কিংবা ভিয়েতনাম-লাওস এর বড় প্রমাণ। পূর্ব ইউরোপের ইতিহাস না হয় না-ই বা উল্লেখ করলাম। বাংলাদেশের অবস্থান এখন ভারতের yone of privileged interest-এর অন্তর্ভুক্ত। যাঁরা ভারতের বৈদেশিক নীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন ভারত একসময় 'ইন্ডিয়া ডকট্রিন', ও 'গুজরাল ডকট্রিন'-এর কথা বলেছিল। ইন্ডিয়া ডকট্রিনে বলা হয়েছিল, ভারত এ অঞ্চলে অন্য কোনো বৃহৎ শক্তির 'নাক গলানো' পছন্দ করবে না। এই ডকট্রিন বা মতবাদে এ অঞ্চলের নিরাপত্তার সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তাকে এক করে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে গুজরাল ডকট্রিনে বলা হয়েছে, ভারতের সাতবোন রাজ্যের (আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল) উন্নয়নে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে আমরা এই গুজরাল ডকট্রিন এখন বাস্তবায়ন করছি কি? গুজরাল ডকট্রিন হচ্ছে ইন্ডিয়া ডকট্রিনের সম্প্রসারিত ও পরিবর্তিত রূপ।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন অন্যতম আলোচিত বিষয়। আমরা বারবার বলে আসছি, আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব হতে হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের অনেক কিছু আছে বিশ্বকে দেওয়ার। যে রোল মডেলের কথা কৃষ্ণ বলেছেন, তা হতে পারে যদি ভারত তার সহযোগিতার হাত আরো সম্প্রসারিত করে। আমরা সব সমস্যার সমাধান চাই_তিস্তার পানি বণ্টন থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধ পর্যন্ত। লোকদেখানো চুক্তি আমরা চাই না। মনমোহন সিং অনেক অভিজ্ঞ মানুষ তথা রাজনীতিক। তাঁর আগের বক্তব্যে অনেক মানুষ অখুশি হয়েছে। সেই বক্তব্য থেকে তিনি সরে এসেছেন বলেই মনে হয়। এখন এ দেশের মানুষ আরো খুশি হবে, যদি তিনি সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এসে একাধিক চুক্তি করে বিরাজমান সমস্যাগুলোর একটা সমাধান দিয়ে যান। তবে কোনো চুক্তিই যাতে লোকদেখানো না হয় এবং আমাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না হয় এ ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকা চাই।তারেক শামসুর রেহমান
রবিবার, ২৪ জুলাই ২০১১, ৯ শ্রাবণ ১৪১৮, ২১ শাবান ১৪৩২, দৈনিক কালের কন্ঠ
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com
0 comments:
Post a Comment