রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আফগানিস্তান নিয়ে শংকা থেকেই গেল

 শিশুদের এ পরিণতির কি জবাব দেবেন ওবামা প্রশাসন
অতি সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।  প্রথম খবরে ছিল প্রেসিডেন্ট ওবামার ৩৩ হাজার সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়টি, পশ্চিমা মিত্র শক্তির সাথে তালেবানদের আলোচনা এবং ওই আলোচনায় মোল্লাহ ওমরের মেয়ের জামাই মোতাসিম আগা জানের তালেবানদের প্রতিদিধিত্ব করা। তৃতীয়টি, কাবুলে অবস্থিত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তালেবানদের আক্রমণ ও ১৬ জনকে হত্যা করার ঘটনা। তিনটি ঘটনার সাথেই একটি যোগসূত্র রয়েছে-আর তা হচ্ছে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। একদিকে কাতারে তালেবানদের সাথে মিত্র শক্তির সম্ভাব্য বৈঠক নিয়ে যখন একটি আশার আলো দেখছেন কেউ কেউ, তখন হোটেলে হামলা চালিয়ে সেই আলোচনাকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করছে তালেবানদের কেউ কেউ। এটা অনেকেই জানেন, আফগানিস্তানে তালেবানদের নামে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী এখন কাজ করছে। পুরো জঙ্গিগোষ্ঠীর উপর মোল্লাহ ওমরের একক কর্তৃত্ব নেই। এমনকি ‘অপারেশন’ পরিচালনার ক্ষেত্রে এক গ্রুপের সাথে অন্য গ্রুপের কোন সমন্বয়ও নেই। ফলে আফগানিস্তানের ভবিষ্যত্ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। চলতি বছর ১০ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন বারাক ওবামা। আগামী বছর প্রত্যাহার করা হবে আরো ২৩ হাজার সৈন্য। আর ২০১৪ সালে সকল বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। এতে করে কী আফগানিস্তানে  স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে? এ প্রশ্ন এখন অনেকেই করছেন। বলা হয়, তালেবানদের সাথে আলোচনায় স্বয়ং মোল্লাহ ওমরের সম্মতি রয়েছে। এ কারণেই তিনি তার মেয়ের জামাইকে (তালেবানী আমলে অর্থমন্ত্রী) প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কিন্তু হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হামলা প্রমাণ করে তালেবানরা কোন ধরনের আলোচনার পক্ষপাতী নন। সুতরাং আলোচনার ভবিষ্যত্ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছে অনেকদিন ধরেই। ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে একটি ‘বামপন্থি’ বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু বিপ্লবের পরপরই বিপ্লবীরা নিজেদের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। আর এর সূত্র ধরে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটি দখল করে নিয়েছিল। এর ঠিক নয় বছর পর ১৯৮৮ সালে সাবেক সোভিয়েত নেতা গরবাচেভ আফগানিস্তান থেকে সকল সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। আর ২০০১ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র বিমান আক্রমণ চালিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল। অভিযোগ ছিল, ৯/১১-এর ঘটনাবলীর সাথে জড়িত ওসামা বিন লাদেনকে তালেবানরা আশ্রয় দিয়েছে। এই অভিযোগ তুলে আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালিয়ে দেশটি দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই থেকে তাদের ‘দখলে’ রয়েছে দেশটি। যদিও হামিদ কারজাই আফগানিস্তানের ‘নির্বাচিত’ প্রেসিডেন্ট। এখন ওবামার সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও এই ‘সম্ভাবনা’ এখন নানা প্রশ্নের জন্ম  দিয়েছে।
দু’টি কারণে ওবামা মূলত এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। এক. ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ওবামা দ্বিতীয় টার্মের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সেখানে তার ইমেজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। দুই. আফগান যুদ্ধের বিপুল খরচ বহন করা নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এখন কথাবার্তা হচ্ছে, যা নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। যদি খরচের হিসাব দেয়া হয়, তা খুব আশার কথা বলে না। যেখানে ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য চাকরির সংস্থান করতে পারছেন না, সেখানে ইরাক ও আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমাণ ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। চলতি বছর আফগান যুদ্ধের জন্য বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে ১২০ মিলিয়ন ডলার। STRAT FOR  নামে একটি গবেষণা সংস্থা তাদের এক প্রতিবেদন (২৩ জুন, ১১) জানিয়েছে, আফগানিস্তানে অবস্থানরত একজন মার্কিন সৈন্যের জন্য বছরে খরচ হয় ১ মিলিয়ন ডলার। এক গ্যালন তেল যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কাছে সরবরাহে (পরিবহন, নিরাপত্তা ইত্যাদি) খরচ হয় প্রায় ৪০০ ডলার। অপর একজন গবেষক দেখিয়েছেন আফগানিস্তানে ২০১১-১২ অর্থবছরে  যে অর্থ ব্যয় হবে তা দিয়ে নিন্মোক্ত কাজগুলো করা সম্ভব : ১. নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ৫৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, ২. ২০২ মিলিয়ন ছাত্রকে তাদের উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে সাড়ে ৫ হাজার ডলার করে সাহায্য দেয়া, ৩. ১৪ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন বয়স্ক মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া, ৪. প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর জন্য আরো ১ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন শিক্ষক নিয়োগ করা, ৫. ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন পুলিশ অফিসার নিয়োগ করা এবং ৬. ৬৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন বাড়িঘরে সস্তায় ‘সবুজ জ্বালানি’ (সৌর বিদ্যুত্) সরবরাহ করা। আফগান যুদ্ধের খরচ অবশ্যই একটি ফ্যাক্টর।
কিন্তু এরপর কী? যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথে ফ্রান্সও জানিয়ে দিয়েছে তারাও সৈন্য প্রত্যাহার করবে। আর বৃটেন তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেবে ২০১৪ সালে। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই  ওবামার এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু কারজাই এই সিদ্ধান্তে যতই সন্তুষ্ট হন না কেন, আফগান সেনাবাহিনী তালেবানদের মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট নয়। কারজাই-এর পরিণতি হতে পারে অনেকটা ডা. নজিবুল্লাহর মত, যিনি আফগানিস্তানে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে ১৯৮৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে- ছিলেন। তালেবানরা ১৯৯২ সালের ১৫ এপ্রিল তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। পরে তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছেন তালেবানদের সাথে একটি সমঝোতায় যেতে। প্রাথমিকভাবে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলেও কোন সমঝোতা হয়নি। সমস্যা হচ্ছে আফগানিস্তানে একাধিক তালেবান গ্রুপ সক্রিয়। এরা আবার গোষ্ঠীকেন্দ্রিকভাবে বিভক্ত। মোল্লাহ ওমরের নেতৃত্বাধীন অংশ দক্ষিণ আফগানিস্তানে সক্রিয়। গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হেজবে ইসলামী গ্রুপ সক্রিয় কুনার ও নানগাহার প্রদেশে। উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সক্রিয় হাক্কানী নেটওর্য়াক, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বাবা-ছেলে জালালুদ্দিন হাক্কানী ও সিরাজুদ্দিন হাক্কানী। পাকিস্তানপন্থি তালেবানদের সাথে এদের যোগাযোগ রয়েছে এবং পাকিস্তানের FATA অঞ্চলে এরা আশ্রয় পায়। বিশেষ করে সোয়াত ও বাজুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে ‘তেহরিক ই নিফাজ ই সারিয়াত ই মোহাম্মদী’। নেতৃত্বে রয়েছেন সুফী মোহাম্মদ। দু’টি বিচ্ছিন্ন গ্রুপও এ অঞ্চলে তত্পর, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফাজলুল্লাহ ( ধারণা করা হয় নিহত) ও মৌলভী ফকির মোহাম্মদ। কাশ্মীরে তত্পর লস্কর ই তৈয়েবার সাথেও এদের যোগাযোগ রয়েছে। সেইসাথে যোগাযোগ রয়েছে ‘তেহরিক ই তালিবান পাকিস্তান’-এর মত সংগঠনগুলোর সাথে। যুক্তরাষ্ট্র এখন কোন গ্রুপের সাথে সমঝোতায় যাবে? মূল ধারার (মোল্লাহ ওমর) শীর্ষ পর্যায়ের দু’-একজন নেতার সাথে পরোক্ষ আলোচনা হলেও, তা কোন ফল দেয়নি। তাই একটা বড় প্রশ্ন রয়েই গেল। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণ আফগানদের জন্য কিছু কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করলেও (স্বাস্থ্যসেবা, স্কুল নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরি, চাকরি) তা ব্যাপক জনসমর্থন পায়নি। সেখানে অর্থের অপচয় হয়েছে মাত্র। এখন ওবামার সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত মার্কিন রাজনীতিতে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করবে হয়ত, কিন্তু আফগান সমস্যার কোন সমাধান ডেকে আনবে না। আগামী ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে জনসমর্থন বাড়াতে ওবামা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আফগান যুদ্ধে এ যাবত্ এক হাজার ৬০০-এর বেশি মার্কিন সেনা নিহত হয়েছেন, আর আহত হয়েছেন প্রায় ১২ হাজার সেনা। অভ্যন্তরীণভাবে একটা চাপ আছে বলেই ওবামা সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু এটা কোন সমাধান নয়। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করে আফগান জনগণের উপর। উদ্যোগটি এখন নিতে হবে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে। তালেবানদের সকল গ্রুপের সাথে আলোচনা যেমনি জরুরি, ঠিক তেমনি জরুরি এই আলোচনায় কারজাই সরকারের অংশগ্রহণও। শুধুমাত্র পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর জার্মানদের সাথে আলোচনা করলে চলবে না। এই আলোচনায় আফগান সরকারের প্রতিনিধিত্বও থাকা উচিত।
অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন ব্যর্থ রাষ্ট্রের যে তালিকা প্রণয়ন করেছে, তাতে আফগানিস্তানের নাম রয়েছে শীর্ষে। দীর্ঘ যুদ্ধ, সু-শাসন নিশ্চিত করার ব্যর্থতা, অসম উন্নয়ন, বহি:শক্তির সামরিক হস্তক্ষেপ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত না হওয়া, দেশটির উদ্ভাস্তু পরিস্থিতি ইত্যাদি নানা কারণে আফগানিস্তানকে অন্যতম ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আন্তর্জাতিক আসরে এই ব্যর্থ রাষ্ট্রের কোন মর্যাদা নেই। প্রায়  ৩৩ বছর দেশটিতে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের কারণে একটি প্রজন্ম দেশের বাইরে বেড়ে উঠছে। এদের একটা অংশ ‘তালেবানী রাজনীতিতে’ সক্রিয় হচ্ছে, অপর অংশ বিদেশের মাটিতে বিদেশী সংস্কৃতিকে ধারণ করছে। অনেক আফগান পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশান্তরিত হয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এরা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। এখন যে প্রশ্নটি অনেকেই করেন, তা হচ্ছে আফগানিস্তানে তালেবানরা কী পুনরায় ফিরে আসছে? তালেবানরা যে একটি শক্তি, তা তারা আবারো প্রমাণ করলো। খোদ কাবুলে যখন হামলা হয়, তখন বুঝে নিতে হবে তালেবানরা কত শক্তিশালী। এখন ২০১৪ সালের দিকে আফগানিস্তান থেকে সকল বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলে সেখানে একটি বড় ধরনের ‘শূন্যতার’ সৃষ্টি হবে। সেই ‘শূন্যতা’ আফগানিস্তানের সেনাবাহিনীকে দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। সংগত কারণেই তাই একটি ‘সমঝোতা’ দরকার। যে উদ্যোগটি ওবামা প্রশাসন নিয়েছেন, অর্থাত্ সরাসরি তালেবানদের সাথে আলোচনা, এই উদ্যোগটি ভালো। তবে এটা আরো ফলপ্রসূ হবে যদি যুদ্ধরত সকল গ্রুপের সাথে সংলাপ শুরু করা যায়। এটা না হলে আফগানিস্তানে ‘যুদ্ধ’ থামবে না। আফগানিস্তানে একটি চিরস্থায়ী সমঝোতা দরকার। আর এজন্য প্রয়োজন সকল গ্রুপের সাথে আলোচনা।
মঙ্গল, ৫ জুলাই ২০১১, ২১ আষাঢ় ১৪১৮
ড. তারেক শামসুর রেহমান   
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment