‘রাজনীতির বল’টি এখন সরকারের কোর্টে। গত ১৩ জুলাই ৮ ঘণ্টার গণঅনশনের পর প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী ‘রাজনীতির বল’টি ঠেলে দিলেন সরকারের কোর্টে। পর পর দু’সপ্তাহে টানা হরতালের পর গণঅনশন কর্মসূচিতে তিনি ঘোষণা করলেন ঈদের পর আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এর অর্থ তিনি সরকারকে কিছুটা সময় দিলেন। রমজানের আগে তিনি ‘নতুন কর্মসূচি’ দিতে পারতেন বটে। কিন্তু তা না দিয়ে সরকারকে নতুন করে ভাবার কিছুটা সময় দিলেন। সরকার অতি দ্রুততার সঙ্গে সংবিধান সংশোধন করেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা বিতর্কের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি গত ৮ জুন সংবিধান সংশোধনের জন্য ৫১ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করার মাত্র ১২ দিনের মাথায় তা মন্ত্রিসভায় অনুমোদন ও দ্রুততার সঙ্গে সংসদে পাস করিয়ে নেয়ায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে নানা কথা উঠেছে। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই এই সরকার বাতিল করে দেয়নি, বরং সংবিধানের মূল নীতিতে (৮.১ ক) যেখানে ছিল ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি’—তাও বাতিল করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী যেখানে সমাজতন্ত্র উঠে গেছে, সেখানে নতুন করে সমাজতন্ত্র যুক্ত করা হয়েছে। জাতীয় পরিচয় বাঙালি ও নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী অন্তর্ভুক্ত করে নতুন এক সঙ্কট সৃষ্টি করা হলো এখন। সংবিধানে একদিকে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ রাখা হয়েছে বটে, আবার ধর্মনিরপেক্ষতাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা পরস্পরবিরোধী। এর মাধ্যমে একটা জগাখিচুড়ি সৃষ্টি করা হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ের কারণ যেটি, তা হচ্ছে সংবিধানে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংবিধানে এই ধারার অন্তর্ভুক্তির এখন ভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে এবং যে কাউকে সংবিধানের এই ধারামতে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া যেতে পারে।
সংবিধানে এই আমূল পরিবর্তনে বিরোধী দলের কোনো মতামত গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি দেশের বুদ্ধিবীজীদেরও কোনো মতামত গ্রহণ করা হয়নি। অনেকটা দলীয় তথা ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। ফলে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি তথা চার দলের বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকগুলো ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি করবেন। এ ব্যাপারে কারোরই আপত্তি নেই। যারা গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচার হোক। রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধীদের যদি বিচার হতে পারে, যদি বসনিয়ার কসাই মিলোসেভিচকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারে। কিন্তু মুখচেনা কিছু ব্যক্তির বিচার করলে তো পুরো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার তার আমলেই সম্পন্ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ৩ জুলাই গ্রেনেড হামলা মামলার সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এই মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্তদের বিচার করা প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কয়েক লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এদের পরিবার ও সমর্থকদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। পত্রপত্রিকায় শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের নাম-ধাম এসেছে। এদের কেউ কেউ সরকারি দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ১৯৯৬ সালে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির সময়েও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। অভিযুক্তদের কারোরই সেদিন বিচার হয়নি। আজও অভিযুক্তদের যদি বিচার না হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য তা ভালো কোনো খবর নয়। প্রধানমন্ত্রীর জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ বটে।
সরকার সংবিধান সংশোধনীর মতো বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেসব বিষয়, সেগুলোর ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়নি এতটুকুও। অথবা গুরুত্ব দিলেও এ ব্যাপারে অগ্রগতি হয়েছে কম। যেমন খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি। মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আটার দাম বেড়েছে প্রায় ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সয়াবিন ও পাম তেলের দামও বেড়েছে যথাক্রমে শতকরা ১১৮ দশমিক ৩৬ ভাগ ও ১৪৬ দশমিক ১৫ ভাগ। এটা বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের দেয়া তথ্য। ২০১০-১১ অর্থবছরের শুরু থেকেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর অতিক্রম করে। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সার ও ডিজেলের দামও বাড়ানো হয়েছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার এখানে ব্যর্থ।
এরই মধ্যে নিম্নআয়ের মানুষের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ২০১৫ সালে এমডিজির বাস্তবায়ন এখন প্রশ্নের মুখে। যে রেমিট্যান্স নিয়ে আমাদের এত গর্ব, সেখানে আশার কোনো খবর নেই। রেমিট্যান্স আয়ের উচ্চপ্রবৃদ্ধির ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। গত অর্থবছরে যে অর্থ এসেছে (১ হাজার ১৬৪ কোটি ৯৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার), তার প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ এর আগের বছরে (২০০৯-১০) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ শতাংশের বেশি। এর অর্থ পরিষ্কার, শ্রমবাজার খোঁজার ব্যর্থতা। বাংলাদেশের জনবল রফতানির মূল বাজার মধ্যপ্রাচ্য। সেখানে বাংলাদেশীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসছে (কিন্তু নেপালের মতো দেশের সম্ভাবনা সেখানে বাড়ছে কোনো কোনো দেশে)। দেশে বেকার সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। কিন্তু সরকারের কোনো বড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। এমনিতেই জ্বালানি সঙ্কটের কারণে বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়েনি। নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুত্ সংযোগও দেয়া সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালে জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুত্ যুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে জুন পর্যন্ত মাত্র ৬৩০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ছয় বছর আগে ২০০৪ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুত্ উত্পাদন হতো, এখনও সেই পরিমাণ বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে (কালের কণ্ঠ, ৫ জুলাই)। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে ভালো তা বলা যাবে না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন পুলিশের জন্য আরও ১০টি আইজি পদ চাচ্ছেন, তখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। শুধু এক মাসে ২৬ শিশু ও ১২ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সকালের খবর গত ৭ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে। আর জুন মাসে ঢাকা শহরের একাধিক সোনার দোকান ও বাসায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের ভূমিকা আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হলো যখন বিএনপির সংসদীয় দলের চিফ হুইপ পুলিশের পিটুনিতে আহত হলেন। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন পুলিশের পিটুনির শিকার হন, তখন এর চাইতে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। পুলিশের পিটুনির পরও তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। চিকিত্সার জন্য তিনি এখন বিদেশে।
সরকারের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ একাধিক। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আসছেন সেপ্টেম্বরে। এসে গেলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আসবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সোনিয়া গান্ধী স্বয়ং। স্পষ্টতই বোঝা যায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি নতুন দিকে টার্ন নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমস্যা রয়েছে অনেক। গত ৪০ বছরেও সে সব সমস্যার সমাধান হয়নি। আমরা ট্রানজিট দিলাম। কিন্তু বিদ্যুত্ কবে আসবে, আমরা জানি না। ‘হাই প্রোফাইল’ ভিজিট ভালো। কিন্তু আমরা পদ্মায় পানি চাই, চাই তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকার। চাই বিএসএফের হত্যা বন্ধ। চাই ছিটমহলগুলো ফেরত। ভারতকে ‘বন্ধু’ ভাবতে চাই। কিন্তু এই বন্ধুত্ব হতে হবে একপক্ষীয় নয়—দ্বিপক্ষীয়, প্রয়োজনে বহুপাক্ষিক। শেখ হাসিনার জন্য এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জ। অতিমাত্রায় ভারতনির্ভরতা বাংলাদেশের জন্য ‘ইমেজ সঙ্কট’ সৃষ্টি করতে পারে।
রাজনীতি এক অনিশ্চয়তার দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সরকারের কঠোর মনোভাব সঙ্কটকে আরও জটিল করেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। বিরোধী দলের উত্থাপিত দাবি-দাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। বিশেষ করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে পরিবর্তন আনাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। কীভাবে পরিবর্তন আনা যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা যায়, এ বিষয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে ‘সংলাপ’ ওপেন করা জরুরি। বেগম জিয়া এরই মধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন প্রয়োজন। তার ওই বক্তব্যকে বিবেচনায় নিলে একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু তা না করে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে মামলা দিয়ে যদি বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়, তা সরকারের জন্য খুব ভালো হবে বলে মনে হয় না। কেননা, সংবিধান একটি দেশের, কোনো দলের নয়। দলীয় বিবেচনায় সংবিধান সংশোধন করা ঠিক নয়। সরকার ও বিরোধী দল নিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়। বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে যে ‘গণতন্ত্র’, তাকে কোনোমতেই ‘গণতন্ত্র’ বলা যাবে না।
বেগম জিয়া ঈদের পর বড় ধরনের গণআন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এটাকে বিবেচনায় নিতে হবে। হরতাল, লাগাতার হরতাল, লংমার্চ ইত্যাদি কর্মসূচি আসছে। এসব কর্মসূচি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় পৌঁছে দেবে না। সরকারের কঠোর মনোভাব দেশকে চরম অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে। আর এর দায়ভার নিতে হবে সরকারকেই। লাগাতার হরতাল ও গণঅনশনের পর বিএনপি একটা মেসেজ পৌঁছে দিয়েছে—আর তা হচ্ছে অতিদ্রুত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের উদ্যোগ নেয়া। যে দ্রুততার সঙ্গে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল, একই ধরনের দ্রুততার সঙ্গে সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী আনা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা এবং ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংবিধানে ফিরিয়ে আনা।
দৈনিক আমার দেশ, রোববার ১৭ জুলাই ২০১১, ০২ শ্রাবণ ১৪১৮, ১৩ শাবান ১৪৩২ হিজরী
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
সংবিধানে এই আমূল পরিবর্তনে বিরোধী দলের কোনো মতামত গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি দেশের বুদ্ধিবীজীদেরও কোনো মতামত গ্রহণ করা হয়নি। অনেকটা দলীয় তথা ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। ফলে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি তথা চার দলের বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকগুলো ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি করবেন। এ ব্যাপারে কারোরই আপত্তি নেই। যারা গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচার হোক। রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধীদের যদি বিচার হতে পারে, যদি বসনিয়ার কসাই মিলোসেভিচকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারে। কিন্তু মুখচেনা কিছু ব্যক্তির বিচার করলে তো পুরো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার তার আমলেই সম্পন্ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ৩ জুলাই গ্রেনেড হামলা মামলার সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এই মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্তদের বিচার করা প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কয়েক লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এদের পরিবার ও সমর্থকদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। পত্রপত্রিকায় শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের নাম-ধাম এসেছে। এদের কেউ কেউ সরকারি দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ১৯৯৬ সালে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির সময়েও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। অভিযুক্তদের কারোরই সেদিন বিচার হয়নি। আজও অভিযুক্তদের যদি বিচার না হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য তা ভালো কোনো খবর নয়। প্রধানমন্ত্রীর জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ বটে।
সরকার সংবিধান সংশোধনীর মতো বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেসব বিষয়, সেগুলোর ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়নি এতটুকুও। অথবা গুরুত্ব দিলেও এ ব্যাপারে অগ্রগতি হয়েছে কম। যেমন খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি। মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আটার দাম বেড়েছে প্রায় ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সয়াবিন ও পাম তেলের দামও বেড়েছে যথাক্রমে শতকরা ১১৮ দশমিক ৩৬ ভাগ ও ১৪৬ দশমিক ১৫ ভাগ। এটা বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের দেয়া তথ্য। ২০১০-১১ অর্থবছরের শুরু থেকেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর অতিক্রম করে। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সার ও ডিজেলের দামও বাড়ানো হয়েছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার এখানে ব্যর্থ।
এরই মধ্যে নিম্নআয়ের মানুষের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ২০১৫ সালে এমডিজির বাস্তবায়ন এখন প্রশ্নের মুখে। যে রেমিট্যান্স নিয়ে আমাদের এত গর্ব, সেখানে আশার কোনো খবর নেই। রেমিট্যান্স আয়ের উচ্চপ্রবৃদ্ধির ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। গত অর্থবছরে যে অর্থ এসেছে (১ হাজার ১৬৪ কোটি ৯৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার), তার প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ এর আগের বছরে (২০০৯-১০) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ শতাংশের বেশি। এর অর্থ পরিষ্কার, শ্রমবাজার খোঁজার ব্যর্থতা। বাংলাদেশের জনবল রফতানির মূল বাজার মধ্যপ্রাচ্য। সেখানে বাংলাদেশীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসছে (কিন্তু নেপালের মতো দেশের সম্ভাবনা সেখানে বাড়ছে কোনো কোনো দেশে)। দেশে বেকার সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। কিন্তু সরকারের কোনো বড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। এমনিতেই জ্বালানি সঙ্কটের কারণে বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়েনি। নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুত্ সংযোগও দেয়া সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালে জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুত্ যুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে জুন পর্যন্ত মাত্র ৬৩০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ছয় বছর আগে ২০০৪ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুত্ উত্পাদন হতো, এখনও সেই পরিমাণ বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে (কালের কণ্ঠ, ৫ জুলাই)। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে ভালো তা বলা যাবে না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন পুলিশের জন্য আরও ১০টি আইজি পদ চাচ্ছেন, তখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। শুধু এক মাসে ২৬ শিশু ও ১২ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সকালের খবর গত ৭ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে। আর জুন মাসে ঢাকা শহরের একাধিক সোনার দোকান ও বাসায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের ভূমিকা আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হলো যখন বিএনপির সংসদীয় দলের চিফ হুইপ পুলিশের পিটুনিতে আহত হলেন। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন পুলিশের পিটুনির শিকার হন, তখন এর চাইতে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। পুলিশের পিটুনির পরও তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। চিকিত্সার জন্য তিনি এখন বিদেশে।
সরকারের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ একাধিক। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আসছেন সেপ্টেম্বরে। এসে গেলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আসবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সোনিয়া গান্ধী স্বয়ং। স্পষ্টতই বোঝা যায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি নতুন দিকে টার্ন নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমস্যা রয়েছে অনেক। গত ৪০ বছরেও সে সব সমস্যার সমাধান হয়নি। আমরা ট্রানজিট দিলাম। কিন্তু বিদ্যুত্ কবে আসবে, আমরা জানি না। ‘হাই প্রোফাইল’ ভিজিট ভালো। কিন্তু আমরা পদ্মায় পানি চাই, চাই তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকার। চাই বিএসএফের হত্যা বন্ধ। চাই ছিটমহলগুলো ফেরত। ভারতকে ‘বন্ধু’ ভাবতে চাই। কিন্তু এই বন্ধুত্ব হতে হবে একপক্ষীয় নয়—দ্বিপক্ষীয়, প্রয়োজনে বহুপাক্ষিক। শেখ হাসিনার জন্য এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জ। অতিমাত্রায় ভারতনির্ভরতা বাংলাদেশের জন্য ‘ইমেজ সঙ্কট’ সৃষ্টি করতে পারে।
রাজনীতি এক অনিশ্চয়তার দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সরকারের কঠোর মনোভাব সঙ্কটকে আরও জটিল করেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। বিরোধী দলের উত্থাপিত দাবি-দাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। বিশেষ করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে পরিবর্তন আনাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। কীভাবে পরিবর্তন আনা যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা যায়, এ বিষয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে ‘সংলাপ’ ওপেন করা জরুরি। বেগম জিয়া এরই মধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন প্রয়োজন। তার ওই বক্তব্যকে বিবেচনায় নিলে একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু তা না করে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে মামলা দিয়ে যদি বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়, তা সরকারের জন্য খুব ভালো হবে বলে মনে হয় না। কেননা, সংবিধান একটি দেশের, কোনো দলের নয়। দলীয় বিবেচনায় সংবিধান সংশোধন করা ঠিক নয়। সরকার ও বিরোধী দল নিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়। বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে যে ‘গণতন্ত্র’, তাকে কোনোমতেই ‘গণতন্ত্র’ বলা যাবে না।
বেগম জিয়া ঈদের পর বড় ধরনের গণআন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এটাকে বিবেচনায় নিতে হবে। হরতাল, লাগাতার হরতাল, লংমার্চ ইত্যাদি কর্মসূচি আসছে। এসব কর্মসূচি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় পৌঁছে দেবে না। সরকারের কঠোর মনোভাব দেশকে চরম অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে। আর এর দায়ভার নিতে হবে সরকারকেই। লাগাতার হরতাল ও গণঅনশনের পর বিএনপি একটা মেসেজ পৌঁছে দিয়েছে—আর তা হচ্ছে অতিদ্রুত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের উদ্যোগ নেয়া। যে দ্রুততার সঙ্গে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল, একই ধরনের দ্রুততার সঙ্গে সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী আনা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা এবং ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংবিধানে ফিরিয়ে আনা।
দৈনিক আমার দেশ, রোববার ১৭ জুলাই ২০১১, ০২ শ্রাবণ ১৪১৮, ১৩ শাবান ১৪৩২ হিজরী
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment