রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আবারও টিপাইমুখ

আবারও টিপাইমুখ বাঁধের প্রসঙ্গটি আলোচনায় এসেছে। গত ১২ জুলাই বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। ওই সংবাদে বলা হয়েছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও সেই সঙ্গে আসাম রাজ্য সরকার জানিয়ে দিয়েছে যে টিপাইমুখে বরাক নদীর ওপর প্রস্তাবিত জলবিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেই। নর্থ-ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেডের (নিপকো) চেয়ারম্যান প্রেমচান্দ পংকজ সংবাদ মাধ্যমে এ তথ্যটি জানান। এমনকি আসাম রাজ্য সরকারও এ প্রকল্পসহ আরও বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈর একটি মন্তব্যও ছাপা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, যে কোনো মূল্যে বাঁধ হবেই।
প্রেমচান্দ কিংবা আসামের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বাংলাদেশে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। অনেকেরই মনে থাকার কথা বাংলাদেশে টিপাইমুখ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে গেল বছরের জুলাই মাসে (২০১০) বাংলাদেশের একটি সর্বদলীয় (চারদল বাদে) সংসদীয় প্রতিনিধিদল টিপাইমুখ সফরে গিয়েছিল। যদিও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তাদের পক্ষে ওই এলাকায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু নয়াদিল্লিতে তারা যখন সিনিয়র ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলিত হন তখন তাদের বলা হয়েছিল টিপাইমুখ বাঁধের কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনকি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীও একবার বলেছিলেন, টিপাইমুখে ভারত এমন কিছু করবে না, যা বাংলাদেশের ক্ষতি করে। ভারতীয় নেতাদের ওই বক্তব্যের সঙ্গে প্রেমচান্দ বা তরুণ গগৈর বক্তব্যের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রস্তাবিত এ বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে ভারতের মণিপুর রাজ্যের চোরাচাঁদপুর জেলার তুই ভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখে। তবে বাংলাদেশে শুধ নয়, খোদ ভারতেই এই বাঁধ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ভারতের পরিবেশবাদীরা এই জলবিদ্যুত্ প্রকল্পের বিরুদ্ধে।
টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ইতিহাস অনেক পুরনো। প্রায় ৫৫ বছর। এই বাঁধ নির্মাণের প্রথম প্রস্তাব নেয়া হয়েছিল (আসাম সরকার) ১৯৫৪ সালে। ১৯৫৫ সালে মণিপুরের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী রিসাং কেইসিং ঘোষণা করেছিলেন যে মণিপুর সরকার এই বাঁধ নির্মাণের অনুমতি দেবে না। এমনকি ১৯৯৮ সালে মণিপুরের বিধানসভায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ২০০১ সালে এ রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের সুযোগ নিয়ে এ প্রকল্পটি অনুমোদন করিয়ে নেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনও মণিপুরে এই বাঁধের বিরুদ্ধে শক্ত জনমত রয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে ২০টি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ACTIP বা Action Committee Against Tipaimukh Project। এদের যুক্তি হচ্ছে এই বাঁধটি নির্মিত হলে অনেক এলাকা জলমগ্ন হবে এবং অনেক আদিবাসী স্থানচ্যুত হবে। তারা নিজ বাসভূমি ছাড়তে বাধ্য হবেন এবং উদ্বাস্তুতে পরিণত হবেন। শুধু তাই নয় পরিবেশেরও মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে (২০১২ সালে এটি চালু হওয়ার কথা) মেঘনারও ‘মৃত্যু’ ঘটবে। মেঘনার পরিণতি হবে পদ্মার শীর্ণ স্রোতস্বিনীর আকার ধারণ করার মতো। গবেষণায় দেখা গেছে, বাঁধটি চালু হলে সুরমা-কুশিয়ারার পানি শুষ্ক মৌসুমে ৬০ শতাংশ ও ভরা মৌসুমে ১২ শতাংশ হ্রাস পাবে। বাঁধটি পরিচালনার আগে যখন রিজার্ভারটি পূর্ণ করা হবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই এর ভাটিতে পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হবে, যা ওই অঞ্চলের স্বাভাবিক পরিবেশ ও ইকো-সিসটেমকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং মত্স্য প্রজননে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ওই প্রকল্পের ফলে খোদ ভারতেই ২৭ হাজার ২৪২ হেক্টর বনভূমি বিনষ্ট হবে। আসাম, মণিপুর ও মিজোরামের ৩১১ বর্গকিমি ভূমি প্লাবিত হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১ হাজার ৪৬১ আদিবাসী হাম (Hamar) পরিবার এবং জিলিয়ানোগ্রং নাগা উপজাতির এক-তৃতীয়াংশ তাদের আবাসস্থল ছাড়তে বাধ্য হবে। অতীতে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেছিলেন, ‘কিছু লোক না বুঝেই টিপাইমুখ বাঁধের বিরোধিতা করছে’ (আমার দেশ, ২৭ মে, ০৯)। তখন তিনি সত্য কথাটি বলেননি। এ দেশে কিছু লোক আছেন, যারা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করেন, গবেষণা করেন। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় বিষয়টি দেখা ঠিক নয়। মানুষের সেন্টিমেন্ট রাজনীতিবিদদের বুঝতে হয়। তিনি যে ভাষায় কথা বলেছিলেন, সেই একই ভাষায় কথা বলেছিলেন আমাদের কয়েকজন পূর্ণ মন্ত্রীও। টিপাইমুখ নিয়ে দেশে ও বিদেশে কাজ হচ্ছে। আরো কাজ হওয়া উচিত। প্রয়োজনে সরকার পরিবেশবাদী ও সমাজবিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠন করতে পারে। সরকারি উদ্যোগে সেখানে তাদের পাঠানো যেতে পারে। বিএনপি ও বামমনা দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হতে পারে। কেননা বিষয়টি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কোনো বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রীয় বিষয়। টিপাইমুখ বাঁধ যেহেতু ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে অবস্থিত, সে কারণে বৃহত্তর সিলেট আগামীতে একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবে। এ নিয়ে খোদ ভারতেই গবেষণা হয়েছে। মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ সাইন্স বিভাগের শিক্ষক ড. সইবাম ইবোটমবির (Soibam Ibotombi) গবেষণার অংশবিশেষ উল্লেখ করতে চাই। তিনি লিখেছেন, 'The trend of earthquakes shows that the regions which have experienced earthquakes in the past are more prone to it, the magnitude of future earthquakes may be uniform to the past ones, and the earthquake occurrence, geological data and tectonic history all have close correlation. The Tipaimukh Dam site has been chosen at the highest risk seismically hazardous zone'। এই কথাগুলো যখন ভারতীয় গবেষকদের মুখ থেকে বের হয়, তখন আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। ভারত টিপাইমুখ বাঁধের কাছাকাছি ফুলেরতাল নামক স্থানে (বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের দুইশ’ কিমি উজানে) একই সঙ্গে একটি ব্যারাজও নির্মাণ করছে। এর অর্থ সমতল ভূমিতে (বাঁধ নির্মিত হয় উচ্চতায়, বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য) পানি ধরে রাখা ও তা দিয়ে কৃষিকাজ করা। বরাক নদী দিয়ে আগামীতে যে পানি প্রবাহ কমবে, এটা তার আরেকটি উদাহরণ। অথচ আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। তা অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি না করেই নিতে হবে। ভারত বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় না নিয়েই টিপাইমুখ বাঁধ নর্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এটা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। রামসার কনভেনশনের (জলা ভূমিবিষয়ক কনভেনশন) ৫ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে কনভেনশনে উদ্ভূত বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রগুলো পরস্পর পরামর্শ করবে এবং একই সঙ্গে জলাভূমির এবং সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের স্বার্থে বর্তমান ও ভবিষ্যত্ নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়ন করবে। কিন্তু ভারত তা করেনি। টিপাইমুখ বাঁধ আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশন কিংবা জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।
সুতরাং আজ যখন টিপাইমুখ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, তখন আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। সরকারের উচিত উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হওয়া। এমনকি প্রয়োজনে আসাম সরকারের কাছ থেকেও এর ব্যাখ্যা চাওয়া যেতে পারে। আসাম সরকার যদি টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প কার্যকর করে, তাহলে তা ‘বন্ধুত্বের’ স্পিরিটের পরিপন্থী। আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ওই সফরে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে সরকারি পর্যায়ে বলা হচ্ছে। আলোচনায় এখন টিপাইমুখও অন্তর্ভুক্ত হোক। কেননা বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ ও বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। আমরা নিপকোর চেয়ারম্যানের বক্তব্যকে হালকাভাবে নিতে চাই না। নিপকোর চেয়ারম্যানের বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যা থাকা উচিত। কেন এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এ কথাগুলো বলেছেন, তা আমাদের জানা প্রয়োজন। আমি অতীতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তার ওপর ভরসা রাখতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, ভারতীয় নেতারা বাংলাদেশর স্বার্থকে গুরুত্ব দেবেন। অতীতে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা জরুরি। এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এ সম্পর্কটা যেন হয় জাতিসংঘের সনদের ২.৭ ধারা অনুযায়ী, যেখানে বলা হয়েছে সমমর্যাদার কথা।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanog@Gmail.com

0 comments:

Post a Comment