রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি (দৈনিক আমার দেশে প্রকাশিত দুই পর্বের শেষ পর্ব)

(গত পর্বের পর)
বর্তমান বাঙলাদেশের বৈদেশিক নীতি বলতে যা বোঝায়
বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণে ভারত এটাকে তখন তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। তারা তখন ট্রানজিট সুবিধা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার দাবি করে। ভারতের যুক্তি—বাংলাদেশ যদি ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার সুবিধা দেয়, তাহলে এ খাতে যা আয় হবে তা দিয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব হবে। ট্রানজিটের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয় (১১ মার্চ ১৯৯৭) এবং ১২ মার্চ (১৯৯৭) নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এ সম্পর্কে একটি সমঝোতা স্মারকেও স্বাক্ষর করেন। তবে তখন তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে ও ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সফর করলেও তার সরকার দক্ষিণ তালপট্টিতে বাংলাদেশের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি। তেলসম্পদসমৃদ্ধ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলটি (ব্লক নং ২১) শেখ হাসিনার সময়সীমায় অনুসন্ধান চালানোর জন্য কোনো লিজ বিডিং হয়নি। পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বরং পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল মোশাররফ কর্তৃক নিউইয়র্কে শেখ হাসিনার সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করায় ও বাংলাদেশী প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বাংলাদেশে বোমা হামলায় ব্যবহৃত বোমার সরঞ্জাম পাকিস্তান থেকে এসেছে বলে মন্তব্য করায় (ডন, ইসলামাবাদ, যুগান্তর ২৩ জুন ২০০১) দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতিই ঘটেছিল। উপরন্তু পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওনা সম্পত্তি আদায় ও বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের (বিহারি) পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারেও কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। ভারত ও পাকিস্তান কর্তৃক পরপর কয়েকটি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর (মে ’৯৮) উত্তেজনা হ্রাসে শেখ হাসিনা এ দুটি দেশের রাজধানী সফর করে কিছুটা হলেও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তারই উদ্যোগে পরে ঢাকায় ত্রিদেশীয় (পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ) শীর্ষ বাণিজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে পরবর্তীকালে অগ্রগতি হয়েছে কম। এ দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমেনি এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশী পণ্যের বাজারও সম্প্রসারিত হয়নি এ দুটি দেশে।

শেখ হাসিনার সময়সীমায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসেন। এর আগে তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছিলেন। ক্লিনটনের সফর ছিল নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় পাওয়া। যদিও এটা স্পষ্ট, শেখ হাসিনা তার বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যোগ দেন। ক্ষুদ্রঋণের ধারণা বাংলাদেশের, যা কি-না এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার সময়সীমায়ই বাংলাদেশ (১৯৯৬) সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যা ওয়াশিংটনে সমাদৃত হয়। বাংলাদেশ এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত ‘সোফা’ চুক্তি (স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস অ্যাগ্রিমেন্ট) প্রত্যাখ্যান করলেও ‘হানা’ চুক্তি (হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিসট্যান্স নিড্স অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করে (২৯ জুলাই ’৯৮)। ‘হানা’ চুক্তির ধরন মানবিক। গত ৯ জুলাই ২০০১ মার্কিন কমান্ডার (প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের) অ্যাডমিরাল বেয়ারের বাংলাদেশ সফরের সময় ‘সোফা’ চুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র আবারও তাদের আগ্রহ দেখায় এবং অ্যাডমিরাল বেয়ার বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সেনা মোতায়েনের কথাও বলেন। ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে একটি সমঝোতা স্মারকের পর ‘পিসকোর’ও বাংলাদেশে আসে। কিন্তু পরে ‘পিসকোর’ বাংলাদেশে তাদের কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নেয়।

সরকার গঠন করার পর তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির আলোকে বাংলাদেশের জন্য চীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর। কিন্তু এ ধারাবাহিকতা তিনি ধরে রাখতে পারেননি। বিশেষ করে, প্রথমবারের মতো ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা ও দ্বিতীয়ত, চীনের বদলে রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করা (মোট মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার), এ দুটি ঘটনায় চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উষ্ণতায় কিছুটা ভাটা পড়ে। বাংলাদেশের বিমানবাহিনী অনেকটা চীনা যুদ্ধবিমাননির্ভর। চীনও মিগ-২৯এর চীনা ভার্সন সরবরাহ করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ চীনের বদলে রাশিয়াকে বেছে নিয়েছিল।

শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ দুটি আঞ্চলিক জোটে যোগ দেয়। এর একটি ডি-৮ ও অপরটি বিমসটেক। বাংলাদেশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও তুরস্ক নিয়ে ডি-৮ গঠিত। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে তুরস্কে ডি-৮-এর প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মুসলমানপ্রধান এ দেশগুলো ১০টি ক্ষেত্রে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের লক্ষ্যে ডি-৮ গঠন করে। ৮টি দেশের মধ্যে ১০টি ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয় স্থান পায়। এগুলো হচ্ছে বাণিজ্য, শিল্প, টেলিযোগাযোগ, তথ্য, অর্থ, ব্যাংকিং ও প্রাইভেটাইজেশন, পল্লী উন্নয়ন, কৃষি, জ্বালানি ও স্বাস্থ্য। মূলত এই দেশগুলোর দারিদ্র্য বিমোচন ও নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের লক্ষ্যেই এই জোট গঠিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়ন ও ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম ডি-৮-এর কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকায় ডি-৮-এর দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। অন্যদিকে বিমসটেক (ইওগঝঞঊঈ) গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে। পরে মিয়ানমার এ জোটে যোগ দেয়। বিমসটেক (নতুন নাম ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিকাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন’) বলা হচ্ছে আসিয়ানের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সেতুবন্ধন। বলা হচ্ছে ‘বিমসটেক’ মত্স্যসম্পদ, কৃষি উত্পাদন ও বস্ত্রশিল্প বিষয়ে ব্যবসায় সমন্বয় সাধন করবে। পরিবহন ও পর্যটন খাতও ‘বিমসটেকে’র আওতাভুক্ত। চার জাতির সমন্বয়ে একটি যৌথ বিমান সংস্থা গঠনের ব্যাপারে ইতোমধ্যে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
শেখ হাসিনা তার প্রথম সরকারের আমলে বৈদেশিক নীতিতে ‘অর্থনৈতিক কূটনীতি’র ওপর গুরুত্ব আরোপ করলেও এতে তিনি সফল হয়েছিলেন তা বলা যাবে না। বাংলাদেশের ৪৬টি কূটনৈতিক মিশনের মধ্যে ২০০০-০১ অর্থবছরে ১৯টিই নির্ধারিত রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়। তবে ২৬টি মিশন লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে (আজকের কাগজ, ২ জুলাই ২০০১)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পোশাক শিল্পের কোটা বজায় রাখার ব্যাপারেও কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বিশ্বব্যাংক বেশক’টি দেশের ঋণ মওকুফ করে দিলেও বাংলাদেশ ওই দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে ব্রাসেলসের এলডিসির শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ বড় ভূমিকা পালন করে। তার সময়ে বিগত পাঁচ বছরে শেখ হাসিনার ঘনঘন বিদেশ সফর আলোচনায় আসে। মোট ৪৯ বার তিনি বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন। এসব সফরকালে তিনি সোয়া আট মাস বিদেশে কাটিয়েছিলেন। সর্বাধিক ৭ বার তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। ১৯৯৭ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত একনাগাড়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন (মিয়ামিতে মেয়ের সন্তান জন্মদান উপলক্ষে) ২৩ দিন। ওই সময় মিয়ামিতে প্রধানমন্ত্রীর একটি কার্যালয় স্থাপন করতে হয়েছিল। অতীতের যে কোনো সরকারপ্রধানের চেয়ে তিনি তিন-চারগুণ বেশি বিদেশ সফর করেছেন। প্রায় ৬ লাখ কিলোমিটার তিনি বিমান ভ্রমণ করেন (আজকের কাগজ, ৩ জুলাই ২০০১)।

ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে শেখ হাসিনার উদ্যোগের বড় প্রমাণ হচ্ছে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা বা ওআইসির সম্মেলনে যোগদান (পাকিস্তান, ১ মার্চ ১৯৯৭)। ওআইসির সম্মেলনে তার দেয়া ভাষণ বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছিল। তিনি তার ভাষণে ৭-দফা কর্মপরিকল্পনা পেশ করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল— ১. ওআইসির সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব ও কর্মপরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, ২. একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত লক্ষ্যকে সামনে রেখে সদস্য দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি বাণিজ্য এলাকা প্রতিষ্ঠা, ৩. উদ্বৃত্ত সম্পদের দেশগুলো থেকে সম্পদ ঘাটতির দেশগুলোর জন্য উন্নয়ন তহবিল গঠন, জনশক্তি ও প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা, ৪. ইসলামী উম্মাহর স্বার্থে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক বিষয়গুলোর ওপর সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও এর অবস্থান সংহত করার বাস্তবসম্মত উপায় উদ্ভাবন, ৫. সদস্য দেশগুলোর নিজেদের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমন ও বিরোধ নিরসনের লক্ষ্যে কার্যকর স্থায়ী মধ্যস্থতা সালিশি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ৬. মুসলিম দেশগুলোর মধ্য উত্তেজনা ও বিরোধ সৃষ্টির কারণগুলো প্রতিরোধে কার্যকর কর্মপদ্ধতির সম্প্রসারণ এবং ৭. একুশ শতকে ইসলামী উম্মাহর লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের একটি কার্যকর ও দক্ষ সংস্থা হিসেবে ওআইসি সচিবালয়কে জোরদার করা। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ইসলামী বিশ্বের প্রতি যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই শেখ হাসিনা এ ভাষণ দিয়েছিলেন।

বেগম জিয়া ও জোট সরকার
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের (২০০১-২০০৬) আমলে পরাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আর তা হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পূর্বমুখিতা। পূর্বের দেশগুলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে উপেক্ষিত ছিল। এ প্রসঙ্গে মিয়ানমারের কথা উল্লেখ করা যায়। মিয়ানমার বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ এবং মিয়ানমারের গ্যাস ও তেলসম্পদ আমাদের উন্নয়নে যথেষ্ট কাজে লাগতে পারে। কিন্তু গত ৩৬ বছরে এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একরকম উপেক্ষিত ছিল। বেগম জিয়ার সময়সীমায় মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা হয়। বেগম জিয়ার সময়সীমায় ‘কুনমিং উদ্যোগে’র কথা শোনা যায়। কুনমিং চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী। চট্টগ্রাম থেকে কুনমিংয়ের বিমানপথ মাত্র এক ঘণ্টার, ব্যাংককের সঙ্গে বিমানপথে যে দূরত্ব, তার চাইতেও কম। তাই চীন ২০০১ সালে চীনের ইউনান প্রদেশ, মিয়ানমার, ভারতের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু জোটটি গঠিত হয়নি। কেননা ভারতের আগ্রহ এখন ১০ সদস্যবিশিষ্ট আসিয়ানের দিকে। ভারত কুনমিং উদ্যোগের পরিবর্তে মেকং-গঙ্গা সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। নভেম্বরে (’০৭) ভারত আসিয়ানের সঙ্গে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য একটাই—তা হচ্ছে আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করা। জোট সরকারের আমলে এ লক্ষ্যেই বাংলাদেশ আসিয়ানের আঞ্চলিক ফোরামের (এআরএফ) সদস্যপদ পেয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী সরাসরি আসিয়ানের সদস্য হওয়া যায় না। সদস্যপদ পেতে হলে প্রথমে এআরএফের সদস্য হতে হবে। তারপর ‘ডায়ালগ পার্টনার’, তারপর সদস্যপদপ্রাপ্তি। ভারত ইতোমধ্যে ‘ডায়ালগ পার্টনারে’র সম্মান পেয়েছে।

বাংলাদেশ এ লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে। জোট সরকারের আমলে এআরএফের সদস্যপদপ্রাপ্তি ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য বড় ধরনের সাফল্য। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এআরএফের ২৬তম সদস্য। জোট সরকারের সময় বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। কেননা মিয়ানমারে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ রয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এই সম্পদ দিয়ে বাংলাদেশ তার জ্বালানি সঙ্কটের একটা সমাধান খুঁজে পেতে পারে। মিয়ানমারের গ্যাসের ব্যাপারে ভারত আগ্রহ দেখিয়েছিল (বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে) কিন্তু জোট সরকার তাতে রাজি হয়নি। এমনকি চীনের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা এখন মিয়ানমার মেটাবে। মিয়ানমারের গ্যাস যাচ্ছে ইউনান প্রদেশে। ভারত একসময় উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরাসরি মিয়ানমারের গ্যাস নিতে চেয়েছিল। এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তও হয়েছিল। পরে ভারত পিছিয়ে যায়। আমাদের বৈদেশিক নীতির একটি ব্যর্থতা যে আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারিনি। শুধু তা-ই নয়, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় (২০০৭-২০০৮) সমুদ্রসীমা নিয়ে দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধের মতো একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে সমস্যা আছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গেছে।

শেখ হাসিনা ও মহাজোট সরকার
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠিত হয়েছে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু সরকার পরিচালনার শুরুতেই বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি অনেকটা একমুখী হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরও বাতিল হয়েছে।

মহাজোট সরকারের পররাষ্ট্রনীতির একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে গিয়ে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। তবে বলা হচ্ছে, এই ট্রানজিট সুবিধা বহুপাক্ষিক আলোকে দেখা হবে। অর্থাত্ নেপাল ও ভুটানও সেই ট্রানজিট সুবিধা পাবে। ভারত এই দেশ দুটোকে সেই ট্রানজিট সুবিধা দেবে, শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দরও ব্যবহার করতে পারবে ভারত। প্রধানমন্ত্রী যখন জানুয়ারিতে (২০১০) নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন, তখন এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ওই সময় ওয়াদা করেছিলেন বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে আর্থিক সাহায্যের। সেই সাহায্য কোন কোন খাতে দেয়া হবে, সে সংক্রান্ত একটি চুক্তিও ঢাকায় এরই মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতের ওই ঋণচুক্তি বাংলাদেশে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। দেখা গেছে, ওই ঋণচুক্তির আওতায় যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে, তাতে লাভবান হবে ভারত, বাংলাদেশ নয়। অথচ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে, সে ব্যাপারে আদৌ তেমন অগ্রগতি হয়নি। যেমন বলা যেতে পারে গঙ্গার পানি চুক্তি ও তিস্তার পানি বণ্টনের কথা। গত ১ জানুয়ারি (২০১১) গঙ্গার পানি চুক্তির ১৫ বছর শুরু হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ যে পরিমাণ পানি পাওয়ার কথা, তা তো পায়ইনি, বরং পানিপ্রাপ্তির পরিমাণ দিন দিন কমেছে। জানুয়ারির (২০১০) ৩ কিস্তিতে বাংলাদেশ ৫৬ হাজার ৩৭১ কিউসেক পানি কম পেয়েছে।

২০০৯ সালে এই সময় কম পেয়েছিল ৬০ হাজার কিউসেক (নয়া দিগন্ত, ১২ ডিসেম্বর, ২০১০)। এ ক্ষেত্রে চুক্তি অনুযায়ী চুক্তি পর্যালোচনা করার সুযোগ আছে; কিন্তু বাংলাদেশ এই উদ্যোগটি নেয়নি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে; কিন্তু ফলাফল শূন্য। ভারতের তেমন আগ্রহ লক্ষ করা যায়নি। যৌথ নদী কমিশনের আলোচনায় বাংলাদেশের ব্যর্থতা এখানেই যে, বাংলাদেশ তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে কোনো চুক্তিতে যেতে ভারতকে রাজি করাতে পারেনি। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। নানা ধরনের ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশী পণ্য ভারতের বাজারে ঢুকতে পারছে না। সার্ক এখন অকার্যকর। স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী কলকাতায় ভারতের এই ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন (যুগান্তর, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১০)। ৬.৫ কিলোমিটার সীমান্ত এখনও চিহ্নিত হয়নি। বন্ধ হয়নি বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা। তবে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে ট্রানজিটের ক্ষেত্রে। সেখানে ভারতের স্বার্থ বেশি ও ভারত এ কারণেই ঋণ দিয়েছে। যেসব প্রকল্পের জন্য ঋণ দেয়া হয়েছে, তার সব ক’টিতে যে আমাদের ‘স্বার্থ’ জড়িত, তা আমি মনে করি না। ঢাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। এ খাতে অন্য কোনো দেশ থেকেও আমরা সাহায্য পেতাম। তবে তাতে হয়তো সময় লাগত। ভারত থেকে আমরা ঋণের টাকায় ডবল ডেকার বাস ও আর্টিকুলেটেড বাস কিনব। কিন্তু বাসের মূল্য নির্ধারণের কোনো সুযোগ আমাদের নেই।

ভারতীয় উত্পাদনকারীরা যে মূল্য নির্ধারণ করে দেবে, আমাদের তা মানতে হবে। যেসব প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে তাতে ব্যয় হবে ৬০০ কোটি ডলার। বাকি ৪০০ মিলিয়ন ডলারের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়ন ঠিকমতো হয় না। আর এ ক্ষেত্রে এমনটা যদি হয় তবে ঋণের এই চুক্তি কাজে আসবে না। কিন্তু ঋণের টাকা যদি অব্যবহৃত থাকে, তাহলে অতিরিক্ত সুদ গুনতে হবে। সুদের হার নিয়ে লুকোচুরির কিছু নেই। ওই হার কত (১ দশমিক ৭৫), কিংবা এই হার বিশ্বব্যাংক বা এডিবির হারের চাইতে (পয়েন্ট ২৫ থেকে ১ ভাগ) বেশি না কম, এই বিতর্কের চাইতে যা বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত, তা হচ্ছে আমরা এ থেকে কতটুকু উপকৃত হব। ঋণের টাকায় ফ্লাইওভার হবে। উপকরণ প্লাস উপদেষ্টা নিতে হবে ভারত থেকে। ফ্লাইওভার তৈরি করার উপদেষ্টা আমাদের দেশেই আছেন; কিন্তু তাদের ব্যবহারের সুযোগ নেই। এ কথা প্রযোজ্য নদী খননে ড্রেজার ক্রয়ে। ঋণের টাকায় যেসব স্থলবন্দর নির্মিত হবে, তাতে আমাদের রাস্তাঘাট প্রশস্ত হবে, কিন্তু ব্যবহার করবে ভারতীয় হেভি ট্রাক ও ২৮ চাকার ওডিসি বা ‘ওভার ডাইমেনশনাল কার্গো’। আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি। এখন ট্রানজিটের আওতায় হেভি ট্রাক চলাচল করতে হলে প্রশস্ত রাস্তা তো চাই। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরও ব্যবহার করবে ভারতীয় ট্রাক। এ জন্যও স্থলবন্দরের উন্নতি দরকার; কিন্তু কেউ একজন চিন্তা করলেন না চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের যে অবস্থা, তাতে ভারতীয় কনটেইনার হ্যান্ডল করার ক্ষমতা এই বন্দরের রয়েছে কি না?

সবচেয়ে বড় সমস্যা, চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে রয়েছে নানা রাজনীতি। যেখানে বহির্নোঙরে কোনো কোনো জাহাজের অবস্থান সময় ১৫ দিন পার হয়ে যায়, জেটিতে ভেড়ার পর কনটেইনার খালাসে লেগে যায় ৭-৮ দিন, সেখানে আমরা আগামীতে ভারতীয় কনটেইনার হ্যান্ডল করতে দিই কীভাবে? এতে কি বাংলাদেশী আমদানি-রফতানি ঝুঁকির মুখে থাকবে না? বাংলাদেশ প্রায় ১১শ’ কোটি টাকা খরচ করে বাংলাদেশ ও ভারত অংশে মোট ১২০ কিলোমিটার গ্রিডলাইন স্থাপন করে ৩ বছর পর ভারত থেকে বিদ্যুত্ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ এই টাকা ব্যয় করে কি আমরা নিজস্ব বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করতে পারতাম না? আমাদের বিদ্যুত্ দরকার। এই বিদ্যুতের একটা সম্ভাবনা রয়েছে নেপালে। সেখানে ত্রিদেশীয় (নেপাল-বাংলাদেশ-ভারত) উদ্যোগ একটা বড় সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ এটি চাইলেও, ভারত তা চাইছে না। প্রণব বাবু ঢাকায় বলে গেলেন বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানে যাওয়ার ট্রানজিট পাবে। ১৯৯৬-২০০১ সালে তোফায়েল আহমেদ যখন বাণিজ্যমন্ত্রী, ঢাকঢোল পিটিয়ে সেই ট্রানজিট তিনি চালু করেছিলেন। টিকে ছিল কি? মাত্র ১৫ মিনিট। তারপর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পরপরই আমরা বেরুবাড়ী দিয়েছিলাম। এ জন্য সংবিধান সংশোধনী (তৃতীয় সংশোধনী, ১৯৭৪) পর্যন্ত করতে হয়েছিল; কিন্তু আমরা বিনিময়ে আজও তিন বিঘা ফেরত পাইনি। আজও সীমান্ত চিহ্নিত হয়নি। সমুদ্রে আমাদের যে অধিকার, সেই অধিকারও আমরা পাইনি ভারতের আপত্তির কারণে। তাই মহাজোট সরকারের আড়াই বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের যে ‘উন্নতি’, তা নিয়ে কথা উঠবেই। ভারত যদি একতরফা সুবিধা আদায় করে নেয়, তাহলে তা বিতর্কের মাত্রা বাড়াবে। ভারতের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরতা আমাদের স্বার্থ তথা পররাষ্ট্রনীতির পরিপন্থী। প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করে পররাষ্ট্রনীতিতে একটি ‘ব্যালান্স’ আনার চেষ্টা করছেন। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের স্বার্থেই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে হবে। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নত করা দরকার। এই সম্পর্ক নানা জটিলতায় আটকে আছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী একটি আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মাঝে অন্যতম হলেও পরিবেশ কূটনীতিতে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পেরেছে বলে মনে হয় না।

উপসংহার
বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থটাই হলো প্রধান। এই জাতীয় স্বার্থ বাংলাদেশে সবসময় রক্ষিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। সনাতন বৈদেশিক নীতিতে বিশ্বজুড়েই ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ, জ্বালানি, বিদেশে কর্মসংস্থান ইত্যাদি ‘অপ্রচলিত ধারণা’ এখন বৈদেশিক নীতিতে প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশকে ২০২১ সাল সামনে রেখে (যখন বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর) তার বৈদেশিক নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বৈদেশিক নীতি ঢেলে সাজাতে হবে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি ও বিদেশে বাংলাদেশী কর্মীদের কর্মসংস্থানের বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com
সূত্রঃ আমার দেশ, ০৩/০৭/১১]

0 comments:

Post a Comment