রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যে সিদ্ধান্তকে সবার স্বাগত জানানো উচিত

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক পদে এখন থেকে লিখিত পরীক্ষা নেয়া হবে। একটি বয়সসীমাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জুন অনুষ্ঠিত ৪৭৫তম সিন্ডিকেটে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের অতিরিক্ত সাধারণ সভায় শিক্ষকদের পদোন্নতি ও শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই সিন্ডিকেট এ সিদ্ধান্ত নিল। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আমি মনে করি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আজ যে সিদ্ধান্তটি দিল, তা দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসরণ করা উচিত।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান সরকারের সময় দলীয় বিবেচনায় প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক পদে প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এদের যোগ্যতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে ঠিক তেমনি প্রশ্ন উঠেছে এদের পাঠদানের ক্ষমতা নিয়ে। এ দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে! অনেক ক্ষেত্রেই পদ সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কোন অনুমতি ছিল না। মঞ্জুরি কমিশনের আইন অনুযায়ী কমিশনের অনুমতি ছাড়া শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা যায় না এবং সেই পদে শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ মঞ্জুরি কমিশনের এ আইনের প্রতি থোড়াইকেয়ার করেছে। এ নিয়ে সংবাদপত্রগুলোতে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের একটা অংশ সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত করেছে।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি তার একাধিক বক্তৃতায় শিক্ষার গুণগতমানের কথা বলেছেন। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয় তা হচ্ছে ‘দলীয় বিবেচনায়’ নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দিয়ে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব কিনা? অনেকেই স্বীকার করবেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাকরির ক্ষেত্র হতে পারে না। এখানে শিক্ষক নিয়োগ হওয়া উচিত যোগ্যতার বলেই। আর যোগ্যতা নির্ধারণের মাপকাঠি হওয়া উচিত নিরপেক্ষভাবে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একজন পূর্ণকালীন সদস্য থাকার সুবাদে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেই আলোকেই আমি একটা সুপারিশ রাখতে চাই। আর তা হচ্ছে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে তিন স্টেজে। অর্থাৎ লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা এবং উপস্থাপনা। বলা ভালো, কোন কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। এতে সুবিধা হল : ১. কোন দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ থাকে না; ২. এতে বিতর্ক কম হয়। কেননা মেধাতালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকারীও ওই তিনটি স্টেজ অতিক্রম করে যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন; ৩. এ ধরনের নির্বাচনে ‘ব্যক্তির’ কোন ভূমিকা থাকে না। আমি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য থাকাকালীন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার নিয়ম চালু করেছিলাম (সেই নিয়ম বোধকরি এখন আর অনুসরণ করা হয় না)।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা একাধিক। শিক্ষকদের নিয়োগে ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে একক কোন নিয়মনীতি নেই। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক নিয়ম। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতির নীতিমালা এক নয়। এমনকি শিক্ষক নিয়োগ কমিটির গঠন কাঠামোও এক নয়। ফলে এটা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায় না, বরং নানা জটিলতার সৃষ্টি করে। এজন্য একটি একক নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। একক নীতিমালা না থাকার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্যও তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় আইন এখন শুধু ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকর (ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম)। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে ওই আইনেরও লঙ্ঘন হচ্ছে (যেমন সিনেট কর্তৃক ভিসি প্যানেল নির্বাচন, সিনেট নির্বাচন না হওয়া ইত্যাদি)। আমরা মঞ্জুরি কমিশনে থাকাকালীন একটি অভিন্ন আইন তৈরি করেছিলাম। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারিনি। বর্তমান মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অত্যন্ত ‘ডায়নামিক’ ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ‘ব্যক্তিগত সম্পর্ক’ও রয়েছে। যতদূর জানি, তিনি এখন অবধি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি চাইলে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ইতিপূর্বে প্রণীত অভিন্ন নীতিমালাটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। সেখানে শিক্ষক নিয়োগের তিন স্তরের প্রক্রিয়াটি নেই। এটা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আরও তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে আমি মনে করি। এক. পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না দিয়ে ন্যূনতম এক বছর বিভাগে একজন সিনিয়র শিক্ষকের অধীনে থেকে (টিচিং অ্যাসিসটেন্ট) অভিজ্ঞতা অর্জন করা। দুই. ‘ভিজিটিং প্রফেসর’ হিসেবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনিয়র শিক্ষকদের পাঠদান ও গবেষণার সুযোগ দেয়া। আমি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, যেখানে শুধু প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকদের দিয়ে বিভাগটি পরিচালিত হচ্ছে। এটা ভালো নয়। এতে শিক্ষার মানের কোন উন্নতি ঘটবে না। তিন. শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি থাকতে হবে মঞ্জুরি কমিশনের হাতে। প্রয়োজনে একটি পিএসসি ধরনের কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে। যাদের কাজ হবে সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। এ কমিশনের হাতে সরকারি কলেজের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াটিও ছেড়ে দেয়া যেতে পারে, যা কিনা এখন পিএসসি সম্পন্ন করছে। এতে করে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। নামটি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য আরেকটি কাঠামো দরকার। বর্তমানে মাত্র একজন সদস্য প্রায় ৫৪টি (আরও আসছে প্রায় ২০টি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করেন। এটা অসম্ভব ব্যাপার। সঙ্গত কারণেই তাই ইউজিসির মডেলে আরেকটি কমিশন গঠন করা যুক্তিযুক্ত। সেই সঙ্গে ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ গঠন করাও জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নির্ধারণ করে রেটিং প্রদান করবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কোন ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ নেই। এ কাউন্সিল গঠনের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। কিন্তু এর কোন বাস্তবায়ন নেই। বর্তমান ইউজিসির চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সিদ্ধান্ত আমাদের চিন্তার দুয়ারকে খুলে দিয়েছে। শিক্ষক সমিতির বিরোধিতা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। আমার বিশ্বাস শিক্ষক সমিতি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করতে পারবেন যে, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনা না হলে উচ্চশিক্ষার মানের কোন উন্নয়ন সম্ভব নয়। তরুণ শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণটা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি জরুরি তাদের বিদেশে পাঠিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। এক্ষেত্রে সরকার তথা বিশ্বব্যাংকের কাছে অর্থ সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। তরুণ শিক্ষকরা আমাদের সম্পদ। সিনিয়র শিক্ষকরা শিক্ষকতা থেকে বিদায় নিয়েছেন। আগামী পাঁচ-সাত বছরে আরও অনেক গুণী শিক্ষক অবসরে যাবেন। কিন্তু যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণ শিক্ষকদের আমরা দেখছি না, যারা জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। সুতরাং তরুণ শিক্ষকদের সরকারি খরচে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো জরুরি হয়ে পড়েছে। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্তটি বিবেচনায় নিয়ে ইউজিসি যদি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে, আমার বিশ্বাস শিক্ষার মান উন্নয়নে তা বড় ধরনের সাহায্য করবে।

পুনশ্চ গত ২৮ মে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পর্ষদের ১২৫তম সভায় উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, সমাজকল্যাণ বিভাগ, স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্তটি যুগান্তরকারী। দেরিতে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেয়ায় উপাচার্যকে ধন্যবাদ জানাই। ইতিমধ্যেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্যের আমলে ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউট ও বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ চালু হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য
www.tsrahmambd.blogspotcom
[সূত্রঃ যুগান্তর, ২৭/০৭/১১]

0 comments:

Post a Comment