রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে বাংলাদেশ


কোন পথে যাচ্ছে এখন বাংলাদেশ? এ প্রশ্ন যে আজ সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেই উঠেছে তা নয়। বরং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে উচ্চ আদালতও বিব্রত, তা সম্প্রতি প্রমাণিত হয়েছে। গত ১২ জুলাই পুলিশের পিটুনিতে আহত বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের জামিনের আবেদনের শুনানিকালে হাইকোর্টে বলেছেন, 'দয়া করে জাতিকে উদ্ধার করুন। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে জাতি উদ্বিগ্ন। এই সঙ্কটপূর্ণ অবস্থা থেকে জাতি মুক্তি চায়। মুক্তি দিন।' হাইকোর্টের এই আবেদনটি ছিল সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি (আমার দেশ, ১৩ জুলাই, ২০১১)। হাইকোর্টে জামিনের আবেদনের ওপর শুনানি করেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হক। দেশের পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে হাইকোর্টের বিচারপতিরা এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন। ইতোমধ্যে দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। সংবিধানে ৫১ দফা সংবলিত পঞ্চদশ সংশোধনী যোগ হয়েছে। এর প্রতিবাদে বিএনপি তথা চারদল প্রথম দফায় ৩৬ ঘণ্টা ও দ্বিতীয় সপ্তাহে টানা ৪৮ ঘণ্টা হরতাল পালন করেছে। ইসলামিক দলগুলোও আলাদাভাবে আরো একটি ৩৬ ঘণ্টার হরতাল পালন করেছে, যার প্রতি বিএনপির সমর্থন ছিল। এরপর বিএনপি গণঅনশন কর্মসূচি পালন করেছে। খালেদা জিয়া এখন বলছেন ঈদের পর সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করা হবে। স্পষ্টতই হরতাল, লংমার্চ ইত্যাদি আমরা প্রত্যক্ষ করবো। এর অর্থ হচ্ছে ঈদের পর পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। সরকার গঠিত হয়েছে মাত্র ৩০ মাস। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকবে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। সংবিধানে যদি নতুন করে পরিবর্তন না আসে, তাহলে ২০১৩ সালের শেষের দিকে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু তার আগেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সবচেয়ে যে বিষয়টি বেশি করে বিতর্কের ঝড় তুলছে, তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল। অথচ শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালের মাগুরার উপ-নির্বাচনের পর এককভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিল। এখন তার সরকারের আমলেই তা বাতিল হলো। বলা ভালো মাত্র ১৩ দিনের সংসদে (৬ষ্ঠ সংসদ) সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন খালেদা জিয়া। পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আজ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেল। আর বিএনপি চাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের। হরতালের এটা অন্যতম একটি ইস্যু। বাস্তবতা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে পরবর্তী দুটো সংসদ নির্বাচন (দশম ও একাদশ) 'নিরপেক্ষ' একটি সরকারের মাধ্যমে আয়োজন করা সম্ভব। এটা সংবিধানের কোনো অংশ হবে না। কিন্তু সংসদে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। সরকার এ ব্যাপারে সংসদে একটি প্রস্তাব আনতে পারে। অথবা শরিক দলের পক্ষ থেকেও যে কেউ এ ধরনের একটি প্রস্তাব আনতে পারে, যাতে সরকারের সমর্থন থাকবে। এটা একটা কমপ্রোমাইজিং ফর্মুলা, বিএনপিকে আস্থায় নেয়ার একটি উদ্যোগ হতে পারে। তাতে করে অন্তত হরতালের রাজনীতি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারবো। এই 'নিরপেক্ষ সরকার'-এ কারা থাকবেন, কাঠামো কী হবে, তা বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক করতে হবে। 'নিরপেক্ষ' সরকারের কাঠামোর ব্যাপারে সংসদের স্পিকারও একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। সুশীল সমাজকেও উৎসাহিত করা যেতে পারে একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করতে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে ফর্মুলা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত উপস্থাপন করেছেন, তা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কেননা ওই ফর্মুলা অনুযায়ী শেষ ৯০ দিন তো মহাজোট সরকারই ক্ষমতায় থেকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দলীয়ভাবে নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্ন উঠবে এবং সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া যাবে না। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলা হচ্ছে। এখন পঞ্চদশ সংশোধনীবলে নির্বাচন কমিশনারদের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তা যথেষ্ট নয়। প্রথমত বর্তমান সরকারই আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে সিইসি তথা নতুন কমিশনারদের নিয়োগ দেবে। সঙ্গত কারণেই তাই দলীয় আনুগত্যের প্রশ্ন উঠবে।
সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অবসরের পর রাজনীতি করার প্রবণতা বেড়েছে। তাদের আনেকেই বিশেষ করে বেসামরিক আমলারা ক্ষমতায় থাকার সময়ই একটি 'বিশেষ সম্পর্ক' গড়ে তোলেন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে কেউ নেতা-নেত্রীকে খুশি করেন। এরা যখন এ ধরনের সাংবিধানিক পদে নিয়োগ পান, তখন তাদের 'আনুগত্য' নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান কাঠামোয় নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ_ এটা বলা যাবে না। অর্থের জন্য তাদের সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হয়। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব 'ক্যাডার' তৈরি হয়নি, যারা নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে সরকারি প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। যতদিন পর্যন্ত না নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল থাকবে এবং আইন এদের নির্বাচন পরিচালনায় যথেষ্ট ক্ষমতা দেবে, আর্থিক স্বাধীনতা দেবে, সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের নিরপেক্ষ 'মেকানিজম' তৈরি হবে, ততদিন পর্যন্ত নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ইভিএম মেশিনও গ্রহণযোগ্য নয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র তা ব্যবহৃত হয়নি। আমাদের দেশের নিরক্ষরতা, প্রযুক্তি বা জানার ব্যর্থতা, ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত ব্যক্তিদের ভূমিকা ও সর্বোপরি প্রযুক্তি কারচুপি নির্বাচনে ইভিএম মেশিনে ব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। সিইসি 'অতি উৎসাহ' ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে তার সাম্প্রতিক বক্তব্য বিতর্কের মাত্রা বাড়াবে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এখন সংবিধানের অংশ। এটা নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু এটা আর পরিবর্তন করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে শুধু সংসদই পারে ষোলতম সংশোধনী এনে সংবিধানকে পুনরায় আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে। কিন্তু তাও খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। কেননা সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ায় (১৪২ আ) পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে ৭(খ) যোগ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, 'এ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহাই কিছু থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথমভাগের সব অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয়ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশভাগের অনুচ্ছেদ ১৫০সহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলী সংযোজন পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।' সংবিধানে ৭ (খ)-এর অন্তর্ভুক্তি এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে এবং সংবিধান সংশোধন কমিটির আসল উদ্দেশ্যকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। কেননা এর ফলে 'জাতির পিতা' শিরোনামের অনুচ্ছেদ ৪-এ যা কিছু সংযোজিত হয়েছে (ছবি প্রদর্শন) তাতে সংশোধনী আনা যাবে না। ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ইত্যাদি সংযুুক্ত (অনুচ্ছে ১৫০.২) সংশোধন কঠিন হবে। এমনকি রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি, জাতি হিসেবে বাঙালি ও নাগরিকতায় বাংলাদেশি বাতিল করা কিংবা 'আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' পুনঃস্থাপন করা সহজ হবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য 'জাতির পিতা', 'স্বাধীনতার ঘোষণা' ইত্যাদি প্রশ্নে জাতি এখনো বিভক্ত থেকে গেল। স্বাধীনতার বীর সৈনিকদের নিয়ে যে জাতি ৪০ বছর পরও 'বিতর্ক করে, সে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কামুক্ত হওয়া যায় না।
হরতাল কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। আবার সরকারের কঠোর মনোভাবও কোনো সমাধানের পথ তৈরি করে দেবে না। আলোচনাই একমাত্র সমাধান। পৃথিবীর বড় বড় সমস্যা আলোচনার টেবিলেই সমাধান হয়েছে। বিচার মানি কিন্তু 'তালগাছ আমার'_ এই মানসিকতাও পরিবর্তন করতে হবে। সংশোধিত সংবিধানকে সামনে রেখেই এবং উচ্চ আদালতের রায়কে অনুসরণ করেই দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা এই মুহূর্তে জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। না হলে হরতালের যে রাজনীতি শুরু হয়েছে, তাতে জনমত যদি রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে চলে যায়, অবাক হওয়ার কিছু নেই।
অন্তত উচ্চ আদালতের উপরে উল্লেখিত মন্তব্যটি যদি সরকার ও বিরোধী দল গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে, তাহলে সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা 'বল' এখন সরকারের কোর্টে। সরকার যদি কঠোর হয়, যদি সমঝোতার পথ তৈরি করে না দেয়, তাহলে আমরা অচিরেই একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কট প্রত্যক্ষ করবো।
দৈনিক যায় যায় দিন, বৃহস্পতিবার ২১ জুলাই ২০১১ ড. তারেক শামসুর রেহমান: অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment