সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পরপরই তিনি ভারতে যান ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিট সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগ দিয়েছিলেন। ভারতে গোয়ায় ব্রিকসের যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে ভারত ও চীনের মধ্যে মতানৈক্য লক্ষ্য করা গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্রিকস সম্মেলনকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন 'পাকিস্তান বিরোধী' একটা প্লাটফর্ম হিসেবে। তাতে তিনি সফল হননি বলে খোদ ভারতের পত্রপত্রিকাগুলো আমাদের জানাচ্ছে। চীন ও রাশিয়া মোদির 'পাকিস্তান সন্ত্রাসের অাঁতুরঘর' এই বক্তব্যে সায় দেয়নি। একটি প্রশ্ন ইতোমধ্যে উঠেছে, বাংলাদেশ কী এখন ভারতের কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকছে! কেননা যেখানে ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দুই বিলিয়ন ডলার সাহায্যের, সেখানে চীনের প্রতিশ্রুতি ২৪ বিলিয়ন ডলার। ১৯ অক্টোবর ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের এক প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠানে এ ধরনের প্রশ্নেরই মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা তিনজন। নিউইয়র্ক থেকে আমি, ঢাকা থেকে অধ্যাপক আমেনা মোহসিন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম। শ্রোতাদের প্রশ্নের ধরন ছিল অনেকটা এরকমই_ বাংলাদেশ কী এখন চীনের দিকে ঝুঁকছে। ভারতের পত্রপত্রিকায়ও আমি এ ধরনের ইঙ্গিত দেখেছি। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী। এশিয়ার দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় অর্থনীতির দেশ। আর চীন আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। চীনের সঙ্গে সরাসরি কোনো সীমান্ত না থাকলেও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে চীনের সীমান্ত ২০০ কিলোমিটারও হবে না। যেখানে চীনের জিডিপির পরিমাণ ১১ দশমিক ৩৯২ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে ভারতের জিডিপির পরিমাণ ২ দশমিক ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার। সুতরাং দুটো বড় অর্থনীতির দেশ যখন আমাদের পাশে থাকে তখন তা থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সেই আলোকেই রচিত। সুতরাং চীনের প্রেসিডেন্ট যখন বাংলাদেশ সফর করে যান, এর একটি প্রতিক্রিয়া থাকবেই। ওই সফরের সময় বাংলাদেশ চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এটি হচ্ছে 'ব্রেন চাইল্ড'। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে শি জিনপিংয়ের আফ্রিকা সফরও এই আলোকে রচিত হয়েছিল। চীন ইতোমধ্যে 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' বাস্তবায়নের জন্য একটি সিল্ক রোড ফান্ড গঠন করেছে। এই ফান্ডের পরিমাণ ৬২ বিলিয়ন ডলার। চীন-পাকিস্তান যে ইকোনমিক করিডোর গড়ে উঠছে, তাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ১১ বিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে। এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত দেশ এই ফান্ড থেকে সাহায্য পাবে এবং তা দিয়ে মূলত সড়ক ও রেল পথ তৈরি করা হবে। অর্থাৎ অবকাঠামো খাতে চীন এই বরাদ্দ করছে। বাংলাদেশের জন্য এখন এই ফান্ড উন্মুক্ত হবে।
বাংলাদেশ 'ওয়ান বেল্ড ওয়ান রোড' মহাপরিকল্পনায় এখন সংযুক্ত হয়েছে। তবে এতে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে_ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। ভারত এই মহাপরিকল্পনাটি খুব সহজভাবে নিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা ইতোমধ্যে ভারত মহাসাগরে চীন-ভারত ফাঁদ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ভারত-চীন ফাঁদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় ভারত মহাসাগরভুক্ত বিভিন্ন দেশে এই দুটো দেশ নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। জিবুতি, গাওদার, হামবানতোতা (শ্রীলংকা), মিয়ানমার, ইয়েমেন, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ওমান কিংবা কেনিয়াতে চীন নৌঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জিবুতি ও মাদাগাস্কারে নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। ভারত একইভাবে সিসিলি ও মৌরিতুসে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। ২০১৫ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই দ্বীপরাষ্ট্র দুটো সফরের সময় নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা প্রথমবারের মতো জানা যায়। ভারত এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে উঠছে, যা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করবে আগামীতে। ফলে চীনের 'মেরিটাইম সিল্ক রুট' নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তবে আমরা বাংলাদেশের 'জাতীয় স্বার্থ'কে অবশ্যই বিবেচনায় নেব। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে তেলের পাইপ লাইন সংযুক্ত হবে। পারস্য অঞ্চলের জ্বালানি তেল চীন এ পথে খুব অল্প সময়ে এবং মধ্য এশিয়ার তেল চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এই জ্বালানি তেলের ওপর চীন নির্ভরশীল। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্য এশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। একই সঙ্গে চীন এই অর্থনৈতিক করিডোরের সঙ্গে চীনের ইউনান প্রদেশকেও সংযুক্ত করতে চায়। এটা করতে হলে কুনমিং-মান্দালয়-কক্সবাজার সড়কপথ (যাতে পরে কলকাতা সংযুক্ত হবে) নির্মাণ শেষ করতে হবে। ২০১৩ সালে চারটি দেশ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছিল এই সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ২০১৪ সালে চীনে যান তখন তিনি কুনমিংয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন বাংলাদেশ কুনমিং-কক্সবাজার সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহী। অতি সম্প্রতি সৈয়দ আশরাফও বলেছেন বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে। এখন যৌথ ইশতেহারে বিসিআইএস অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়নের জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের লাভ হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পথে চীনা পণ্য আমদানি করতে পারবে। তাতে সময় বাঁচবে ও পণ্যের মূল্য কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হতে পারে। এতে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এই অর্থনৈতিক করিডোর ব্যবহার করে মধ্য এশিয়া থেকে জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) আমদানি করতে পারে। সুতরাং চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' কর্মসূচি চীনের স্বার্থে রচিত ও বাস্তবায়িত হলেও বাংলাদেশের স্বার্থকে একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কক্সবাজারে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হলে চীনের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। চীন কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। এতে আমরা লাভবান হতে পারতাম। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলা (শ্রীলংকার হামবানতোতায় নির্মিত গভীর সমুদ্র বন্দরের ব্যাপারেও চীন নিরাপত্তার প্রশ্নটি তুলেছিল), চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি এবং সর্বশেষ চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা_ সব মিলিয়ে চীনের 'মেরিটাইম সিল্ক রোড'-এর ব্যাপারে একটা প্রশ্ন রেখে গেল। পাঠকদের জানিয়ে রাখি চীনের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় (২০১৪) সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিন্তু তখন তা হয়নি। তখন এর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে মতান্তরের কথা পত্রিকায় ছাপা হলেও মূল বিষয় ছিল ভারতের আপত্তি।
আরো বেশকিছু বিষয় আমাদের গভীরভাবে বিবেচনায় নেয়া প্রযোজন। এক. যেসব প্রকল্পে এই চীনা ঋণ নেয়া হচ্ছে তা আমাদের উন্নয়নে কতটুকু কাজে লাগবে? প্রশ্ন এ কারণেই যে, ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতার বিশদ বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি। দুই. চীনা ঋণের শর্ত ও সুদের হার কতটুকু? এ ক্ষেত্রে ওইসব প্রকল্পে আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে কোনো সহযোগিতা নিতে পারতাম কিনা? আমরা আদৌ বিশ্বব্যাংকের কাছে এ ব্যাপারে অ্যাপ্রোচ করেছিলাম কিনা, এটাও একটা প্রশ্ন। কেননা আমরা এটা মোটামুটিভাবে সবাই জানি যে, বিশ্বব্যাংক সাধারণত সহজ শর্তে ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়। তাদের দেয়া শর্তও সহনীয়। চীনা ঋণে চীনের ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। বিশ্বব্যাংকও তাই করে। কিন্তু চীনা ঠিকাদারদের ক্ষেত্রে কতটুকু সততা ও 'ট্রান্সপারেন্সি' থাকবে সেটা একটা প্রশ্ন বটে। তিন. পদ্মা সেতুতে রেলযোগাযোগ স্থাপনে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এটা ভালো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে 'তৃতীয় কোনো দেশ' এটা থেকে ফায়দা নেবে কিনা? কিংবা এটা ব্যবহার করলে এর 'মডালিটি' কী হবে? চার. পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনা সহযোগিতা আদৌ নেয়া হবে কিনা? কেননা এটি একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান 'আদানি' গ্রুপ নির্মাণ করছে বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে চীনও এই প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করতে চায়। সুতরাং পায়রা বন্দর নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই।
শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্যদিয়ে দুদেশের সম্পর্ক নতুন এক উচ্চতায় উপনীত হলো। এখন দেখতে হবে আগামী দিনগুলোয় আমরা এই সফরকে আমাদের স্বার্থে কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছি। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। ১১ দশমিক ৩৯২ ট্রিলিয়ন ডলারের যে অর্থনীতি, সেই অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি সংযুক্ত হয় তাহলে তা থেকে বাংলাদেশেরই লাভবান হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা ভারতকে উপেক্ষা করে নয়। ভারত ও চীনকে সঙ্গে নিয়েই এবং এক ধরনের 'ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি' অনুসরণ করে আমরা ২০২১ সালের মধ্যেই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারি।
(নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে)Daly jai Jai Din25.10.2016
বাংলাদেশ 'ওয়ান বেল্ড ওয়ান রোড' মহাপরিকল্পনায় এখন সংযুক্ত হয়েছে। তবে এতে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে_ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। ভারত এই মহাপরিকল্পনাটি খুব সহজভাবে নিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা ইতোমধ্যে ভারত মহাসাগরে চীন-ভারত ফাঁদ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ভারত-চীন ফাঁদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় ভারত মহাসাগরভুক্ত বিভিন্ন দেশে এই দুটো দেশ নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। জিবুতি, গাওদার, হামবানতোতা (শ্রীলংকা), মিয়ানমার, ইয়েমেন, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ওমান কিংবা কেনিয়াতে চীন নৌঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জিবুতি ও মাদাগাস্কারে নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। ভারত একইভাবে সিসিলি ও মৌরিতুসে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। ২০১৫ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই দ্বীপরাষ্ট্র দুটো সফরের সময় নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা প্রথমবারের মতো জানা যায়। ভারত এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে উঠছে, যা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করবে আগামীতে। ফলে চীনের 'মেরিটাইম সিল্ক রুট' নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তবে আমরা বাংলাদেশের 'জাতীয় স্বার্থ'কে অবশ্যই বিবেচনায় নেব। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে তেলের পাইপ লাইন সংযুক্ত হবে। পারস্য অঞ্চলের জ্বালানি তেল চীন এ পথে খুব অল্প সময়ে এবং মধ্য এশিয়ার তেল চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এই জ্বালানি তেলের ওপর চীন নির্ভরশীল। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্য এশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। একই সঙ্গে চীন এই অর্থনৈতিক করিডোরের সঙ্গে চীনের ইউনান প্রদেশকেও সংযুক্ত করতে চায়। এটা করতে হলে কুনমিং-মান্দালয়-কক্সবাজার সড়কপথ (যাতে পরে কলকাতা সংযুক্ত হবে) নির্মাণ শেষ করতে হবে। ২০১৩ সালে চারটি দেশ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছিল এই সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ২০১৪ সালে চীনে যান তখন তিনি কুনমিংয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন বাংলাদেশ কুনমিং-কক্সবাজার সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহী। অতি সম্প্রতি সৈয়দ আশরাফও বলেছেন বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে। এখন যৌথ ইশতেহারে বিসিআইএস অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়নের জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের লাভ হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পথে চীনা পণ্য আমদানি করতে পারবে। তাতে সময় বাঁচবে ও পণ্যের মূল্য কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হতে পারে। এতে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এই অর্থনৈতিক করিডোর ব্যবহার করে মধ্য এশিয়া থেকে জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) আমদানি করতে পারে। সুতরাং চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' কর্মসূচি চীনের স্বার্থে রচিত ও বাস্তবায়িত হলেও বাংলাদেশের স্বার্থকে একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কক্সবাজারে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হলে চীনের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। চীন কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। এতে আমরা লাভবান হতে পারতাম। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলা (শ্রীলংকার হামবানতোতায় নির্মিত গভীর সমুদ্র বন্দরের ব্যাপারেও চীন নিরাপত্তার প্রশ্নটি তুলেছিল), চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি এবং সর্বশেষ চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা_ সব মিলিয়ে চীনের 'মেরিটাইম সিল্ক রোড'-এর ব্যাপারে একটা প্রশ্ন রেখে গেল। পাঠকদের জানিয়ে রাখি চীনের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় (২০১৪) সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিন্তু তখন তা হয়নি। তখন এর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে মতান্তরের কথা পত্রিকায় ছাপা হলেও মূল বিষয় ছিল ভারতের আপত্তি।
আরো বেশকিছু বিষয় আমাদের গভীরভাবে বিবেচনায় নেয়া প্রযোজন। এক. যেসব প্রকল্পে এই চীনা ঋণ নেয়া হচ্ছে তা আমাদের উন্নয়নে কতটুকু কাজে লাগবে? প্রশ্ন এ কারণেই যে, ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতার বিশদ বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি। দুই. চীনা ঋণের শর্ত ও সুদের হার কতটুকু? এ ক্ষেত্রে ওইসব প্রকল্পে আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে কোনো সহযোগিতা নিতে পারতাম কিনা? আমরা আদৌ বিশ্বব্যাংকের কাছে এ ব্যাপারে অ্যাপ্রোচ করেছিলাম কিনা, এটাও একটা প্রশ্ন। কেননা আমরা এটা মোটামুটিভাবে সবাই জানি যে, বিশ্বব্যাংক সাধারণত সহজ শর্তে ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়। তাদের দেয়া শর্তও সহনীয়। চীনা ঋণে চীনের ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। বিশ্বব্যাংকও তাই করে। কিন্তু চীনা ঠিকাদারদের ক্ষেত্রে কতটুকু সততা ও 'ট্রান্সপারেন্সি' থাকবে সেটা একটা প্রশ্ন বটে। তিন. পদ্মা সেতুতে রেলযোগাযোগ স্থাপনে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এটা ভালো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে 'তৃতীয় কোনো দেশ' এটা থেকে ফায়দা নেবে কিনা? কিংবা এটা ব্যবহার করলে এর 'মডালিটি' কী হবে? চার. পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনা সহযোগিতা আদৌ নেয়া হবে কিনা? কেননা এটি একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান 'আদানি' গ্রুপ নির্মাণ করছে বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে চীনও এই প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করতে চায়। সুতরাং পায়রা বন্দর নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই।
শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্যদিয়ে দুদেশের সম্পর্ক নতুন এক উচ্চতায় উপনীত হলো। এখন দেখতে হবে আগামী দিনগুলোয় আমরা এই সফরকে আমাদের স্বার্থে কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছি। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। ১১ দশমিক ৩৯২ ট্রিলিয়ন ডলারের যে অর্থনীতি, সেই অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি সংযুক্ত হয় তাহলে তা থেকে বাংলাদেশেরই লাভবান হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা ভারতকে উপেক্ষা করে নয়। ভারত ও চীনকে সঙ্গে নিয়েই এবং এক ধরনের 'ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি' অনুসরণ করে আমরা ২০২১ সালের মধ্যেই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারি।
(নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে)Daly jai Jai Din25.10.2016
0 comments:
Post a Comment