রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অনিশ্চিত সার্কের ভবিষ্যৎ


হঠাৎ করেই কাশ্মীর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে কাশ্মীর সংক্রান্ত খবরাখবর। শুধু তাই নয়, কাশ্মীর নিয়ে দু’দেশের মধ্যে আবারও যুদ্ধের আশংকা দেখছেন কেউ কেউ। গত জুলাই থেকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক ধরনের ‘অসহযোগ আন্দোলন’ চলে এলেও দু’দেশের মাঝে উত্তেজনা বাড়ে যখন শ্রীনগর-মুজাফফরাবাদ হাইওয়ের পাশে অবস্থিত উরির সীমান্ত ফাঁড়িতে ১৮ ভারতীয় সৈনিককে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ভারতে। ৫ মিনিটের মধ্যে মানচিত্র থেকে পাকিস্তানের চিহ্ন মুছে ফেলার হুমকি দেয়া হয় ভারতের পক্ষ থেকে। বলা হচ্ছে, ভারত সীমান্তে অবস্থিত পাকিস্তানি ফাঁড়িগুলোতে হামলা চালাতে পারে। পাকিস্তান ভারতীয় ‘হুমকিকে’ যে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, তা বোঝা যায় জেনারেল রাহিল শরিফের কোর কমান্ডারদের সঙ্গে দ্রুত বৈঠক ও বৈঠক শেষে পাকিস্তানের পাল্টা হুমকিতে।

ভারত অভিযোগ করেছে, ১৮ ভারতীয় সৈনিকের হত্যার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই দায়ী। পাক সেনাবাহিনী মূলত নওয়াজ শরিফের সিভিলিয়ান সরকারকে দুর্বল করতে চায়। অন্যদিকে পাকিস্তান অভিযোগ করেছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাই এ কাজটি করেছে, যাতে করে পাকিস্তান কাশ্মীর প্রশ্নটি জাতিসংঘে তুলে বিশ্ব জনমত তার পক্ষে নেয়ার যে চেষ্টা করছে তা ভেস্তে যায়। ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে পাক প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যভুক্ত ৫টি রাষ্ট্রকে চিঠি দিয়ে কাশ্মীরে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ এনেছেন। সব মিলিয়ে কাশ্মীর নিয়ে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এ উত্তেজনা সার্ক সম্মেলনের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। ৯ ও ১০ নভেম্বর ইসলামাবাদে সার্ক (১৯তম) শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ইতিমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ইসলামাবাদে যাচ্ছেন না। বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভুটানও সার্ক সম্মেলনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সার্কের চার্টারে বলা হয়েছে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর কোনো একটি যদি শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে অপারগতা প্রকাশ করে, তাহলে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা যাবে না। তাই একটা বিষয় বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে- নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় সার্ক সম্মেলন স্থগিত হওয়া প্রায় নিশ্চিত।

উরির ঘটনা ছাড়াও সম্প্রতি এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে সার্ক সম্মেলনে ভারতের অংশগ্রহণ না করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গত আগস্টে ইসলামাবাদে সার্ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সম্মেলনে দু’দেশের মধ্যে একটি তিক্ততার সম্পর্কের জন্ম হয়েছিল। এমনকি রাজনাথ সিং সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই তখন ইসলামাবাদ ত্যাগ করেছিলেন। সম্মেলন চলাকালীন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলী খান রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে হাতে হাত মেলাননি। এটা ছিল কূটনৈতিক অসৌজন্যতা। রাজনাথ সিং পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাসভবনে আয়োজিত ডিনারেও অংশ নেননি। সার্ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে রাজনাথ সিং অভিযোগ করেছিলেন, পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের মদদ দিচ্ছে। বিশেষ করে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাকিস্তান সাহায্য করছে বলেও তার অভিযোগ ছিল। অন্যদিকে পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলী খান বলেছিলেন, স্বাধীনতাকামীদের সন্ত্রাসী বলা ঠিক হবে না। কাশ্মীরে ভারতের দখলদারিত্বের অভিযোগ এনে যারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে, পাকিস্তান তাদের দেখছে ‘স্বাধীনতাকামী’ হিসেবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চলতি অধিবেশনে (৭১তম) পাকিস্তান কাশ্মীর প্রসঙ্গটি তুলেছে। একইসঙ্গে ভারত কাশ্মীরে মানবাধিকার লংঘন করছে বলেও অভিযোগ করেছে পাকিস্তান। ফলে একটি তিক্ততার সম্পর্ক ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, অতি সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। প্রথমবার তিনি মন্তব্য করেছেন পার্টির সিনিয়র নেতাদের সভায়। সেখানে তিনি বলেছেন, পাকিস্তান বেলুচিস্তানে ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে এবং সেখানে মানবাধিকার লংঘনের মতো ঘটনা ঘটেছে। এরপর তিনি স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠানে (১৫ আগস্ট, ২০১৬) আবারও বেলুচিস্তানের প্রশ্নটি উত্থাপন করেন এবং বেলুচিস্তান, গিলগিট ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জনগণ যে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, সে কথাটাও তিনি উল্লেখ করেন। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ। তিনি বলেছিলেন, বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ জড়িত, মোদির বক্তব্যে এটা আবারও প্রমাণিত হল।

তৃতীয়ত, ভারত অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ভারতীয় বিমানঘাঁটি ব্যবহার

করতে পারবে।

চতুর্থত, অক্টোবরে আফগান সমস্যার সমাধানের জন্য নিউইয়র্কে একটি ত্রিদেশীয় (ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান) শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, যাতে পাকিস্তানকে ডাকা হয়নি। স্পষ্টতই, এ অঞ্চলে দুটি জোটের জন্ম হয়েছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অক্ষ, অন্যদিকে চীন-পাকিস্তান অক্ষ। এখানে বলা ভালো, চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে পাকিস্তানের প্রদেশ বেলুচিস্তানের ব্যাপারে। বেলুচিস্তানের গাওদারে চীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও বেলুচিস্তান হয়ে চীন যে অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তুলছে, যাতে চীনের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬ বিলিয়ন ডলার, তা নিয়ে ভারতের প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে। এই অর্থনৈতিক করিডোর চীনের পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়ান প্রদেশের খাসগর শহরের সঙ্গে গাওদার সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করবে। এতে করে আরব সাগরে চীনের প্রবেশাধিকার সহজ হবে। চীন এ অর্থনৈতিক করিডোরে রেলপথ, সড়কপথ ও তেলের পাইপলাইন সংযুক্ত করছে। জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা ও চীনা পণ্য ইউরোপসহ যুক্তরাষ্ট্রে পরিবহনের প্রশ্নে এ করিডোর একটি বড় ধরনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে চীনের জন্য। চীন বর্তমানে ৬০০ মাইল দূরে অবস্থিত হরমুজ প্রণালী (যেখান থেকে বিশ্বের ৩৫ ভাগ জ্বালানি তেল সরবরাহ হয়) ব্যবহার করছে। এ অর্থনৈতিক করিডোরের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চীন সময় বাঁচাতে পারবে। এতে করে পণ্যের দামও কমে যাবে। মালাক্কা প্রণালীর ওপর চীনের নির্ভরতাও (শতকরা ৮০ ভাগ চীনা জ্বালানি এ পথে সরবরাহ হয়) এতে করে কমবে। অনেক কম সময়ে চীনা পণ্য পৌঁছে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বদলে নিউইয়র্কে। চীন তাই কোনো অবস্থাতেই চাইবে না এ অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হোক।

ইতিমধ্যে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে চীনও শরিক হয়েছে। চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিউইয়র্কে দেখা করেছেন এবং কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। নওয়াজ শরিফ জাতিসংঘে দেয়া তার ভাষণে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতের অত্যাচার ও মানবাধিকার লংঘনের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি একইসঙ্গে জাতিসংঘের বিদায়ী মহাসচিব বান কি মুনের কাছে ভারতীয় ‘অত্যাচার ও নিপীড়নের’ দৃশ্য সংবলিত ডকুমেন্ট জমা দিয়েছেন। তিনি কাশ্মীর প্রশ্নে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করলেও বান কি মুন অবশ্য এ ব্যাপারে সায় দেননি। মুন কাশ্মীর প্রশ্নে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ওপর জোর দিয়েছিলেন। নওয়াজ শরিফের সঙ্গে ইরানি প্রেসিডেন্ট রুহানির আলোচনায় ইরান কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানকে সমর্থনের কথাও জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে সমর্থনের কথা জানানো হয়েছে। সব মিলিয়ে কাশ্মীর প্রশ্নে একদিকে পাক-ভারত উপমহাদেশে উত্তেজনা যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে এ দুটি দেশের মধ্যে একটি ‘কূটনৈতিক যুদ্ধ’ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বালুচ নেতা ব্রাহামদাগ বুগতিকে দিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক আদালতে চীনের বিরুদ্ধে মামলা করার একটি উদ্যোগ নিচ্ছে, এমন খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। বলা ভালো, ৮ জুলাই (২০১৬) কাশ্মীরের হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান ওয়ানিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী হত্যা করে। এরপর থেকেই কাশ্মীরের পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে এবং তা শেষ পর্যন্ত সার্ক সম্মেলনকে আক্রান্ত করেছে।

অনেক পর্যবেক্ষকই এখন মনে করেন, সার্ক তার গুরুত্ব হারাচ্ছে। কেননা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জনগণের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ৩১ বছর আগে সার্ক গঠিত হলেও সংস্থাটির উন্নয়ন তেমন একটা চোখে পড়ে না। এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে বৈ কমেনি। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র্যতম অঞ্চলগুলোর একটি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাস এখানে। কিন্তু দারিদ্র্য এখানে কমেনি। পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৩৬ ভাগ। বাংলাদেশে এ হার ৩২, নেপালে ২৫, পাকিস্তানে ২২, ভুটানে ১২, শ্রীলংকায় ৯, আর ভারতে ৩০ ভাগ। ভারতে হাজার হাজার কোটিপতির জন্ম হয়েছে, কিন্তু জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষের নিজস্ব কোনো ল্যাট্রিন নেই। তারা প্রকাশ্যে মলমূত্র ত্যাগ করেন। জাতিসংঘ প্রণীত মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস (এমডিজি) অর্জনে পূর্ণ সফল হয়নি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। তবে এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের চেয়ে ভালো। বিশেষ করে নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে। পিছিয়ে আছে আফগানিস্তান। এ ক্ষেত্রে সার্ক ফোরাম কোনো বড় ভূমিকা নিতে পারেনি।

মূলত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের পার্থক্য লক্ষ্য রাখার মতো। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান চরিত্রগত দিক দিয়ে বেশি মাত্রায় মধ্যএশীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। খাদ্যাভ্যাস কিংবা জীবনযাত্রার দিক দিয়ে এ দুটি দেশের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর পার্থক্য রয়েছে। উপরন্তু রয়েছে এক ধরনের অবিশ্বাস। পাকিস্তান ও ভারতের বৈরিতা ঐতিহাসিক। এ বৈরিতা দীর্ঘ প্রায় ৭০ বছরেও কমেনি। একইসঙ্গে ভারতের ‘বড়ভাইসুলভ’ আচরণে আতংকিত থাকে পার্শ্ববর্তী ছোট ছোট দেশগুলো। শ্রীলংকা ও নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে। ভারতের ভূমিকা নিয়ে এসব দেশে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এখন ভারতের। কিন্তু ভারতের এ অর্থনীতি দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে তেমন একটা কাজে লাগেনি। ভারত সাধারণত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গড় উঠেছে এ দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। এখানে বহুপাক্ষিকতা গুরুত্ব পায়নি। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে এ বহুপাক্ষিকতা গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম সমস্যা জ্বালানি। অর্থাৎ বিদ্যুৎ। এ অঞ্চলে প্রচুর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকলেও ভারত এটাকে ব্যবহার করছে তার নিজের স্বার্থে। ভুটান ও নেপালের সঙ্গে আলাদা আলাদা চুক্তি করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করছে ভারত। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে সংযুক্ত করা হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ পাচ্ছে বটে; কিন্তু তা ত্রিদেশীয় উদ্যোগে উৎপাদিত কোনো বিদ্যুৎ নয়। তাছাড়া এ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়েও নানা কথা আছে। আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে ভুটান, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারতের সমন্বয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে তা থেকে উপকৃত হতো এ অঞ্চলের জনগণ। কিন্তু তা হয়নি। আঞ্চলিক বাণিজ্য নিয়েও কথা আছে। এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ভারত রফতানি করে বেশি, আমদানি করে কম। উপরন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশি। আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য সীমিত। এখানেও সমস্যা ভারতকে নিয়ে। ট্যারিফ ও প্যারাট্যারিফের কারণে পণ্যের দাম বেশি হয়ে যায়, যাতে ভারতের আমদানিকারকদের আর আগ্রহ থাকে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ সম্পর্ক ভারতের অনুকূলে। ভারত অনেক সময় বেশকিছু পণ্যের শুল্ক সুবিধা দেয়ার

কথা বলে বটে; কিন্তু বাংলাদেশে ওইসব পণ্য আদৌ উৎপাদিত হয় না।

ভারত ইতিমধ্যে সার্কের ভেতরে একটি উপআঞ্চলিক সহযোগিতার উদ্যোগ নিয়েছে। মোদির ঢাকা সফরের সময় ঘোষিত হয়েছে এ উপআঞ্চলিক সহযোগিতা, যা বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল) নামে পরিচিত। এ উপআঞ্চলিক সহযোগিতা বাস্তবায়িত হলে সঙ্গত কারণেই সার্ক দুর্বল হয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, ভারত বিবিআইএনের পাশাপাশি বিমসটেক ও ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে অপর দুটি জোটের ব্যাপারেও আগ্রহ দেখিয়েছে বেশি। দুটি জোটেই পাকিস্তান নেই। এতে করে একটা ধারণা হওয়া স্বাভাবিক- ভারত চূড়ান্ত বিচারে সার্কের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। শুধু তাই নয়, চীন যে বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) জোটের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিল (যা একসময় পরিচিত ছিল কুনমিং উদ্যোগ নামে) তাতেও শ্লথগতি আসতে পারে। বিসিআইএম জোট, যা চীনের ইউনান প্রদেশকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং বাংলাদেশী পণ্যের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজার উন্মুক্ত করবে, এ মুহূর্তে তা ভারতের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। ভারতের এ মুহূর্তের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে সংকুচিত করা। ফলে চীনের বন্ধুৃ হিসেবে পাকিস্তানকে ভারত ‘কূটনৈতিক জালে’ আটকে ফেলে পাকিস্তানের ভূমিকাকে সংকুচিত করতে চাইছে।

এ পটভূমিতে এবং কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায়- যে ক্ষেত্রে একটি ‘সীমিত যুদ্ধের’ সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না- ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন যদি দক্ষিণ এশিয়ার দুই বড় দেশ ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীরের উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে আন্তঃপ্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তাহলে এ অঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হলেও দেশটির বিপুলসংখ্যক মানুষ দরিদ্র। ভারত যদি সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ায়, তাহলে তা দেশটির উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একই কথা প্রযোজ্য পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও। জঙ্গিবাদ আজ পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার মতো একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। জঙ্গিবাদের কারণে পাকিস্তানের ‘জিডিপি গ্রোথ’ এখন সর্বনিু পর্যায়ে। দারিদ্র্য, সমাজে অসমতা, ধর্মীয় উন্মত্ততা বিদেশে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। মার্কিন কংগ্রেসে পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান আবারও অস্ত্রসজ্জার উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে উপমহাদেশের পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। এতে করে সার্কের উন্নয়ন যে বাধাগ্রস্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ‘আসিয়ান’ আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু সার্ক তেমনটি পারল না। নিজেদের মধ্যে আস্থার অভাব, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, কর্তৃত্ব করার মানসিকতা, ভারতের ‘বড়ভাইসুলভ’ আচরণ ইত্যাদি নানা কারণে সার্ক একটি গ্রহণযোগ্য আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না।

এমনই যখন পরিস্থিতি তখন কাশ্মীর ইস্যু পুরো দৃশ্যপটকে আরও জটিল করে তুলল। এর সঙ্গে এখন যোগ হল সিন্ধু নদীর পানিবণ্টনের প্রশ্নটিও। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। এ চুক্তির ফলে পাকিস্তানের সেচব্যবস্থা সফল হয়েছে। পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি নদী এ চুক্তির ফলে উপকৃত হচ্ছে। এখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব আভাস দিয়েছেন, তারা সিন্ধু পানিচুক্তি বাতিল করে দিতে পারেন। সার্কের ভবিষ্যৎ এখন সংকটাপন্ন।

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Dily Jugantor
30.09.2016

1 comments: