রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

এ অঞ্চলের ত্রিভুজ রাজনীতি বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাবে?

 
Image result for Indian Ocen rivalry
 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি যখন গত আগস্টের শেষে বাংলাদেশ ও ভারত সফর করছিলেন, ঠিক প্রায় একই সময় ওয়াশিংটনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পানিকর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বৈশ্বিক রাজনীতি এশিয়া-প্যাসিফিক তথা ভারত মহাসাগরে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনার আলোকে এ চুক্তির গুরুত্ব অনেক। এর মধ্য দিয়ে একদিকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হবে বড় ধরনের অবিশ্বাস। এ প্রতিরক্ষা চুক্তিকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন ও অনেক সম্ভাবনার জন্ম হবে।
 
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে জোটনিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে আসছে। বলা যেতে পারে, ষাটের দশকে যে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল (ন্যাম), তার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল ভারত। যদিও অতীতে, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউয়িনের মধ্যকার সম্পর্ক ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতিকে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিলেও ভারত বরাবর সচেষ্ট থেকেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করতে। সবসময়ই ভারত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বক্তব্যকে ওই সময়ে সমর্থন করেছে এমন নয়। কিন্তু ভারতের বর্তমান ‘অবস্থান’ দেখে মনে হচ্ছে, ভারত তার জোটনিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে আসছে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তি এর বড় প্রমাণ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এরপর ভারতকে আর কখনও এ ধরনের সামরিক চুক্তি করতে দেখা যায়নি। তবে চন্দ্রশেখর যখন ভারতে সীমিত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন কুয়েত যুদ্ধে (কুয়েত থেকে ইরাকি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার; প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ) মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলোকে ভারতের পোর্টে জ্বালানি নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল কংগ্রেস ও বাম দলগুলোর প্রতিবাদের মুখে চন্দ্রশেখর সরকার শেষ পর্যন্ত এ অনুমোদন বাতিল করে।

এখন ভারত যে সামরিক চুক্তি করল, তাতে দু’দেশ (ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র) পরস্পরের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের সুযোগ পাবে। এ সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের সুযোগটি ভারতের জন্য যত না প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। মধ্যপ্রাচ্যে একটি মারাত্মক যুদ্ধে (সিরিয়ায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে) মার্কিন বিমানবহর ভারতের বিমান ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করতে পারবে রিফুয়েলিংয়ের জন্য। এ চুক্তিটি, যা লেমোয়া (LEMOA- Logistic Exchange Memorandum of Agreement) নামে অভিহিত হচ্ছে, তা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। এ চুক্তি ভারতকে আরও বেশি করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্র আরও দুটো চুক্তি নিয়ে বর্তমানে ভারতের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে, এবং ধারণা করছি অতি শিগগিরই ভারত এ দুটো চুক্তিতেও স্বাক্ষর করবে। এর একটি হচ্ছে সিসমোয়া (CISMOA- Communications Interoportability and Security Memorandum of Agreement) এবং অপরটি হচ্ছে বেকা (BECAÑ Basic Exchange and Cooperation Agreement for Geo special Cooperation)। সিসমোয়া চুক্তির ফলে নিরাপত্তাসংক্রান্ত সব তথ্য পাবে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বেকা চুক্তির আওতায় বিভিন্ন স্থানের ডিজিটাল মানচিত্র ও সমীক্ষা রিপোর্টের ব্যবহারের সুযোগ পাবে যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং এ ধরনের চুক্তির ধরন এবং এর ব্যবহার যে ভারতকে আরও বেশি মাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রমুখী করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত প্রায় ১৬ বছর ধরে ভারতের রাজনীতিতে বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০০৮ সালে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি অসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর ফলে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণসহ সব ধরনের পারমাণবিক প্রযুক্তি, যা শুধু অসামরিক কাজে ব্যবহৃত হবে, তা যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সরবরাহ করছে। ভারত এখন নিউক্লিয়ার সাপ্লাইস গ্রুপ বা এনএসজির সদস্য হতে চায়, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রও সমর্থন করছে।

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক বৃদ্ধির পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ হচ্ছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধিকে চ্যালেঞ্জ করে ভারতকে এ অঞ্চলে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন মনে করে, একুশ শতকের মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল। বাংলাদেশ ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য প্রণীত নীতির আওতাভুক্ত। এ অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতন, এ অঞ্চলের তিনটি শক্তির (চীন, ভারত, জাপান) মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে অন্য অঞ্চলের চেয়ে এ অঞ্চল গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ওবামার 'Pivot to Asia' পলিসির প্রধান বিষয় হচ্ছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল। এ অঞ্চলের উত্থান-পতনে এবং বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র একটি ভূমিকা রাখতে চায়। চীনের ভূমিকাকে খর্ব করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা দু’-দু’বার ভারত সফর করেছেন। প্রতিবারই তিনি বিশাল এক ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল নিয়ে ভারত গেছেন। এবং একাধিক বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। শুধু তাই নয়, ওবামা তার ভারত সফরের সময় ভারতের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদের দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। এতেই বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ অঞ্চলের ব্যাপারে আরেকটি স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে এবং সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণে একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। গত মার্চে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘রাইসিনা ডায়ালগে’ যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ষষ্ঠ ফ্লিটের প্রধান অ্যাডমিরাল হ্যারি হারিস এ ধরনের একটি প্রস্তাব করেছিলেন।

তবে এমন প্রস্তাব নতুন নয়, জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এ ধরনের একটি প্রস্তাব করেছিলেন ২০০৬-০৭ সালে। জাপানি প্রধানমন্ত্রীর ওই প্রস্তাব Quadrilateral Initiative হিসেবে পরিচিত। এ থেকেই বোঝা যায় এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের Pivot to Asia পলিসির আসল উদ্দেশ্য কী। চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিবৃদ্ধি এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও গুয়ামে ‘সাপ্লাই লাইনের’ জন্য রীতিমতো হুমকিস্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য তাই পরিষ্কার- এ অঞ্চলভুক্ত জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে সংযুক্ত করে একটি সামরিক অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজি বুঝতে আমাদের সহজ হবে যদি আমরা অতি সাম্প্রতিককালে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র যে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে, তার দিকে তাকাই। যুক্তরাষ্ট্র গত জুলাইয়ে ফিলিপাইনের নৌবাহিনীকে USA Boutwell নামে একটি বড় ধরনের ডেস্ট্রয়ার সরবরাহ করেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা নৌবাহিনীর গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখা এবং প্রয়োজনে চীনা জাহাজকে চ্যালেঞ্জ করা।

গত বেশকিছু দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের সঙ্গে Enhanced Defense Cooperation নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে আসছে। এই চুক্তির বলে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন সেনা অথবা মেরিন সেনাকে স্থায়ীভাবে মোতায়েনের সুযোগ পাবে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালের South East Asia Maritime Security Initiative (MSI)-এর আওতায় ৪২৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। এর আগে ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র South East Asia Maritime Law Enforcement Initiative গ্রহণ করেছিল। উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমুদ্রসীমার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, প্রশিক্ষণ দেয়া। মূল কথা একটাই- চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে দাঁড় করানো।

এ প্রসঙ্গে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ‘দি সিল্ক রোড ইকনোমিক বেল্ট অ্যান্ড মেরিটাইম সিল্ক রোড’ (বহুল প্রচারিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড) নামে যে নীতি প্রণয়ন করেছেন, তাতে ৬০ দেশকে চীন তার বাণিজ্যিক কাঠামোয় নিয়ে আসতে চাইছে। এতে করে চীনের সঙ্গে সড়কপথে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো যেমন যুক্ত হবে, ঠিক তেমনি দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও সামুদ্রিক পথে সংযুক্ত হবে। এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের খরচ হবে ৪ থেকে ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও শীর্ষস্থানীয় বড় অর্থনীতির সঙ্গে টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এবং ট্রান্স আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ নামে যে দুটো চুক্তি করেছে, তার বিকল্প হিসেবেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ‘ব্রেন চাইল্ড’ হচ্ছে এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি। সিরিয়াস পাঠকরা স্মরণ করতে পারেন চীনের ‘String of Pearl’ বা মুক্তারমালা প্রকল্পের কথা, যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সমুদ্রবন্দরগুলোকে এক নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চাইছে চীন। চীনের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। এ অঞ্চল ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী জাহাজ এ অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছে। এ অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত সম্প্রতি চীনের দাবি খারিজ করে দিলেও চীন তা মেনে নেয়নি। ফিলিপাইনের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে তার ঢেউ এসে লাগবে ভারত মহাসাগরেও। সুতরাং চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার তৎপরতা বাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই জন কেরির বাংলাদেশ ও ভারত সফরকে এ দৃষ্টিতেই আমাদের দেখতে হবে। মোদির জমানায় ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও বেড়েছে। ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ বেড়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির অংশ। ভারতকে তার প্রয়োজন এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোর জন্য। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তা ভারতকে গুরুত্ব দিয়েই আবর্তিত হবে।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি একদিকে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে আস্থাহীনতা ঘটাবে, অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে। বেলুচিস্তান নিয়ে মোদি সম্প্রতি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে পাকিস্তান অখুশি হয়েছে। শুধু তাই নয়, চীনের সরকারি প্রচারমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে প্ররোচনা দেয়ার। এখানে বলা ভালো, চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে বেলুচিস্তানের ব্যাপারে। বেলুচিস্তানের গাওদারে চীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও বেলুচিস্তান হয়ে চীন যে একটি অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তুলছে, যাতে চীনের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬ মিলিয়ন ডলার, তা নিয়ে ভারতের প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে। এ অর্থনৈতিক করিডোর চীনের পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়ান প্রদেশের খাসগর শহরের সঙ্গে গাওদার সমুদ্রবন্দরকে যুক্ত করবে। এতে করে আরব সাগরে চীনের প্রবেশাধিকার সহজ হবে। চীন এ অর্থনৈতিক করিডোরে রেলপথ, সড়কপথ ও তেলের পাইপলাইন সংযুক্ত করছে। জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা ও চীনা পণ্য ইউরোপসহ যুক্তরাষ্ট্রে পরিবহনের প্রশ্নে এ করিডোর একটি বড় ধরনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে চীনের জন্য। চীন বর্তমানে ৬০০ মাইল দূরে অবস্থিত হরমুজ প্রণালী (যেখান থেকে বিশ্বের ৩৫ ভাগ জ্বালানি তেল সরবরাহ হয়) ব্যবহার করছে। এ অর্থনৈতিক করিডোর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চীন সময় বাঁচাতে পারবে। এতে করে পণ্যের দামও কমে যাবে। মালাক্কা প্রণালীর ওপর চীনের নির্ভরতাও (শতকরা ৮০ ভাগ চীনা জ্বালানি এ পথে সরবরাহ হয়) এতে করে কমবে। অনেক কম সময়ে চীনা পণ্য পৌঁছে যাবে ক্যালিফোর্নিয়ার বদলে নিউইয়র্কে। চীন তাই কোনো অবস্থাতেই এ অর্থনৈতিক করিডোরের প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তা চাইবে না।

বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। অতি সম্প্রতি লন্ডনে বেলুচ ছাত্র সংগঠন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। পাকিস্তান মনে করে, বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উসকে দেয়ার পেছনে ভারতের ইন্ধন রয়েছে। মজার ব্যাপার, ইরান নিয়ন্ত্রিত বেলুচিস্তানের চাহবারে ভারত একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। একইসঙ্গে চাহবার থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করছে ভারত। এ রেলপথ চাহবার থেকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে আফগানিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। চলতি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে জাতিসংঘের শীর্ষ বৈঠকের প্রাক্কালে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে একটি ত্রিদেশীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে (যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-আফগানিস্তান)। এ বৈঠকে পাকিস্তানকে ডাকা হয়নি।

এ অঞ্চলের রাজনীতি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। এক সময় ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে দ্বিপাক্ষিকতা প্রাধান্য পেত। এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিকতার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা (সামরিক ও বাণিজ্যিক) আগামীতে চীনের সঙ্গে ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে যাবে বলা মুশকিল। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ১৬ অক্টোবর ভারতের গোয়ায় যাবেন ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। এরই মাঝে খবর বেরিয়েছে, চীন অত্যন্ত গোপনে তিব্বতে সামরিক প্রস্তুতি বাড়াতে শুরু করে দিয়েছে। তিব্বতের এক বিমানবন্দরে জে-২০ স্টেলথ ফাইটার বিমান মোতায়েন করেছে। ভারত অরুণাচলে ক্ষেপণাস্ত্র এবং লাদাখে শতাধিক ট্যাংক মোতায়েন করার পরিপ্রেক্ষিতেই চীন জে-২০ ফাইটার বিমান মোতায়েন করেছে বলে পত্রপত্রিকাগুলো আভাস দিয়েছে। ফলে এ ধরনের সূক্ষ্ম অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ভারত ও চীনের মাঝে।

এরই মধ্যে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি এই প্রতিযোগিতাকে আরও উসকে দেবে মাত্র। এর ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাসের মাত্রা বাড়বে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের রাজনীতি বদলে যাচ্ছে। ভারত ভিয়েতনামকে ৫০ কোটি ডলারের সামরিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। মোদি ভিয়েতনাম সফর করেছেন। এর আগে ওবামা ভিয়েতনাম সফর করে গেছেন। ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভিয়েতনাম এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য পশ্চিমা দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় করতে পারবে। স্পষ্টতই বদলে যাচ্ছে এশিয়া-প্যাসিফিক এবং সেই সঙ্গে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতি। এরই মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গোয়ায় যাবেন ১৫ অক্টোবর। এ অঞ্চলের রাজনীতিতে যে পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে, তার ছোঁয়া এসে লাগবে বাংলাদেশেও। এসব পরিবর্তনকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।
Daily Jugantor
10.09.2016

0 comments:

Post a Comment