বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। মার্কিন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির ঢাকা সফরের আগে ঢাকা ঘুরে গেছেন ব্রিটিশ
প্রতিমন্ত্রী (আন্তর্জাতিক সহযোগিতা) রোরি স্টুয়ার্ট। টেরেসা মের
মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়া রোরি স্টুয়ার্টের এটা প্রথম বাংলাদেশ সফর। গত ২৩ জুন
ব্রিটেনে গণভোট ও গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার
সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর ব্রিটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং
বাংলাদেশে ব্রিটেনের সহযোগিতার ধরন নিয়ে আলোচনা করতেই রোরি স্টুয়ার্ট
বাংলাদেশে এসেছিলেন। এদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং আগামী অক্টোবরের
মাঝামাঝি বাংলাদেশ সফরে আসছেন। বাংলাদেশ সফরকালে চীনা প্রেসিডেন্ট
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মিলিত
হবেন। এ দুই নেতা ১৫ ও ১৬ অক্টোবর ভারত সফর করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা গোয়ায় অনুষ্ঠিত বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি
সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন) সম্মেলনে যোগ দেবেন। আর
চীনা প্রেসিডেন্ট শি যোগ দেবেন ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে। গোয়াতেই এই শীর্ষ
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ভারত বর্তমান ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও
দক্ষিণ আফ্রিকা) চেয়ারম্যান। সব মিলিয়ে বিশ্বরাজনীতির অঙ্গনে বাংলাদেশ এই
মুহূর্তে একটি বহুল আলোচিত নাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, জন কেরির বাংলাদেশ
সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরো বেড়েছে।জন
কেরির ঢাকা সফর অনেক আগেই প্রত্যাশিত ছিল। গত চার বছরে এটা ছিল কোনো
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বিতীয় ঢাকা সফর। ২০১২ সালের মে মাসে তৎকালীন
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকা সফর করে গেছেন। হিলারি
ক্লিনটন বর্তমানে ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রার্থী হিসেবে নভেম্বরের (২০১৬)
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ
সম্পর্কের ক্ষেত্রে জন কেরির সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেরির সঙ্গে
এসেছিলেন নিশা দেশাই বিসওয়াল, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
দক্ষিণ এশিয়া-সংক্রান্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নিশা দেশাই এর আগে
একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট ধারণা
রয়েছে। সুতরাং কেরি তাঁর ঢাকা সফরে যখন নিশা দেশাইকে সঙ্গে নিয়ে আসেন তখন
বুঝতে হবে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বাংলাদেশকে কত গুরুত্ব দেয়। মূলত
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তাতে বাংলাদেশ একটি
শক্ত অবস্থানে আছে। দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনা ও ভারত মহাসাগরে চীনা
নৌবাহিনীর তৎপরতার প্রেক্ষাপট যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরো
বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে, এটা
কেরি স্বীকার করেছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। কেননা বিশ্ব
অর্থনীতিতে যখন এখনো শ্লথগতি চলছে তখন বাংলাদেশ তার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬
শতাংশের ওপরে ধরে রেখেছে। তৈরি পোশাক নিয়ে হাজারটা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও
যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য
বাংলাদেশের অনুকূলে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ৩০৫২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি
করেছে ৪৩৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মাত্র
ছয় মাসে ঘাটতির পরিমাণ ২৬১২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে ঘাটতি ছিল ৫০৪৮
মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থানে
আছে। সুতরাং কেরি যখন বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করেন তখন সত্যটাই তিনি
তুলে ধরেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ২০১২ সালে হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা
সফরের সময় তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘সফট পাওয়ার’-এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
অর্থাৎ বিশ্ব আসরে বাংলাদেশ যে একটি শক্তি এবং বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার
যোগ্যতা যে রয়েছে, হিলারি ক্লিনটন সেটা স্বীকার করে গিয়েছিলেন। আর আজ চার
বছর পর কেরিরও স্বীকারোক্তি মিলল।
কেরির ঢাকা সফরে জঙ্গিবাদের উত্থানের প্রশ্নটিও এসেছে। জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা চেয়েছে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করতে ও গোয়েন্দা তথ্যবিনিময় করতেও দুই দেশ রাজি হয়েছে। বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছে। জঙ্গিবাদ, জিএসপি সুবিধা ইত্যাদি প্রশ্নে বাংলাদেশ তার অবস্থান পরিবর্তন করেনি এবং যুক্তরাষ্ট্র কার্যত বাংলাদেশের এই ভূমিকাকে সমর্থন করে গেছে। একটা জিনিস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। সত্তরের দশকের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। বাংলাদেশ আজ বিশ্বকে দিতে পারে। বাংলাদেশের সামর্থ্য বেড়েছে। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দক্ষতা, যোগ্যতা ও নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা আজ বিশ্ব স্বীকৃত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রশংসা করার মতো। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সংলাপ পার্টনার। নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর একবার সংলাপে মিলিত হয়। দক্ষিণ চীন সাগর এবং সেই সঙ্গে ভারত মহাসাগরে চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সন্দিহান। বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তার ভূমিকা পালন করে আসছে। দক্ষিণ চীন সফরের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও ভারত মহাসাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব দিনে দিনে বাড়ছেই। ফলে খুব সংগত কারণেই চীনের যে এ অঞ্চলের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ অঞ্চল ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী জাহাজ এ অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছে। এ অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত সম্প্রতি চীনের দাবি খারিজ করে দিলেও চীন তা মেনে নেয়নি। চীন ফিলিপাইনের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে তার টেউ এসে লাগবে ভারত মহাসাগরেও। সুতরাং চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার তৎপরতা বাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই জন কেরির বাংলাদেশ ও ভারত সফর এ দৃষ্টিতেই আমাদের দেখতে হবে। মোদির জমানায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরো বেড়েছে। ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ বেড়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির অংশ। ভারতকে তার প্রয়োজন এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোর জন্য। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, সেই নীতি ভারতকে আস্থায় নিয়েই তৈরি করা। অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আলোকেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রচিত হবে। আলাদা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো নীতি প্রণয়ন করবে না যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজন খুব বেশি।
এ প্রসঙ্গে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ‘দ্য সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট অ্যান্ড মেরিটাইম সিল্ক রোড’ (বহুল প্রচারিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড) নামে যে নীতি প্রণয়ন করেছেন, তাতে ৬০ দেশকে চীন তার বাণিজ্যিক কাঠামোয় নিয়ে আসতে চাইছে। এতে চীনের সঙ্গে সড়কপথে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো যেমন সংযুক্ত হবে, ঠিক তেমনি দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও সামুদ্রিক পথে সংযুক্ত হবে। এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের খরচ হবে চার থেকে আট ট্রিলিয়ন ডলার। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও শীর্ষস্থানীয় বড় অর্থনীতির সঙ্গে টিপিপি বা ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এবং ট্রান্স-আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ নামে যে দুটি চুক্তি করেছে, তার বিকল্প হিসেবেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ‘ব্রেন চাইল্ড’ হচ্ছে এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি। সিরিয়াস পাঠকরা স্মরণ করতে পারেন চীনের String of Pearls প্রজেক্টের কথা। এ প্রজেক্টের আওতায় চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক সমুদ্রবন্দরকে ‘মুক্তার মালা’র মতো একসঙ্গে সংযুক্ত করেছে। প্রতিটি বন্দরেই চীনের নৌবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী চীন ভারত মহাসাগরে অবস্থিত একাধিক দেশে তাদের নৌঘাঁটি নির্মাণের চেষ্টা করছে। জিবুতি, গাওদার (বেলুচিস্তান), হামবানতোতা (শ্রীলঙ্কা), মিয়ানমার, ইয়েমেন, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ওমান কিংবা কেনিয়ায় চীনা নৌঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জিবুতি ও মাদাগাস্কারে নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। চীনের এই নৌঘাঁটি নির্মাণের বিষয়টিকে ভারত খুব সহজভাবে নেয়নি। ভারতও একইভাবে সিসিলি ও মৌরিতুসের দুটি দ্বীপে ভারতের নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। ২০১৫ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী মোদির এই দ্বীপ দুটি সফরের সময় এই নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা প্রথমবারের মতো জানা যায়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারত তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেছিল। ভারত বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে পরাজয়বরণ করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে সেখানে সিরিসেনা প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে। ভারত মহাসাগর কিংবা দক্ষিণ চীন সাগর প্রশ্নে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ অবলম্বন করেনি। চীন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী। চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে বাংলাদেশ গুরুত্ব দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে গিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। তখন বেশ কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বেশ কয়েকটি মৈত্রী সেতু চীন তৈরি করে দিয়েছে। নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুতেও চীনা কন্ট্রাক্টরদের ভূমিকা রয়েছে। চীন বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী। গত ২১ মার্চ ঢাকায় কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিকাবের একটি অনুষ্ঠানে চীনা রাষ্ট্রদূত মা সিং ছিয়াং বলেছিলেন, প্রয়োজনে অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চীন এ কাজটি করতে চায়। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য চীনের অনুকূলে থাকলেও চীন এরই মধ্যে পাঁচ হাজার বাংলাদেশি পণ্যের সে দেশে বাজারজাতকরণে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। চীনা বিনিয়োগও বাড়ছে দিনে দিনে। ২০০২ সালে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আমাদের সীমান্ত থেকে চীনের দূরত্ব খুব বেশি দূরে নয়। চীন এই মুহূর্তে এশিয়ার অর্থনীতিতে এক নম্বরে এবং ভারতের অবস্থান তৃতীয়। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীন ও ভারত যে ফ্যাক্টর, তা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ এই দুটি দেশের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে আসছে। বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়। এ ক্ষেত্রে চীন আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে সাহায্য করবে বলে চীনা রাষ্ট্রদূত আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। চলতি আগস্ট মাসে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৪১ বছর পার হবে। এমনি সময়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ঢাকায় আসছেন। নিঃসন্দেহে এটা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় সাফল্য। একুশ শতকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম অগ্রাধিকার হচ্ছে ‘নেক্সট ইলেভেন’ (গোল্ডম্যান স্যাকস-এর মূল্যায়নে) দেশগুলোর কাতারে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করা এবং পররাষ্ট্রনীতিকে সেই লক্ষ্যে সাজিয়ে এটা অর্জন করা। প্রধানমন্ত্রীর জাপান ও চীন সফর, জন কেরির ঢাকা সফর ও চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা আগমন যে আমাদের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। Daily Kalerkontho 06.09.2016
কেরির ঢাকা সফরে জঙ্গিবাদের উত্থানের প্রশ্নটিও এসেছে। জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা চেয়েছে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করতে ও গোয়েন্দা তথ্যবিনিময় করতেও দুই দেশ রাজি হয়েছে। বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছে। জঙ্গিবাদ, জিএসপি সুবিধা ইত্যাদি প্রশ্নে বাংলাদেশ তার অবস্থান পরিবর্তন করেনি এবং যুক্তরাষ্ট্র কার্যত বাংলাদেশের এই ভূমিকাকে সমর্থন করে গেছে। একটা জিনিস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। সত্তরের দশকের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। বাংলাদেশ আজ বিশ্বকে দিতে পারে। বাংলাদেশের সামর্থ্য বেড়েছে। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দক্ষতা, যোগ্যতা ও নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা আজ বিশ্ব স্বীকৃত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রশংসা করার মতো। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সংলাপ পার্টনার। নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর একবার সংলাপে মিলিত হয়। দক্ষিণ চীন সাগর এবং সেই সঙ্গে ভারত মহাসাগরে চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সন্দিহান। বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তার ভূমিকা পালন করে আসছে। দক্ষিণ চীন সফরের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও ভারত মহাসাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব দিনে দিনে বাড়ছেই। ফলে খুব সংগত কারণেই চীনের যে এ অঞ্চলের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ অঞ্চল ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী জাহাজ এ অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছে। এ অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত সম্প্রতি চীনের দাবি খারিজ করে দিলেও চীন তা মেনে নেয়নি। চীন ফিলিপাইনের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে তার টেউ এসে লাগবে ভারত মহাসাগরেও। সুতরাং চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার তৎপরতা বাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই জন কেরির বাংলাদেশ ও ভারত সফর এ দৃষ্টিতেই আমাদের দেখতে হবে। মোদির জমানায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরো বেড়েছে। ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ বেড়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির অংশ। ভারতকে তার প্রয়োজন এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোর জন্য। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, সেই নীতি ভারতকে আস্থায় নিয়েই তৈরি করা। অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আলোকেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রচিত হবে। আলাদা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো নীতি প্রণয়ন করবে না যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজন খুব বেশি।
এ প্রসঙ্গে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ‘দ্য সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট অ্যান্ড মেরিটাইম সিল্ক রোড’ (বহুল প্রচারিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড) নামে যে নীতি প্রণয়ন করেছেন, তাতে ৬০ দেশকে চীন তার বাণিজ্যিক কাঠামোয় নিয়ে আসতে চাইছে। এতে চীনের সঙ্গে সড়কপথে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো যেমন সংযুক্ত হবে, ঠিক তেমনি দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও সামুদ্রিক পথে সংযুক্ত হবে। এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের খরচ হবে চার থেকে আট ট্রিলিয়ন ডলার। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও শীর্ষস্থানীয় বড় অর্থনীতির সঙ্গে টিপিপি বা ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এবং ট্রান্স-আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ নামে যে দুটি চুক্তি করেছে, তার বিকল্প হিসেবেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ‘ব্রেন চাইল্ড’ হচ্ছে এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি। সিরিয়াস পাঠকরা স্মরণ করতে পারেন চীনের String of Pearls প্রজেক্টের কথা। এ প্রজেক্টের আওতায় চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক সমুদ্রবন্দরকে ‘মুক্তার মালা’র মতো একসঙ্গে সংযুক্ত করেছে। প্রতিটি বন্দরেই চীনের নৌবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী চীন ভারত মহাসাগরে অবস্থিত একাধিক দেশে তাদের নৌঘাঁটি নির্মাণের চেষ্টা করছে। জিবুতি, গাওদার (বেলুচিস্তান), হামবানতোতা (শ্রীলঙ্কা), মিয়ানমার, ইয়েমেন, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ওমান কিংবা কেনিয়ায় চীনা নৌঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জিবুতি ও মাদাগাস্কারে নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। চীনের এই নৌঘাঁটি নির্মাণের বিষয়টিকে ভারত খুব সহজভাবে নেয়নি। ভারতও একইভাবে সিসিলি ও মৌরিতুসের দুটি দ্বীপে ভারতের নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। ২০১৫ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী মোদির এই দ্বীপ দুটি সফরের সময় এই নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা প্রথমবারের মতো জানা যায়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারত তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেছিল। ভারত বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে পরাজয়বরণ করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে সেখানে সিরিসেনা প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে। ভারত মহাসাগর কিংবা দক্ষিণ চীন সাগর প্রশ্নে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ অবলম্বন করেনি। চীন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী। চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে বাংলাদেশ গুরুত্ব দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে গিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। তখন বেশ কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বেশ কয়েকটি মৈত্রী সেতু চীন তৈরি করে দিয়েছে। নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুতেও চীনা কন্ট্রাক্টরদের ভূমিকা রয়েছে। চীন বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী। গত ২১ মার্চ ঢাকায় কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিকাবের একটি অনুষ্ঠানে চীনা রাষ্ট্রদূত মা সিং ছিয়াং বলেছিলেন, প্রয়োজনে অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চীন এ কাজটি করতে চায়। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য চীনের অনুকূলে থাকলেও চীন এরই মধ্যে পাঁচ হাজার বাংলাদেশি পণ্যের সে দেশে বাজারজাতকরণে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। চীনা বিনিয়োগও বাড়ছে দিনে দিনে। ২০০২ সালে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আমাদের সীমান্ত থেকে চীনের দূরত্ব খুব বেশি দূরে নয়। চীন এই মুহূর্তে এশিয়ার অর্থনীতিতে এক নম্বরে এবং ভারতের অবস্থান তৃতীয়। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীন ও ভারত যে ফ্যাক্টর, তা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ এই দুটি দেশের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে আসছে। বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়। এ ক্ষেত্রে চীন আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে সাহায্য করবে বলে চীনা রাষ্ট্রদূত আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। চলতি আগস্ট মাসে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৪১ বছর পার হবে। এমনি সময়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ঢাকায় আসছেন। নিঃসন্দেহে এটা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় সাফল্য। একুশ শতকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম অগ্রাধিকার হচ্ছে ‘নেক্সট ইলেভেন’ (গোল্ডম্যান স্যাকস-এর মূল্যায়নে) দেশগুলোর কাতারে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করা এবং পররাষ্ট্রনীতিকে সেই লক্ষ্যে সাজিয়ে এটা অর্জন করা। প্রধানমন্ত্রীর জাপান ও চীন সফর, জন কেরির ঢাকা সফর ও চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা আগমন যে আমাদের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। Daily Kalerkontho 06.09.2016
গুরুত্বের সাথে সাথে বিপদও বাড়ছে
ReplyDelete