যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা এখন তুঙ্গে। দুজন প্রার্থী, হিলারি ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক আর রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় কনভেনশনে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছেন। সেই থেকে বিতর্কের মাত্রাটা বেড়েছে। দুজন প্রার্থীই নানা বিতর্কে জড়িয়ে গেছেন এরই মধ্যে। গত ৭ সেপ্টেম্বর এনবিসির সিকিউরিটি ফোরামের বিতর্কে হিলারি ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবারের মতো বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে অনেক বেফাঁস মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ওবামার চেয়ে ভালো প্রেসিডেন্ট মনে করেন। তিনি হিলারি ক্লিনটনের সমালোচনা করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, সাবেক ফার্স্ট লেডি এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। আগামী ৮ নভেম্বর যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, তাতে ডেমোক্রেটিক পার্টি তাঁকে মনোনয়ন দিয়ে ইতিহাসে নাম লেখাল। ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার পর বিগত ২৪০ বছরের ইতিহাসে কোনো নারী কখনো প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। এই প্রথম একজন নারী এ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটি ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সেটা হবে আরেক ইতিহাস। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নারী আন্দোলন তথা নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রে এটা হবে একটি মাইলফলক। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বড় অর্থনীতি ও বড় গণতন্ত্রের দেশ হলেও এখানে নারীদের ভোটের অধিকারের বয়স মাত্র ৯৬ বছর। দীর্ঘদিন এখানে নারীদের ভোটের অধিকার দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে নারী আন্দোলনের ইতিহাসও বিভিন্ন গল্পে পাওয়া যায়। নিঃসন্দেহে হিলারি ক্লিনটনের মনোনয়ন পাওয়া এখানকার নারী আন্দোলনকে আরো উজ্জীবিত করবে। এখানে বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের মতো কনজারভেটিভ সোসাইটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব সীমিত। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান বলে, কংগ্রেসে ৫৩৫টি আসনে (সিনেট ১০০, প্রতিনিধি পরিষদ ৪৩৫) মাত্র ১০৭ জন নারী আইন প্রণেতা রয়েছেন (ডেমোক্র্যাট ৭৬ জন, রিপাবলিকান ২৮ জন)। সিনেটে নারী প্রতিনিধি রয়েছেন ২০ জন (২০ শতাংশ), আর প্রতিনিধি পরিষদে রয়েছেন মাত্র ৮৪ জন (১৯.৩ শতাংশ)। সুতরাং এই সীমিত প্রতিনিধিত্বের মধ্য দিয়ে নারীর পূর্ণ অধিকার রক্ষিত হয়েছে, এটি বলা যাবে না। হিলারি ক্লিনটনের এই মনোনয়ন যুক্তরাষ্ট্রের নারী সমাজের জন্য বড় ধরনের একটি অগ্রগতি। ১৮৪৮ সালে সেনেকা ফলস কনভেনশনে (Seneca Falls Convention) প্রথমবারের মতো নারীদের ভোটাধিকারের দাবি জানানো হয়েছিল। আর ওই কনভেনশনের ১৬৮ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র এবার একজন নারী প্রার্থী পেল, যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নির্বাচনী প্রচারণায় প্রায় প্রতিদিনই হিলারি ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিচ্ছেন। এখন যে প্রশ্নটি অনেকেই করার চেষ্টা করছেন, তা হচ্ছে এই দুজনের একজন যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করবেন তখন কি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে? ট্রাম্পের অভিযোগ, হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে ওবামা প্রশাসনের নীতিই তিনি অব্যাহত রাখবেন। ট্রাম্পের অভিযোগ, ডেমোক্র্যাটরা আইএসকে সৃষ্টি করেছিল এবং হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে আইএস আরো শক্তিশালী হবে ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা আরো ঝুঁকির মুখে থাকবে। ট্রাম্পের আরো অভিযোগ, ওবামা টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তি করে অনেক মার্কিনির চাকরি হারানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হলে এই চুক্তি তথা নাফটা চুক্তির (কানাডা, মেক্সিকো আর যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে মুক্তবাজার) ব্যাপারে তিনি পুনর্মূল্যায়ন করবেন। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেছেন ট্রাম্প। তাঁর অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের অর্থনৈতিক ‘প্রভাব’ বাড়ছে। এই প্রভাব তিনি কমাতে চান। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট শিবিরের বক্তব্য হচ্ছে, ট্রাম্প অতিমাত্রায় দক্ষিণপন্থী, যুদ্ধংদেহী। তিনি প্রয়োজনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু করে দিতে পারেন! তিনি অতিমাত্রায় রাশিয়াপন্থী। রাশিয়ায় তাঁর বিশাল বিনিয়োগ আছে। পুতিনকে তিনি ওবামার চেয়েও যোগ্য নেতা মনে করেন। ফলে ট্রাম্পের অতি ‘রাশিয়াপ্রীতি’ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। ট্রাম্প মূলত মুনাফা অর্জনই বোঝেন। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, মধ্যবিত্তের সামাজিক কাঠামোর মানোন্নয়নের ব্যাপারে তাঁর কোনো কমিটমেন্ট নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি মুসলমান ও মেক্সিকানবিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করার কথাও বলেছেন তিনি। তিনি সেনাবাহিনীর ‘গৌরব’কে আঘাত করেছেন এমন অভিযোগও উঠেছে ডেমোক্র্যাট শিবিরের পক্ষ থেকে। হিলারি যখন সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন, বেতন বৃদ্ধি, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন, সেখানে ট্রাম্প গুরুত্ব দিয়েছেন অভিবাসন রোধ করা ও চাকরির সংখ্যা বাড়ানো ইত্যাদির ওপর।
৮ নভেম্বর নির্বাচন। দুই প্রার্থীই চূড়ান্ত মনোনয়নের পর প্রচারণায় ব্যাপক অংশ নিচ্ছেন। হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্য, অভিবাসীদের পক্ষে কথা বলা, মধ্যবিত্তকে আকৃষ্ট করা, স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলা, টিম কেইনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া। সব মিলিয়ে তাঁর অবস্থান এখন শক্তিশালী বলেই মনে হয়। অন্যদিকে ট্রাম্পের কোনো বক্তব্যই সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তিনি পুরনো রাজনীতিবিদও নন। ওয়াশিংটন ডিসির রিপাবলিকান শিবিরেও তিনি খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। ৭০ বছর বয়সী ট্রাম্প বিপুল অর্থবিত্তের (ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার) মালিক হলেও ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ২০০০ সালে তিনি একবার রিফর্ম পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। তিনি অতীতে কখনো কোনো ‘রাজনৈতিক পদ’ গ্রহণ করেননি। টিভি উপস্থাপকও ছিলেন (রিয়ালিটি শো, এবিসি)। অন্যদিকে হিলারি ক্লিনটনের রাজনৈতিক জীবন বেশ বর্ণাঢ্যময়। তরুণ আইনজীবী হয়ে তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। করপোরেট আইনজীবী না হয়ে তিনি শিশু অধিকার, মাতৃ অধিকার নিয়ে তাঁর কর্মময় জীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ফার্স্ব লেডি, নিউ ইয়র্কের সিনেটর এবং সর্বশেষ সেক্রেটারি অব স্টেট বা বিদেশমন্ত্রী। তুলনামূলক বিচারে রাজনীতি, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ও বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে তাঁর স্পষ্ট ধারণা রয়েছে এবং তিনি অভিজ্ঞ। পররাষ্ট্র তথা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো ধারণাই নেই। ন্যাটো প্রশ্নে, আইএস প্রশ্নে, ব্রেক্সিট প্রশ্নে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তাঁর অজ্ঞতাই স্পষ্ট হয়েছে। নাফটা ও টিপিপি চুক্তির ব্যাপারেও তাঁর অবস্থান হিলারির বিপরীতে। তিনি মনে করেন, নাফটা ও টিপিপি চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বেড়েছে। অথচ হিলারি মনে করেন, এই দুটি চুক্তির কারণে মার্কিন স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে বেশি। ট্রাম্প মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে উঁচু দেয়াল নির্মাণ করে অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে চান। অন্যদিকে হিলারি মনে করেন, মেক্সিকানরা মার্কিন অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন আছে ট্রাম্পের। ডেমোক্র্যাটরা গত আট বছরে (ওবামা প্রশাসনে) যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের হাতে তুলে দিয়েছে—এই অভিযোগ ট্রাম্পের। অন্যদিকে হিলারি মনে করেন, চীনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্কই নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ার অন্যতম শর্ত। ওবামার শাসনামলে আইএসের জন্ম হয়েছে এবং এ জন্য ডেমোক্র্যাটরাই দায়ী, ট্রাম্পের এ ধরনের অভিযোগ স্বীকার করেন না হিলারি ক্লিনটন। হিলারি বলেছেন, তিনি বিদেশমন্ত্রী থাকার সময় ১২২টি দেশ সফর করেছেন এবং প্রায় ১০ লাখ মাইল ভ্রমণ করেছেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্যই। অথচ ট্রাম্প তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। তবে ট্রাম্পের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তিনি সোজাসাপ্টা কথা বলেন। আক্রমণ করে কথা বলেন, যা হিলারি পারেন না কখনো। তিনি তাঁর বক্তৃতায় ট্রাম্পকে আক্রমণ করেন সত্য, কিন্তু তা অনেক মার্জিত ভাষায়। তাই একটি প্রাক-গবেষণায় (সিন কোলারোসি কর্তৃক পরিচালিত) যখন হিলারিকে সর্বোচ্চ নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে বিজয়ী হবেন বলে মন্তব্য করা হয়, আমি তাতে অবাক হই না। ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে ৫৩৮ জন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে হিলারি পাবেন ৩৪৭ ভোট আর ট্রাম্প পাবেন ১৯১ ভোট। নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয় কংগ্রেস সদস্যদের নিয়ে।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বিতর্ক ঘিরে ধরেছে দুই প্রার্থীকে। হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল বিতর্ক তাঁকে যথেষ্ট ভোগাচ্ছে। সর্বশেষ এনবিসির বিতর্কেও তিনি এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। তিনি যখন বিদেশমন্ত্রী ছিলেন তখন তিনি বিদেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্ধারিত ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহার করে বিদেশে যোগাযোগ করেছেন। ওই সব ই-মেইলের কিছু অংশ ফাঁস হয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের দাবি, ট্রাম্পের প্ররোচনায় রাশিয়ার হ্যাকাররা এই ই-মেইল ফাঁস করেছে। অন্যদিকে ট্রাম্প দাবি করেছেন, হিলারি ক্লিনটনের বাকি সব ই-মেইল প্রকাশ করা হোক। এটা নিঃসন্দেহে হিলারি ক্লিনটনের জন্য একটি মাইনাস পয়েন্ট। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও বিপদে আছেন। ডেমোক্র্যাট শিবির তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার। তাঁর স্ত্রী (তৃতীয়) মেলানিয়ার মধ্য নব্বইয়ে তোলা নগ্ন ছবি (তিনি ফটো মডেল ছিলেন) প্রকাশিত হয়েছে, যা ট্রাম্পকে বিব্রত করেছে। সব মিলিয়ে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্ক, অতীতে এমনটা দেখা যায়নি। তবে চূড়ান্ত বিচারে পাল্লা কোন দিকে হেলে পড়ে, এ মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। ১১টি রাজ্যের কথা বলা হচ্ছে (কলোরাডো, ফ্লোরিডা, আইওয়া, মিশিগান, নেভাদা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইয়ো, পেনসিলভেনিয়া, ভার্জিনিয়া ও উইসকনসিন) যাদের বলা হচ্ছে ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড স্টেটস’। এই রাজ্যগুলো বিগত দুটি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এসব রাজ্যের ভোটাররা এখনো দ্বিধাবিভক্ত। তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট সমর্থন কোনো প্রার্থীর পক্ষেই নেই। কখনো তারা ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করে, কখনো রিপাবলিকানদের। এত দিন পর্যন্ত জনমত জরিপে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে থাকলেও ট্রাম্প ব্যবধান অনেকটা কমিয়ে এনেছেন। ফলে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না কে হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।
22.09.2016
0 comments:
Post a Comment