রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সার্ক শীর্ষ সম্মেলন কি আদৌ অনুষ্ঠিত হবে


৯ ও ১০ নভেম্বর ইসলামাবাদে সার্কের ১৯তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এর আগে ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে (২৬-২৭ নভেম্বর) ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে তিক্ততার সম্পর্কের জন্ম হয়েছে, তাতে করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি এ সম্মেলনে যোগ দিতে তার অপারগতার কথা জানান, তাহলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পিছিয়ে দেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকবে না। সার্কের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। আগেও বেশ কয়েকবার সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পিছিয়েছিল। এ অঞ্চলের রাজনীতির উন্নয়নে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক বরাবরই মিডিয়ায় আলোচিত হয়ে আসছে। এ সম্পর্ক কখনও খুব উচ্চতায় উপনীত হয়েছিল, তা বলা যাবে না। মাঝেমধ্যে এ দুই দেশের মাঝে ভালো সম্পর্ক বজায় থাকে, মাঝেমধ্যে আবার উত্তেজনার জন্ম হয়। এতে করে সার্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এবারও তেমন একটি অনিশ্চয়তার জন্ম হয়েছে। বাস্তব ক্ষেত্রে চির বৈরী এ দেশ দুইটির মধ্যে যে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার, সেই আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়নি। ফলে সার্কের মধ্যকার এ দুইটি বড় দেশের মাঝে অনাস্থা সার্কের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তুলনামূলক বিচারে দেখা যায়, অন্যান্য আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক যেভাবে বিকশিত হয়েছে, সে তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের সমন্বয়ে গঠিত সার্ক সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি। সার্ক ডিসেম্বরে ৩১ বছর পার করবে। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে সার্কের জন্ম হয়েছিল। সার্কের চার্টারে প্রতি বছর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সে কারণে ন্যূনতম ৩০টি শীর্ষ সম্মেলন এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। প্রধানত ভারতের আপত্তির কারণে অতীতে একাধিকবার সার্ক সম্মেলন পিছিয়ে গিয়েছিল। কেননা সার্কের চার্টারে বলা আছে, সদস্যভুক্ত কোনো একটি দেশ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে তাদের অপারগতার কথা জানালে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা যাবে না। এবারের সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের ক্ষেত্রেও এমনটির জন্ম হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যদি ভারত আপত্তি জানায়, তাহলে নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় সার্ক সম্মেলন আয়োজন করা যাবে না। প্রশ্ন উঠেছে, ভারতের আপত্তি কেন থাকবে? অতি সম্প্রতি এ অঞ্চলে একাধিক ঘটনা ঘটেছে, যাতে করে ভারতের অংশগ্রহণ না করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং আগস্টে ইসলামাবাদে সার্ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সম্মেলনে দুই দেশের মধ্যে একটি তিক্ততার সম্পর্কের জন্ম হয়েছিল। এমনকি রাজনাথ সিং সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই ইসলামাবাদ ত্যাগ করেছিলেন। সম্মেলন চলাকালীন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলী খান রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে হাতে হাত মেলাননি। এটা ছিল কূটনৈতিক অসৌজন্যতা। রাজনাথ সিং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাসভবনে আয়োজিত ডিনারেও অংশ নেননি। সার্ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে রাজনাথ সিং পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের মদদ দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। বিশেষ করে, কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাকিস্তান সাহায্য করছে বলেও তার অভিযোগ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলী খান বলেছিলেন, স্বাধীনতাকামীদের সন্ত্রাসী বলা ঠিক হবে না। কাশ্মীরে ভারতের দখলদারিত্বের অভিযোগ এনে যারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে, পাকিস্তান তাদের মনে করছে ‘স্বাধীনতাকামী’ হিসেবে। চলতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে (অক্টোবর, ২০১৬) পাকিস্তান কাশ্মীর প্রশ্নটি তুলতে পারে বলে জানা গেছে। ভারত কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ পাকিস্তানের। ফলে একটি তিক্ততার সম্পর্ক এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অতি সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। প্রথমবার তিনি মন্তব্য করেছেন পার্টির সিনিয়র নেতাদের সভায়। সেখানে তিনি বলেছেন, পাকিস্তান বেলুচিস্তানে ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে এবং সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটেছে। এরপর তিনি স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠানে (১৫ আগস্ট, ২০১৬) আবার বেলুচিস্তানের প্রশ্নটি উত্থাপন করেন এবং বেলুচিস্তান, গিয়েগিট ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জনগণ যে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, সে কথাটাও তিনি উল্লেখ করেন। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারতাজ আজিজ। তিনি বলেছিলেন, বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ জড়িত, মোদির বক্তব্যে এটা আবারও প্রমাণিত হলো। তৃতীয়ত, ভারত অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ভারতীয় বিমান ঘাঁটি অদূর ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে পারবে। চতুর্থত, চলতি অক্টোবরে আফগান সমস্যা সমাধানের জন্য নিউইয়র্কে একটি ত্রিদেশীয় (ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-আফগানিস্তান) শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, যাতে পাকিস্তানকে ডাকা হয়নি। স্পষ্টতই এ অঞ্চলে দুইটি জোটের জন্ম হয়েছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অক্ষ, অন্যদিকে চীন-পাকিস্তান অক্ষ। এখানে বলা ভালো, চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে পাকিস্তানের প্রদেশ বেলুচিস্তানের ব্যাপারে। বেলুচিস্তানের গাওদারে চীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত ‘আজাদ কাশ্মীর ও বেলুচিস্তান হয়ে চীন যে একটি অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তুলছে, যাতে চীনের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬ বিলিয়ন ডলার তাতে ভারতের প্রচ- আপত্তি রয়েছে। এ অর্থনৈতিক করিডোর চীনের পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়ান প্রদেশের খাসগর শহরের সঙ্গে গাওদার সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করবে। এতে করে আরব সাগরে চীনের প্রবেশাধিকার সহজ হবে। চীন এ অর্থনৈতিক করিডোরে রেলপথ, সড়কপথ ও তেলের পাইপ লাইন সংযুক্ত করছে। জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা ও চীনা পণ্য ইউরোপসহ যুক্তরাষ্ট্রে পরিবহনের প্রশ্নে এ করিডোর একটি বড় ধরনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে চীনের জন্য। চীন বর্তমানে ৬০০ মাইল দূরে অবিস্থত ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ প্রণালি (যেখান থেকে বিশ্বের ৩৫ ভাগ জ্বালানি তেল সরবরাহ হয়) ব্যবহার করছে। এ অর্থনৈতিক করিডোর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চীন সময় বাঁচাতে পারবে। এতে করে পণ্যের দামও কমে যাবে। মালাক্কা প্রণালির ওপর চীনের নির্ভরতাও (শতকরা ৮০ ভাগ চীনা জ্বালানি এ পথে সরবরাহ হয়) এতে করে কমবে। অনেক কম সময়ে চীনা পণ্য পৌঁছে যাবে ক্যালিফোর্নিয়ার বদলে নিউইয়র্ক। চীন তাই কোনো অবস্থাতেই এ অর্থনৈতিক করিডোরের প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা চাইবে না। বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। অতি সম্প্রতি লন্ডনে বেলুচ ছাত্র সংগঠন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। পাকিস্তান মনে করে, বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন উসকে দেয়ার পেছনে ভারতের ইন্ধন রয়েছে। মজার ব্যাপার, ইরান নিয়ন্ত্রিত বেলুচিস্তানের চাহবারে ভারত একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। একইসঙ্গে চাহবার থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করছে ভারত। এ রেলপথ চাহবার থেকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে আফগানিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এটা সবাই জানে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ভারত আফগানিস্তানের ব্যাপারে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। চলতি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে জাতিসংঘের শীর্ষ বৈঠক প্রাক্কালে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে একটি ত্রিদেশীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে (যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-আফগানিস্তান)। এ বৈঠকে পাকিস্তানকে ডাকা হয়নি। পাকিস্তান মনে করছে, এতে করে তার জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেননা পাকিস্তান এরই মধ্যে আফগানিস্তানে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল।
এ অঞ্চলের রাজনীতি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। একসময় ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে দ্বিপাক্ষিকতা প্রাধান্য পেত। এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিকতার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা (সামরিক ও বাণিজ্যিক) আগামীতে চীনের সঙ্গে ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে যাবে, বলা মুশকিল। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং ১৬ অক্টোবর ভারতের গোয়ায় যাবেন ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। এরই মাঝে খবর বেরিয়েছে, চীন অত্যন্ত গোপনে তিব্বতে সামরিক প্রস্তুতি বাড়াতে শুরু করে দিয়েছে। তিব্বতের এক বিমানবন্দরে চীন জে-২০ স্টেলথ ফাইটার বিমান মোতায়েন করেছে। বলা হচ্ছে, অরুনাচলে ভারত ব্রহ্ম ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন ও লাদাখে শতাধিক ট্যাঙ্ক মোতায়েনের পরিপ্রেক্ষিতেই চীন জে-২০ ফাইটার বিমান মোতায়েন করেছে বলে পত্রপত্রিকা  আমাদের আভাস দিয়েছে। ফলে এ ধরনের সূক্ষ্ম আন্তঃপ্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ভারত ও চীনের মাঝে। এরই মাঝে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি, এই প্রতিযোগিতাকে উসকে দেবে মাত্র। এর ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে অবিশ্বাসের মাত্রা বাড়বে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে এসব কারণেই।
অনেক পর্যবেক্ষকই এখন মনে করেন, সার্ক তার গুরুত্ব হারাচ্ছে। কেননা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জনগণের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সার্ক ৩১ বছর আগে গঠিত হলেও সার্কের উন্নয়ন তেমন একটা চোখে পড়ে না। এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে দরিদ্রতার হার বেড়েছে বৈ কমেনি। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর মাঝে একটি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। বিপুল সংখ্যক মানুষের বসবাস এখানে। কিন্তু দরিদ্রতা এখানে কমেনি। পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে আফগানিস্তানে দরিদ্রতার হার সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৩৬ ভাগ। বাংলাদেশে এই হার ৩২, নেপালে ২৫, পাকিস্তানে ২২, ভুটানে ১২, শ্রীলঙ্কায় ৯, আর ভারতে ৩০ ভাগ। ভারতে হাজার হাজার কোটিপতির জন্ম হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষের নিজস্ব কোনো পায়খানা নেই। তারা প্রকাশ্যে মলমূত্র ত্যাগ করে। জাতিসংঘ প্রণীত মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এমডিজি অর্জনে পূর্ণ সফল হয়নি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। তবে এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের চেয়ে ভালো। বিশেষ করে নারী শিক্ষায় বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে। পিছিয়ে আছে আফগানিস্তান। এক্ষেত্রে সার্ক ফোরাম কোনো বড় ভূমিকা নিতে পারেনি।
মূলত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের পার্থক্য লক্ষ রাখার মতো। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান চরিত্রগত দিক দিয়ে বেশিমাত্রায় মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। খাদ্যাভ্যাস কিংবা জীবনযাত্রার দিক দিয়ে এ দুইটি দেশের সঙ্গে অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পার্থক্য রয়েছে। উপরন্তু রয়েছে এক ধরনের অবিশ্বাস। পাকিস্তান ও ভারতের বৈরিতা ঐতিহাসিক। এ বৈরিতা প্রায় ৭০ বছরেও কমেনি। একইসঙ্গে ভারতের একটি ‘বড়ভাই’সুলভ আচরণে আতঙ্কিত থাকে পার্শ্ববর্তী ছোট দেশগুলো। শ্রীলঙ্কা ও নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে। ভারতের ভূমিকা নিয়ে এসব দেশে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াতে ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। এশিয়ার দ্বিতীয় অর্থনীতি এখন ভারতের। কিন্তু ভারতের এ অর্থনীতি দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে তেমন একটা কাজে লাগেনি। ভারত সাধারণত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এই দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। এখানে বহুপাক্ষিকতা গুরুত্ব পায়নি। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে এ বহুপাক্ষিকতা জরুরি। দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম সমস্যা জ্বালানি। অর্থাৎ বিদ্যুৎ। এ অঞ্চলে প্রচুর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকলেও ভারত এটাকে ব্যবহার করছে তার নিজের স্বার্থে। ভারত ভুটান ও নেপালের সঙ্গে আলাদা আলাদা চুক্তি করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে সংযুক্ত করা হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ পাচ্ছে বটে, কিন্তু তা ত্রিদেশীয় উদ্যোগে উৎপাদিত কোনো বিদ্যুৎ নয়। তাছাড়া ওই বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়েও নানা কথা আছে। আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে ভুটান-বাংলাদেশ-নেপাল ও ভারতের সমন্বয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে তা থেকে উপকৃত হতো এ অঞ্চলের জনগণ। কিন্তু তা হয়নি। আঞ্চলিক বাণিজ্য নিয়েও কথা আছে। এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ভারত রফতানি করে বেশি, আমদানি করে কম। উপরন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশি। আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য সীমিত। এখানেও সমস্যা ভারতকে নিয়ে। টেরিফ এবং প্যারা-টেরিফের কারণে পণ্যের দাম বেশি হয়ে যায়, যাতে ভারতের আমদানিকারকদের আর আগ্রহ থাকে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা আলোচনা করা যেতে পারে। এ সম্পর্ক ভারতের অনুকূলে। ভারত অনেক সময় বেশ কিছু পণ্যের শুল্ক সুবিধা দেয়ার কথা বলে বটে, কিন্তু বাংলাদেশে ওইসব পণ্য আদৌ উৎপাদিত হয় না।
ভারত এরই মধ্যে সার্কের ভেতরে একটি উপআঞ্চলিক সহযোগিতার উদ্যোগ নিয়েছে। মোদির ঢাকা সফরের সময় ঘোষিত হয়েছে এই উপআঞ্চলিক সহযোগিতা, যা বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল) নামে পরিচিত। এ উপআঞ্চলিক সহযোগিতা বাস্তবায়িত হলে সংগত কারণেই সার্ক দুর্বল হয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, ভারত বিবিআইএনের পাশাপাশি বিমসটেক ও ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে অপর দুইটি জোটের ব্যাপারেও আগ্রহ দেখিয়েছে বেশি। দুইটি জোটেই পাকিস্তান নেই। এতে করে একটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে, ভারত চূড়ান্ত বিচারে সার্কের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। শুধু তাই নয়, চীন যে বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত ও মিয়ানমার) জোটের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিল (যা একসময় পরিচিত ছিল কুনমিং উদ্যোগ নামে) তাতেও শ্লথ গতি আসতে পারে। বিসিআইএম জোট, যা চীনের ইউনান প্রদেশকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং বাংলাদেশী পণ্যের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজার উন্মুক্ত করবে, এ মুহূর্তে ভারতের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। ভারতের এ মুহূর্তের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে সংকুচিত করা। ফলে চীনের বাহু হিসেবে পাকিস্তানকে ভারত ‘কূটনৈতিক জালে’ আটকে ফেলে পাকিস্তানের ভূমিকাকে সংকুচিত করতে চাইছে। তাই নভেম্বরে নির্দিষ্ট সময়ে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে এ ব্যাপারে আমার শঙ্কা থেকেই গেল।

ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Alokito bangladesh
11.09.2016

0 comments:

Post a Comment