জাতিসংঘ ৭১ বছরে পা দিয়েছে। সাধারণত প্রতি বছরই এ সময়টাতে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয় এবং বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান তথা রাষ্ট্রপ্রধানরা এ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে থাকেন। এবারও তারা এসেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও এসেছেন। তিনি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণও দিয়েছেন। কিন্তু একটি প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত হয়ে আসছে, আর তা হচ্ছে জাতিসংঘ কি বিশ্ব সমস্যার সমাধানে কোনো বড় ভূমিকা পালন করতে পারছে? আর যদি না পেরে থাকে, তাহলে জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তাও-বা কতটুকু? শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের নীতিনির্ধারণী কাঠামোয় তৃতীয় বিশ্বের; এমনকি মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত বলেও অনেকে মনে করেন। বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থতা, ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে পার্থক্য দূর করা, মধ্যপ্রাচ্যে উগ্রপন্থী রাজনীতির বিকাশ, বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি জাতিসংঘে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা রোধ করার ব্যর্থতা একুশ শতকে জাতিসংঘের ভূমিকাকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সম্প্রতি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অভিবাসন সমস্যা। এ নিয়ে সাধারণ পরিষদের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন শুরুর আগে একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেও, তা ছিল অনেকটা ‘লোক দেখানো’Ñ সেখানে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। ফলে একটা প্রশ্ন থাকলই, এ ধরনের শীর্ষ সম্মেলন করে লাভ কী? বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানরা শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। ৫ মিনিট করে সবাই বক্তব্য দেন (মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আবার একটু বেশি সময় দেয়া হয়)। তারপর ফটোসেশন হয়। ছবি তোলা হয়। পার্টি হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কয়েকজন বিশ্বনেতার সঙ্গে বৈঠকও করেন। সাইড লাইনে কেউ কেউ কথাও বলেন। তারপর যে যার মতো চলেও যান। লাখ লাখ ডলার খরচ করে এ ধরনের শীর্ষ সম্মেলন করার অর্থ কী, যদি কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা না-ই যায়! এ শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন একসময়ে, যখন সিরিয়ায় শিশুরা বোমাবর্ষণে মারা যাচ্ছে। আলেপ্পোতে মানুষ আটকে আছে। তাদের কাছে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছানো যাচ্ছে না। এমনকি খাদ্যদ্রব্য বহনকারী রেডক্রসের গাড়ির বহরের ওপর বোমাবর্ষণ করা হলে, রেডক্রস তাদের তৎপরতা বন্ধ করে দিয়েছে। জাতিসংঘ সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া; এমনকি আফগানিস্তানে ‘যুদ্ধ’ বন্ধ করতে পারেনি। এ যুদ্ধ ওইসব দেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে এ প্রশ্নটা যুক্তিযুক্ত যে, জাতিসংঘ যদি যুদ্ধ থামাতে না পারে, যদি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে এ জাতিসংঘের প্রয়োজন কী? উন্নত বিশ্ব নিজেদের স্বার্থেই জাতিসংঘকে টিকিয়ে রাখছে। ‘যুদ্ধ’ তাদেরই সৃষ্টি। সুতরাং ‘যুদ্ধ’ থেমে যাবে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ১৯৪৫ আর ২০১৬ এক নয়। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো শহরে যে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়েছিল, আজকে সেই জাতিসংঘের সদস্য ১৯৩টি রাষ্ট্র। ১৯৪৫ সালে মাত্র ৫০টি দেশ নিয়ে জাতিসংঘ তার যাত্রা শুরু করেছিল। ১৯৪৫ সালে যে বিশ্ব পরিস্থিতি ছিল, আজকের বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাকে মেলানো যাবে না। তবে এটা সত্য, কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাফল্য রয়েছে। ১৯৯০ সালের উপসাগরীয় প্রথম যুদ্ধ ও কুয়েতকে শত্রুমুক্ত করা, এল সালভাদর, কম্বোডিয়া কিংবা নামিবিয়ায় পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থান পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া ও শান্তি ফর্মুলায় রাজি করানোর মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছিল, যে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থায় জাতিসংঘের একটি ভূমিকা রয়েছে। সাবেক যুগোসøাভিয়ার গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে সেখানে শান্তিরক্ষী পাঠানো, কম্বোডিয়ায় গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে সেখানে শান্তিরক্ষী পাঠানো ও সেখানে একটি সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, নেপালে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করা কিংবা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জাতিসংঘের উদ্যোগ যে কোনো বিবেচনায় প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এর নামে যুক্তরাষ্ট্র যখন ১৫ বছর ধরে আফগানিস্তান, ইরাক আর সিরিয়ায় এক ধরনের ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করে আসছে, জাতিসংঘ সেই ‘যুদ্ধ’ বন্ধ করতে পারেনি। কোনো বড় উদ্যোগও নিতে দেখা যায়নি। একটি পরিসংখ্যান দিই। ‘যুদ্ধে’ ইরাকি নাগরিকের মৃত্যুর সংখ্যা ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ৫৯০ জন। আর যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধের পেছনে খরচ করেছে (ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মতে) এরই মাঝে ৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। আর ২০১৭ সালের বাজেটে যা যুক্ত হবে, তা যোগ করলে এর পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৪ দশমিক ৭৯ ট্রিলিয়ন ডলার। চিন্তা করা যায়, কি বিপুল পরিমাণ অর্থ যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করছে শুধু যুদ্ধের পেছনে? অথচ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি। বিশ্বে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের ব্যাপারে দেশটির ভূমিকা বড়। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মাধ্যমে আফ্রিকা কিংবা দারিদ্র্যপীড়িত দক্ষিণ এশিয়ায় বড় অবদান রাখতে পারত। ব্রাজিলের মতো দেশ, যারা কিনা অলিম্পিক আয়োজন করল, দেশটি একটি ‘বস্তির নগরীর’ দেশে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জাতিসংঘের ভূমিকা এখানে গৌণ। সিরিয়া ও ইরাক থেকে প্রায় ৫০ লাখ অভিবাসী দেশান্তরিত হয়েছে। ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করার সময় কত নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, তার হিসাব কারও কাছেই নেই। জাতিসংঘ এ অভিবাসীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। বেঁচে থাকার আশায় এরা যখন ইউরোপের বনে-জঙ্গলে, রেলস্টেশনে ঘুরে বেড়িয়েছে, জাতিসংঘ এদের সাহায্যে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেনি। প্রশ্নটা তাই ঘুরেফিরে আসবেইÑ জাতিসংঘের প্রয়োজন তাহলে কী?
আসলে জাতিসংঘের কাঠামোয় উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো ভূমিকা নেই। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই ইরাকে হামলা চালিয়েছিল এবং দেশটি দখল করে নিয়েছিল, যা ছিল জাতিসংঘ সনদের বরখেলাপ। অথচ এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়া করাতে পারেনি জাতিসংঘ। সম্প্রতি ব্রিটেনের ওই সময়কার প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার স্বীকার করেছেন, ইরাক আক্রমণ ছিল ভুল। কিন্তু তার এ ‘ভুল’ স্বীকারের জন্য ব্লেয়ার কিংবা ব্রিটেনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (হেগ) বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি। ২০১১ সালে তথাকথিত ‘মানবাধিকার রক্ষায় হস্তক্ষেপ’ এ অভিযোগ তুলে লিবিয়ায় বিমান হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। এ হামলার ফলে গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত হন। কিন্তু দেশটি কার্যত এখন একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ইরাক ও লিবিয়া একসময় ছিল সমৃদ্ধিশালী দুইটি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের শাসকদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, মানুষ সেখানে শান্তিতে ছিল। রাষ্ট্র নাগরিক সুবিধা সেখানে নিশ্চিত করেছিল। আজ রাষ্ট্র দুইটি মূলত দুইটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং রাষ্ট্র দুইটি এখন কার্যত কয়েক টুকরায় ভাগ হয়ে গেছে। এর জন্য দায়ী কে? জাতিসংঘের ভূমিকাইবা এখানে কী? সিরিয়ায় যখন ইলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটল, যখন লাখ লাখ লোক দেশান্তরিত হলো, তখন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ‘মানবাধিকার রক্ষায় হস্তক্ষেপ’ করে সেখানে মেরিন সেনা পাঠায়নি। ১৯৯০ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের মতো জাতিসংঘ সিরিয়ায় সাধারণ মানুষকে রক্ষায় বহুজাতিক সৈন্য পাঠায়নি। অর্থাৎ জাতিসংঘ এখানে বৃহৎ শক্তির স্বার্থের বাইরে যেতে পারেনি। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থেই সিরিয়ায় ‘যুদ্ধ’ জিইয়ে রাখছে। জাতিসংঘের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ বৃদ্ধিতে শক্তিশালী কোনো উদ্যোগ নেই। স্থায়ী পরিষদের সদস্যপদ পাঁচটি, যাদের ‘ভেটো’ পাওয়ার রয়েছে। অস্থায়ী সদস্য রয়েছে ১০টি। স্থায়ী সদস্যপদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কোনো কার্যকরী হয়নি। জাতিসংঘের উদ্যোগে অনেক আগেই ঈড়সসরংংরড়হ ড়হ এষড়নধষ এড়াবৎহধহপব নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জাতিসংঘে কীভাবে সংস্কার আনা যায়, সে ব্যাপারে একটি সুপারিশ করা। সিদ্ধার্থ রামপাল ও ইনভার কলিসন ছিলেন ওই কমিশনের যৌথ চেয়ারম্যান। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। ওই কমিশনের সুপারিশে নিরাপত্তা পরিষদে এক ধরনের ‘স্ট্যান্ডিং’ সদস্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল, যার সদস্য সংখ্যা হবে পাঁচ। এর মধ্যে দুইটি দেশ আসবে উন্নত দেশ থেকে, বাকি তিনটি দেশ আসবে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা থেকে। কিন্তু তাদের কোনো ‘ভেটো’ ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু ২১ বছরেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে থেকে জাপান ও জার্মানি ভেটো ক্ষমতাসহ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ চায়। উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে ভারত স্থায়ী সদস্যপদের দাবিদার। সেখানে আবার চীন ও পাকিস্তানের আপত্তি রয়েছে। ২ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ভারতের। ভারতের দাবি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। কিন্তু ভারতের ব্যাপারে স্থায়ী সদস্যভুক্ত সবার সমর্থন রয়েছেÑ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য দায়ী করা হচ্ছে উন্নত বিশ্বকে। বায়ুম-লে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের কারণেই বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘কপ’ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও এবং সর্বশেষ প্যারিস সম্মেলনে (কপ-২১) একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও, তা বাস্তবায়ন নিয়ে রয়ে গেছে নানা প্রশ্ন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা জাতিসংঘের নেই। জাতিসংঘের সর্বশেষ সম্মেলনে (২০১৫) ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। এর আগে গরষষবহহরঁস উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। এটা বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০১৫ সালে শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অনেক দেশ এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন পশ্চিমা বিশ্বের সাহায্য ও সহযোগিতার। সেই সঙ্গে প্রযুক্তি হস্তান্তরের। এ কাজটি জাতিসংঘ করতে পারবে বলে মনে হয় না।
উদ্বাস্তু সমস্যা এ মুহূর্তে অন্যতম আলোচিত সমস্যা। ৫০ লাখ মানুষ (সিরিয়া-ইরাকের) এখন ‘যুদ্ধের’ কারণে অভিবাসী হয়েছেন। কিন্তু ইউরোপে এটা একটা বড় সমস্যার জন্ম দিয়েছে। ‘ইন্ট্রিগেশন’ নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। উপরন্তু রয়ে গেছে ধর্মীয় সমস্যা। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের কোনো বড় ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘ ৭১ বছরে পা দিয়েছে। সময়টা একেবারে কম নয়। প্রতি বছর একটি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করে আমরা অনেক ভালো ভালো কথা শুনি বটে; কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারেনি। শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্ব যে অর্থ ব্যয় করে, তা অর্থহীন। জাতিসংঘ মূলত একটি ‘টকিং ক্লাবে’ পরিণত হয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতারা আসেন। ছবি তোলেন। বক্তৃতা করেন। ব্যস এ পর্যন্তই। বিশ্ব এক ভয়াবহ সংকটের দিকে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মুসলমান বিদ্বেষ বাড়ছে। একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ মনোভাব বিশ্বে অত্যন্ত সুকৌশলে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। অথচ বিশ্বের জনসংখ্যার ২৩ ভাগ হচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বী (১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মানুষ)। অথচ শান্তির ধর্ম ইসলামকে বিতর্কিত করা হচ্ছে। ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকা-কে এক করে দেখানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং একটা প্রশ্ন থাকলইÑ প্রায় ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক ব্যয় নিয়ে (২০১৬-১৭ বাজেট) এ প্রতিষ্ঠানটি আর কত দিন টিকে থাকবে? শুধু ফটোসেশন আর বক্তৃতা দেয়ার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না। সুতরাং জাতিসংঘের সংস্কারটা জরুরি। হ
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
আসলে জাতিসংঘের কাঠামোয় উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো ভূমিকা নেই। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই ইরাকে হামলা চালিয়েছিল এবং দেশটি দখল করে নিয়েছিল, যা ছিল জাতিসংঘ সনদের বরখেলাপ। অথচ এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়া করাতে পারেনি জাতিসংঘ। সম্প্রতি ব্রিটেনের ওই সময়কার প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার স্বীকার করেছেন, ইরাক আক্রমণ ছিল ভুল। কিন্তু তার এ ‘ভুল’ স্বীকারের জন্য ব্লেয়ার কিংবা ব্রিটেনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (হেগ) বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি। ২০১১ সালে তথাকথিত ‘মানবাধিকার রক্ষায় হস্তক্ষেপ’ এ অভিযোগ তুলে লিবিয়ায় বিমান হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। এ হামলার ফলে গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত হন। কিন্তু দেশটি কার্যত এখন একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ইরাক ও লিবিয়া একসময় ছিল সমৃদ্ধিশালী দুইটি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের শাসকদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, মানুষ সেখানে শান্তিতে ছিল। রাষ্ট্র নাগরিক সুবিধা সেখানে নিশ্চিত করেছিল। আজ রাষ্ট্র দুইটি মূলত দুইটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং রাষ্ট্র দুইটি এখন কার্যত কয়েক টুকরায় ভাগ হয়ে গেছে। এর জন্য দায়ী কে? জাতিসংঘের ভূমিকাইবা এখানে কী? সিরিয়ায় যখন ইলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটল, যখন লাখ লাখ লোক দেশান্তরিত হলো, তখন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ‘মানবাধিকার রক্ষায় হস্তক্ষেপ’ করে সেখানে মেরিন সেনা পাঠায়নি। ১৯৯০ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের মতো জাতিসংঘ সিরিয়ায় সাধারণ মানুষকে রক্ষায় বহুজাতিক সৈন্য পাঠায়নি। অর্থাৎ জাতিসংঘ এখানে বৃহৎ শক্তির স্বার্থের বাইরে যেতে পারেনি। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থেই সিরিয়ায় ‘যুদ্ধ’ জিইয়ে রাখছে। জাতিসংঘের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ বৃদ্ধিতে শক্তিশালী কোনো উদ্যোগ নেই। স্থায়ী পরিষদের সদস্যপদ পাঁচটি, যাদের ‘ভেটো’ পাওয়ার রয়েছে। অস্থায়ী সদস্য রয়েছে ১০টি। স্থায়ী সদস্যপদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কোনো কার্যকরী হয়নি। জাতিসংঘের উদ্যোগে অনেক আগেই ঈড়সসরংংরড়হ ড়হ এষড়নধষ এড়াবৎহধহপব নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জাতিসংঘে কীভাবে সংস্কার আনা যায়, সে ব্যাপারে একটি সুপারিশ করা। সিদ্ধার্থ রামপাল ও ইনভার কলিসন ছিলেন ওই কমিশনের যৌথ চেয়ারম্যান। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। ওই কমিশনের সুপারিশে নিরাপত্তা পরিষদে এক ধরনের ‘স্ট্যান্ডিং’ সদস্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল, যার সদস্য সংখ্যা হবে পাঁচ। এর মধ্যে দুইটি দেশ আসবে উন্নত দেশ থেকে, বাকি তিনটি দেশ আসবে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা থেকে। কিন্তু তাদের কোনো ‘ভেটো’ ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু ২১ বছরেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে থেকে জাপান ও জার্মানি ভেটো ক্ষমতাসহ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ চায়। উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে ভারত স্থায়ী সদস্যপদের দাবিদার। সেখানে আবার চীন ও পাকিস্তানের আপত্তি রয়েছে। ২ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ভারতের। ভারতের দাবি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। কিন্তু ভারতের ব্যাপারে স্থায়ী সদস্যভুক্ত সবার সমর্থন রয়েছেÑ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য দায়ী করা হচ্ছে উন্নত বিশ্বকে। বায়ুম-লে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের কারণেই বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘কপ’ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও এবং সর্বশেষ প্যারিস সম্মেলনে (কপ-২১) একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও, তা বাস্তবায়ন নিয়ে রয়ে গেছে নানা প্রশ্ন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা জাতিসংঘের নেই। জাতিসংঘের সর্বশেষ সম্মেলনে (২০১৫) ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। এর আগে গরষষবহহরঁস উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। এটা বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০১৫ সালে শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অনেক দেশ এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন পশ্চিমা বিশ্বের সাহায্য ও সহযোগিতার। সেই সঙ্গে প্রযুক্তি হস্তান্তরের। এ কাজটি জাতিসংঘ করতে পারবে বলে মনে হয় না।
উদ্বাস্তু সমস্যা এ মুহূর্তে অন্যতম আলোচিত সমস্যা। ৫০ লাখ মানুষ (সিরিয়া-ইরাকের) এখন ‘যুদ্ধের’ কারণে অভিবাসী হয়েছেন। কিন্তু ইউরোপে এটা একটা বড় সমস্যার জন্ম দিয়েছে। ‘ইন্ট্রিগেশন’ নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। উপরন্তু রয়ে গেছে ধর্মীয় সমস্যা। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের কোনো বড় ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘ ৭১ বছরে পা দিয়েছে। সময়টা একেবারে কম নয়। প্রতি বছর একটি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করে আমরা অনেক ভালো ভালো কথা শুনি বটে; কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারেনি। শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্ব যে অর্থ ব্যয় করে, তা অর্থহীন। জাতিসংঘ মূলত একটি ‘টকিং ক্লাবে’ পরিণত হয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতারা আসেন। ছবি তোলেন। বক্তৃতা করেন। ব্যস এ পর্যন্তই। বিশ্ব এক ভয়াবহ সংকটের দিকে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মুসলমান বিদ্বেষ বাড়ছে। একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ মনোভাব বিশ্বে অত্যন্ত সুকৌশলে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। অথচ বিশ্বের জনসংখ্যার ২৩ ভাগ হচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বী (১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মানুষ)। অথচ শান্তির ধর্ম ইসলামকে বিতর্কিত করা হচ্ছে। ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকা-কে এক করে দেখানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং একটা প্রশ্ন থাকলইÑ প্রায় ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক ব্যয় নিয়ে (২০১৬-১৭ বাজেট) এ প্রতিষ্ঠানটি আর কত দিন টিকে থাকবে? শুধু ফটোসেশন আর বক্তৃতা দেয়ার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না। সুতরাং জাতিসংঘের সংস্কারটা জরুরি। হ
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Alokito Bangladesh
25.09.2016
0 comments:
Post a Comment