রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কেরির সফরে কী পেল বাংলাদেশ

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তার বাংলাদেশ সফর শেষ করলেন ২৯ আগস্ট। মাত্র ৯ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে তিনি জেনেভা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারপর তিনি গেছেন নয়াদিল্লিতে। কিন্তু জন কেরির এই সফরে কী পেল বাংলাদেশ? যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের যে প্রত্যাশা, তা কি পূরণ হয়েছে জন কেরির এ সফরের মধ্য দিয়ে? অনেকগুলো ইস্যুতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের ‘শীতল সম্পর্ক’ বজায় রয়েছে। জন কেরির এই সফরে তার একটির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয়নি আমার। মনে রাখতে হবে, জন কেরি ওবামা প্রশাসনের শেষ সময়ে এসে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। আগামী নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। একজন নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করবেন ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি। একজন সম্ভাব্য ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী (হিলারি ক্লিনটন) এ নির্বাচনে বিজয়ী হলেও জন কেরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকবেন কিনা, তা নিশ্চিত নয়। ফলে জন কেরির এ সফর ছিল অনেকটা ‘রুটিন ওয়ার্ক’। তার মূল সফর ছিল নয়াদিল্লি। সেখানে তিনি দ্বিতীয় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড কমার্শিয়াল ডায়ালগে অংশ নেন। একাধিক কারণে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শুধু বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণেই নয়, বরং কৌশলগত কারণে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে ভারতের। বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে। ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব বেড়েছে। এই অঞ্চলে চীনের নৌবাহিনীর তৎপরতা শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, বরং ভারতেরও চিন্তার কারণ। একই সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনা বাড়ছে। এ অঞ্চলের কর্তৃত্বের প্রশ্নে চীনের দাবি খারিজ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক আদালত। রায় হয়েছে ফিলিপাইনের পক্ষে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে এ অঞ্চলে। এর আশপাশে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ টহল দিচ্ছে। চারটি ভারতীয় যুদ্ধজাহাজও এ এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে নীতি, তার প্রধান দুই স্তম্ভ হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগর। এ অঞ্চলে আগামী দিনগুলো প্রত্যক্ষ করবে বড় ধরনের উত্তেজনা। সঙ্গত কারণেই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অত বেশি না থাকলেও ভারতের গুরুত্ব অনেক বেশি। তারপরও জন কেরির এ সফর বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এক্ষেত্রে জন কেরির ঢাকায় দেয়া বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। তিনি টুইট করেছেন। তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ কিংবা প্রধান বিরোধী দল নেত্রীর সাক্ষাতের পর তাদের নিজ নিজ পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়া হয়েছে। আল জাজিরা একটি প্রতিবেদন দিয়েছে কেরির ঢাকা সফরের পর। এমনকি রয়টার্সও এমন একটি সংবাদ দিয়েছে, যা বাংলাদেশের কোনো পত্র-পত্রিকার অনলাইনে আমি দেখিনি। কেরির ঢাকা সফরে এটি আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।
আল জাজিরা এবং রয়টার্সের বক্তব্য অনেকটা একই রকম। জন কেরি মনে করেন, ‘বাংলাদেশে আইএসের সঙ্গে স্থানীয় জঙ্গিদের সম্পর্ক রয়েছে। এরকম তথ্য তাদের কাছে আছে’ (রয়টার্স)। আইএস বিশ্বব্যাপী যে আটটি সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, তার একটির অস্তিত্ব রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় (আল জাজিরা, ২৯ আগস্ট)। বিষয়টি আমাদের জন্য বেশ স্পর্শকাতর। অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এক ধরনের ‘চাপের’ মুখে আছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ স্বীকার করুক বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব আছে(?)। যদিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে আইএস বা ইসলামী স্টেটের কোনো অস্তিত্ব নেই, তবে ‘হোম গ্রোন’ অর্থাৎ স্থানীয় জঙ্গি রয়েছে, যারা চেষ্টা করছে আইএসের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে যত জঙ্গি হামলা হয়েছে, তার প্রতিটির সঙ্গে আইএস জড়িত রয়েছে বলে সাইট ইন্টেলিজেন্স দাবি করে আসছে। অভিযোগ আছে, সাইট ইন্টেলিজেন্স নামক জঙ্গি পর্যবেক্ষণ সংস্থাটি ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার অর্থে ও তাদের স্বার্থে পরিচালিত হয়। আমরা অনেক দিন থেকেই বলে আসছি, সাইটটি কোনো ধরনের গবেষণা ও তথ্যউপাত্ত ছাড়াই বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব সংবাদ পরিবেশন করে আসছে, তার উদ্দেশ্য সৎ নয়। বরং আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তা যারাই সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন (যেমন নিশা দেশাই বিসওয়াল, দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী), তারা আকার-ইঙ্গিতে বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব রয়েছে, এটা বলতে চেয়েছেন। এখন কেরিও অনেকটা সে সুরে কথা বলে গেলেন। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আগের মতোই রয়টার্সকে জানিয়েছেন যে, ‘আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। স্থানীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব আছে।’ বাংলাদেশের এই ‘অবস্থান’ই সঠিক। আমাদের পর্যবেক্ষণে কখনও মনে হয়নি যে, বাংলাদেশে আইএস আছে। স্থানীয় জঙ্গিরা চেষ্টা করছে আইএসের সঙ্গে একটা ‘সম্পর্ক’ তৈরি করতে। কেরির সফরে দুই দেশ জঙ্গি লড়াইয়ে অতিরিক্ত গোয়েন্দা সহযোগিতা, প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এটা ভালো সিদ্ধান্ত। কেননা বাংলাদেশ প্রথম থেকেই বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকা-ের নিন্দা জানিয়ে আসছে। সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্সের’ অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। তবে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ধরন পাল্টেছে। বৈশ্বিক সন্ত্রাসীরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিতে পারি। আমাদের গোয়েন্দাদের আরও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশ যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে, এটা স্বয়ং কেরি স্বীকার করে গেছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। কেননা বিশ্ব অর্থনীতিতে যখন এখনও শ্লথগতি চলছে, তখন বাংলাদেশ তার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপর ধরে রেখেছে। তৈরি পোশাক নিয়ে হাজারো প্রতিবন্ধকতার মাঝেও যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের রফতানি বেড়েছে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যও বাংলাদেশের অনুকূলে। কেরির উপস্থিতিতে বাংলাদেশ জেএসপি সুবিধার বিষয়টি পুনর্বার উল্লেখ করেছে। জেএসপি, বিশেষ করে তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার বিষয়টির ব্যাপারে বাংলাদেশের দাবি ন্যায্য। কেননা বাংলাদেশ এরই মধ্যে জেএসপি প্রশ্নে সব শর্ত পূর্ণ করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের জেএসপি সুবিধা প্রাপ্তির দাবিটি ন্যায্য। গোল্ডম্যান স্যাকসের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ ‘নেক্সট ইলেভেন’ভুক্ত দেশগুলোর অন্যতম। অর্থাৎ আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ১১টি দেশ আত্মপ্রকাশ করছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশ তার লক্ষ অর্জন করতে সক্ষম হবে। কেরির সফরের সময় এরকম একটি মেসেজ বাংলাদেশ দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্যসেবা ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতার কথা কেরি বলেছেন। এক টুইট বার্তায় কেরি বলেছেন, ২০৫০ সালের দিকে বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হবে। এর অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা কেরি স্বীকার করে নিলেন। বাংলাদেশ অতীতে প্রতিটি জলবায়ু সংক্রান্ত ‘কপ’ শীর্ষ সম্মেলনে এই বাস্তুচ্যুতদের কথা বলে আসছে। সারা বিশ্বই এখন স্বীকার করে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মাঝে বাংলাদেশ অন্যতম। সুতরাং এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। বিশেষ করে নবায়নকৃত জ্বালানির ক্ষেত্রে এ সহযোগিতাটা বড় প্রয়োজন।
জন কেরি ঢাকা সফরকালে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন এবং একান্তে কথা বলেছেন। এটা ভালো। প্রটোকল অনুযায়ী খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার দেখা করার কথা নয়। তিনি দেখা করেছেন। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, বেগম জিয়া নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছেন। আর মীর্জা ফখরুল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘মার্কিন সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।’ এ ধরনের বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা একটি ভিন্ন ব্যাখ্যার জন্ম দিতে পারে। বরং বিএনপির উচিত হবে, আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং সে মতে কাজ করা। জনগণের আস্থা পেতে হলে জনগণের কাছে যাওয়াই মঙ্গল। বিদেশিদের প্রতি নির্ভরশীলতা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক নয়।
জন কেরির ঢাকা সফর সংক্ষিপ্ত ছিল। তারপরও এই সফরের কিছুটা গুরুত্ব রয়েছে। যদিও তার এই সফর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির জন্য কোনো দিকনির্দেশনা দেবে না। জন কেরি ওবামা প্রশাসনের শেষ সময়ে এসে ঢাকা সফর করলেন। আগামী নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নয়া প্রশাসন হোয়াইট হাউসে স্থলাভিষিক্ত হবে। ফলে জন কেরি বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো মার্কিন নীতি পরিবর্তনও করতে পারবেন না। তিনি নয়া প্রশাসনে (যদি ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচনে বিজয়ী হয়) থাকবেন কিনা, তাও স্পষ্ট নয়। মূলত ভারতকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত মার্কিন নীতি প্রণীত হয়েছে। জন কেরি ঢাকা সফর শেষ করে নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন। একই সময় ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও এসেছিলেন ওয়াশিংটনে। একটা নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতেই বোঝা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের অবস্থান কত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি তাতেও ভারত একটি ফ্যাক্টর। ভারতকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে এমন কোনো ‘সম্পর্ক’ স্থাপন করবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ ক্ষুণœ হয়। জন কেরির সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ হচ্ছেÑ বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি আরও বেড়েছে। বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন মডেল’ স্বীকৃতি পেয়েছে। জঙ্গি দমনে সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ যেসব সমস্যার সম্মুখীন, তার মোকাবিলায় সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গেছে। এ ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে আগামী দিনগুলোয়।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Alokito Bangladesh
02.09.2016

0 comments:

Post a Comment