রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অতঃপর কী, এমন প্রশ্ন আছে অনেক

প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম জিয়ার নির্বাচন বয়কটের আহ্বান, টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আর সহিংস ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো গত ৫ জানুয়ারি। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নামে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই নির্বাচনের ও আন্তর্জাতিক আসরে এর আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না, এটা সরকারের নীতি-নির্ধারকদের অনেকেই বিশ্বাস করেন। আর তাই অর্থমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘সমঝোতা হলে যে কোনো সময় আরেকটি নির্বাচন হতে পারে।’ আমাদের দেশে সাচ্চা গণতন্ত্রের বয়স খুব বেশি দিনের নয়। বলা যেতে পারে পঞ্চম সংসদ (১৯৯১) থেকেই আমরা গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম! ওই সংসদে গণতন্ত্রকে স্থায়ী ভিত্তি দিতে সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ২২ বছরের মধ্যে এই গণতন্ত্রচর্চা মুখ থুবড়ে পড়ল। দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো অনেকটা একদলীয়ভাবে। ১৫৩ সংসদ সদস্যের ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি অনেক কিছু ম্লান করে দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতি এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ‘নাটক’ প্রমাণ করার জন্য ক্ষমতাসীনরা ‘গণতন্ত্রের নামে’ যা কিছু করেছেন তা কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করল। দুই-তৃতীয়াংশ আসনে একটি দলের বিজয় যে একটি দেশের জন্য কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, ক্ষমতাসীন সরকার এর বড় প্রমাণ। এ ঘটনা ‘গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে’ যেমনি বাধাগ্রস্ত করল, ঠিক তেমনি একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল ভবিষ্যতের জন্য। ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারাও ঠিক একই ‘কাজ’ করবেন! একটি অন্যায় যেমনি আরেকটি অন্যায়কে ডেকে আনে, ঠিক তেমনি দশম সংসদ নির্বাচনের অনিয়মতান্ত্রিকতা ভবিষ্যতে আরো একটি ‘দশম সংসদ নির্বাচন’-এর মতো সংসদ নির্বাচনের জন্ম দেবে। এই প্রবণতা আমরা রোধ করতে পারব না। গণতন্ত্রে একটি নির্বাচিত সরকার যেমনি থাকে, ঠিক তেমনি থাকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলও। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা অন্যতম একটি শর্ত। এই আস্থা ও বিশ্বাস না থাকলে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যায় না। বাংলাদেশে আমরা গণতন্ত্র চেয়েছি, কিন্তু বিশ্বাস ও আস্থা নেই। আর নেই বলেই আমরা সবাই মিলে ‘সকল দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের’ একটি আবহ তৈরি করতে পারলাম না। এখন দশম সংসদ নির্বাচনকে আমরা কীভাবে বিশ্লেষণ করব? ১৫৩ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এর মাঝে ১২৭ জন আওয়ামী লীগের, ওয়ার্কার্স পার্টির ২ জন, জাসদের ৩ জন, জাতীয় পার্টির ২০ জন ও জেপির ১ জন। ১৪৭ আসনে যেখানে তথাকথিত নির্বাচন হয়েছে, সেখানে অনেক জায়গায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের’ প্রার্থীরাই। ওইসব আসনে ভোটার ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। প্রার্থী ছিলেন ৩৯০ জন। মোট ১৮ হাজার ২০৮টি ভোটকেন্দ্রের সবটিতে সুষ্ঠু ভোট হয়নি। ভোটারের উপস্থিতির হার ছিল বিএনপির মতে ৪ শতাংশ আর সরকারি মতে ৬০ শতাংশ। আওয়ামী লীগ এখন নতুন করে ‘দ্বিতীয় আরেকটি মহাজোট সরকার’ গঠন করতে পারে। কিন্তু আরো ৭৩টি আসন নিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিশ্চিত করে সংবিধানেও আরো ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে আওয়ামী লীগ। নবম সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে আওয়ামী লীগ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আবারো সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে এই সন্দেহ এখন কোনোভাবেই অমূলক নয়। সংসদীয় রাজনীতির একটা বড় সৌন্দর্য হচ্ছে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব। কিন্তু দশম সংসদ নিয়ে ইতোমধ্যে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এই সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে কোন দল? জাতীয় পার্টিকে আপাতত ভাবা হচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশীদার। উপরন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জাতীয় পার্টির মন্ত্রী ও উপদেষ্টা আছেন একাধিক। ২৭টি আসনে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেয়নি। ফলে জাতীয় পার্টিকে কেন্দ্র করে গুজবের ডালপালা বাড়বেই। তবে জাতীয় পার্টি ও এর নেতা এইচএম এরশাদ ইতোমধ্যে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ‘অসুস্থ’ হয়ে গল্ফ খেলে তিনি ‘চিকিৎসা নিচ্ছেন’ সিএমএইচে। এই গল্ফ খেলাটা নাকি তার চিকিৎসার অংশ! আমাদের দুর্ভাগ্য, ওবায়দুল কাদেরের মতো রাজনীতিকের কাছ থেকেও আমাদের এ ধরনের কথা শুনতে হয়। ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য যখন পত্রিকায় ছাপা হয়, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। বলতে দ্বিধা নেই, অতীতে ওবায়দুল কাদের তার বক্তব্য ও নেতৃত্বের গুণে নিজেকে একজন যোগ্য এবং খাঁটি নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। যে কারণে দীর্ঘদিন তিনি মন্ত্রিসভায় না থাকলেও মহাজোট সরকারের শেষের দিকে তিনি মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এখন তিনিই কি-না বললেন এ কথা! যারা সংবাদপত্র নিয়মিত পাঠ করেন তারা দেখেছেন এই নির্বাচনকে ঘিরে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বাজে ধারণার জন্ম হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি রাশিয়া কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রভাবশালী কলকাতার বাংলা সংবাদপত্র আনন্দবাজার বলছে, ‘খুব দ্রুত একাদশ নির্বাচনের প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছে ভারত।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন ‘ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের তালিকায় বাংলাদেশের’ নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে। যে ১০টি দেশকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তার মাঝে বাংলাদেশের নামও আছে। কী দুর্ভাগ্য, যেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষী পাঠাতে অনুরোধ করেন, সেই বাংলাদেশই কি-না এখন ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত হলো! যে যুক্তি ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের গবেষকরা উল্লেখ করেছেন তা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। অনেকেই জানেন প্রভাবশালী এই সাময়িকীটি মার্কিন নীতি-নির্ধারণে প্রভাব খাটায়। নির্বাচন হয়ে গেল, কিন্তু ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ তাতে থাকল না। আমাদের রাজনীতিবিদরা বাস্তবতাকে অনুসরণ করতে পারলেন না। নির্বাচন পেছানোর সুযোগ ছিল। সংবিধানের ১২৩ (৪) ধারা অনুযায়ী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পেছানো সম্ভব ছিল। সংবিধানের এই ধারায় ‘দৈব দুর্বিপাকের’ যে কথা বলা হয়েছে তার ব্যাখ্যা এই ক্রান্তিকালে উচ্চ আদালতই দিতে পারতেন। একমাত্র সরকারই উচ্চ আদালতের কাছে একটা রেফারেন্স চাইতে পারত। বিরোধী দল এই রেফারেন্স চাইতে পারে না। আমরা এ সুযোগটাও হারালাম। নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতার যে চিত্র আমরা দেখেছি, তা যে কোনো বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য। এই সহিংসতা গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সুস্থ রাজনৈতিকচর্চা এখন আরো ঝুঁকির মুখে পড়ল। আগামীতে শিক্ষিত তরুণ প্রজšে§র রাজনীতিতে আসার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল তারা এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। নিউইয়র্কের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু যে দেশটি এখন বিশ্বে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি মডেল (শান্তি রক্ষায় অংশগ্রহণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, দারিদ্র্যসীমা কমিয়ে আনা, এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ইত্যাদি), সেই দেশটির সব উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা এখন কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়ল। আমাদের নেতারা ব্যর্থ হলেন সমঝোতায় পৌঁছতে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে একদলীয় নির্বাচন সম্পন্ন হলো। তাই ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের বক্তব্যকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাদের বাংলাদেশের ব্যাপারে ‘গৃহযুদ্ধের’ মূল্যায়ন আমাদের সব অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম দিতে পারে। এই প্রতিবেদনটি যা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গত ২ জানুয়ারি; ঠিক তার একদিন পর বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) বার্ষিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। বিএমবিএস বলছে ২০১৩ সালে দেশজুড়ে যে সহিংসতা হয়েছে, তাতে মারা গেছেন ৫৭৩ জন মানুষ, যার মাঝে পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। আর আহতদের সংখ্যা ১০ হাজার ৪০৩ জন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে মানুষ মারা যাবে, এটা অকল্পনীয়। ‘গৃহযুদ্ধের’ ধারণা যারা দেন, তারা এই পরিসংখ্যানকে এখন ইস্যু করতে পারেন। এই নির্বাচনে ১৫৩ প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় শতকরা ৫২ ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হলেন। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদের এটা পরিপন্থী, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ‘প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর (১৯৯১) মাধ্যমে এই শব্দগুলো সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। আমাদের সবার মাঝে একটা ধারণা রয়েছে যে, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব, কিন্তু ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ এত বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর বিজয়(?) প্রমাণ করল নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ। তাদের এই ব্যর্থতার প্রশ্নটিই তুলেছেন সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার। বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে সরকারের প্রভাবের বাইরে কাজ করতে পারে না, তা আরো একবার প্রমাণিত হলো। একাধিক ক্ষেত্রে ইসির ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। সরকারের চাপ উপেক্ষা করে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা কমিশনের সফলতা হিসেবেই বিবেচিত, কিন্তু ‘সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি না জানিয়ে’ ইসি বিতর্কিত হয়েছে। কমিশন ২৮ জুলাই নিজের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে প্রার্থিতা বাতিল সম্পর্কিত আরপিওর ৯১ (ই) ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও পরে প্রতিবাদের মুখে ইসি সরে আসে। মিথ্যা হলফনামা দিয়ে কেউ নির্বাচিত হলে তার নির্বাচন বাতিল, নির্বাচনে কারচুপি হলে গ্রহণযোগ্য হবে না, এটা যদি ইসির কাছে প্রতীয়মান হয়, তাহলে ওই নির্বাচন বাতিল করার সক্ষমতাও ইসির নেই। আর্থিক ব্যাপারগুলোতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ অবমুক্তি করার দাবিরও কোনো সমাধান হয়নি। এর মধ্য দিয়ে সরকারের প্রভাব বিস্তার করার একটা সুযোগ থেকে যায়। সুতরাং ইসির বর্তমান কাঠামোয় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা যে সম্ভব নয়, তা আবারো প্রমাণিত হলো। এমনকি দশম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকার সমর্থকরা বিগত ৫ বছরে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। ‘সুজন’ নামক সংস্থাটি এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা একটি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে শীর্ষস্থানীয় সরকারি দলের নেতাদের অর্থ-সম্পদ কীভাবে বেড়েছে। সুস্থ রাজনীতিচর্চার জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। ক্ষমতায় গেলেই বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হতে হবে এটা যদি ‘স্টাবলিস্ট’ হয়ে যায়, তাহলে রাজনীতি শুধু অর্থবানদেরই টানবে। অনেক অরাজনৈতিক ব্যক্তি, দুর্নীতিপরায়ণ আমলা শুধু অর্থ-সম্পদ বানানোর জন্য ‘রাজনীতির’ খাতায় নাম লেখাবেন। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকারি দলের যারা নির্বাচিত(?) হয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা করে পার্টি ফান্ডে জমা দিতে বলা হয়েছে। এটাও একটা বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং তাদের পরোক্ষভাবে দুর্নীতিতে উৎসাহিত করা হলো। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিদেশি দূতদের ‘শেষবারের মতো’ দৌড়ঝাঁপ করতে আমরা দেখেছি। এর আগে এক এক করে তারানকো, সুজাতা সিং, ওয়ার্সি কিংবা নিশার মতো বিদেশি দূতদের একটা ‘সমঝোতা’ করার উদ্যোগ নিতে আমরা দেখেছি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বিদেশি দূতদের বারবার ‘হস্তক্ষেপের’ ঘটনা বিদেশিদের কাছে প্রমাণ করল, আমরা আমাদের সমস্যা সমাধান করতে পারি না। এটা শুধু বাজে দৃষ্টান্তই নয়; বরং ভবিষ্যতে এ আবারো ‘হস্তক্ষেপের’ পথ প্রশস্ত করল। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যমআয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার কথা বলেছেন। শুনতে এটা ভালোই শোনায়। আমি নিজেও মনে করি বাংলাদেশ হচ্ছে একটি ‘সফট পাওয়ার’ সক্ষমতার দিক থেকে শক্তি। কিন্তু এই ‘শক্তি’ এখন মুখ থুবড়ে পড়ল। বিএনপি দাবি করেছে বেগম জিয়া গৃহবন্দি। বেগম জিয়া যে এক রকম ‘অন্তরীণ’ অবস্থায় তা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। দলের নেতাদের তো বটেই, এমনকি নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতাকে পর্যন্ত বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এ থেকেই এটা স্পষ্ট, তিনি এক রকম অন্তরীণ। প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্ট আমাদের জানাচ্ছে যে, নতুন সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবেই অন্তরীণ থাকবেন! যদিও বেগম জিয়ার অন্তরীণ অবস্থা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট সরকারি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। নির্বাচনের আগের দিন ও নির্বাচনের দিন দেশজুড়ে নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে সহিংসতা চলে। বেশক’টি কেন্দ্র জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। পাবনায় এক মন্ত্রীপুত্রের কাহিনী সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। এসব কি সরকারের জন্য আদৌ সুখের? সরকার একটা ‘বাজে’ দৃষ্টান্ত তৈরি করল। বিদেশি পর্যবেক্ষকরা তো আসেনইনি, যারা এসেছেন (মোট ৪ জন), তাদের একজন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের নির্বাচনী কর্মকর্তা আশুতোষ জিন্দালও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেননি। উৎসবমুখর পরিবেশে যে ভোট হয়নি, তা তার দৃষ্টি এড়ায়নি। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে অতঃপর কী? বিএনপি ও ১৮ দল আবারো ৪৮ ঘণ্টার হরতাল এবং অবরোধের ডাক দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি একটি মেসেজ দিচ্ছে এবং তা হচ্ছে সমঝোতা না হলে তারা তাদের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এতে লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু দেশটির তো অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। বাংলাদেশ এ ক্ষতি মেনে নিতে পারে না। অর্থনীতিতে তা বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এখন সরকারের নীতি-নির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা ভেঙে যাওয়া সংলাপ অব্যাহত রাখবেন, নাকি ‘নির্বাচিত সংসদ’-এর যুক্তি তুলে ধরে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করবেন। সংলাপ যদি শুরু না হয়, অবরোধ যদি চলতে থাকে আর সহিংসতার মাত্রা যদি আরো বেড়ে যায়, তাহলে তা যে অসাংবিধানিক শক্তিকে উৎসাহ জোগাবে, এমনটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায় সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, আমরা এটাই প্রত্যাশা করি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘বিজয়’ প্রকারান্তরে দলটির ‘পরাজয়’ই ডেকে আনল Daily Manobkontho 07.01.14

0 comments:

Post a Comment