রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতায় দেশ

শেষ পর্যন্ত সব আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ইতিহাসে এ নির্বাচন কিভাবে চিহ্নিত হবে সেটা একটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু এ মুহূর্তে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় পেয়ে বসেছে প্রত্যেক মানুষকে। কী হবে আগামী দিনগুলোতে? দাতারা কোন দৃষ্টিতে দেখবে এ নির্বাচন? নয়া সরকার কি পাঁচ বছরই টিকে থাকবে? অনেক প্রশ্ন এখন আমাদের সম্মুখে। আর প্রশ্নগুলোর যে জবাব আমরা পাই, তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। এক. প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে (২ জানুয়ারি) বলেছেন, গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতেই নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা বলেননি। সংবিধান নির্বাচনের কথাই বলে। তবে এ নির্বাচন নিয়ে তো প্রশ্ন অনেক। এখানে বাস্তববাদী নীতির প্রতিফলন ঘটেনি। অর্থাৎ এখানে এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সব দল ও মতের অংশগ্রহণ এবং প্রতিফলন ঘটেনি। একটা বড় অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। যেখানে ৩৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীর যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন (২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনকে ভিত্তি ধরে) তাঁদের অংশগ্রহণ ছাড়া যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। নিঃসন্দেহে সংবিধান এ নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু সংবিধান সব সময় সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। কখনো-সখনো জাতির বৃহত্তম স্বার্থের খাতিরে সংবিধানের বাইরে গিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অনেক দেশ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০০৮ সালের কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে কিংবা অতিসম্প্রতি গ্রিস, বুলগেরিয়া কিংবা নেপাল এর বড় প্রমাণ। নেতৃত্বের সফলতা সেখানেই, যখন নেতৃত্ব জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে একটি সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা তা পারিনি। দোষারোপের রাজনীতির মধ্য দিয়ে কেটেছে গত বছর। সাধারণ মানুষ ছিল অসহায়। এ জন্য কাকে আমরা দায়ী করব? সরকারকে? সরকার তো সংবিধান অনুসরণ করেছে! কিংবা বিরোধী দলকে? তারা তো চেয়েছিল একটা সমঝোতা! আমাদের দুঃখ এখানেই- আমাদের রাজনীতিবিদরা বাস্তবতাকে অনুসরণ করতে পারলেন না। বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলেন। দুই. সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু সংবিধান যদি সত্যিকার অর্থে অনুসরণ করা যায়, তাহলে ১২৩(৪) ধারা অনুযায়ী এ নির্বাচন পেছানো সম্ভব! সংবিধানের এ ধারায় 'দৈব-দুর্বিপাকের' যে কথা বলা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা এ ক্রান্তিকালে উচ্চ আদালতই দিতে পারতেন। একমাত্র সরকারই উচ্চ আদালতের কাছে একটা রেফারেন্স চাইতে পারত। বিরোধী দল এ রেফারেন্স চাইতে পারে না। আমরা এ সুযোগটাও হারালাম। তিন. সহিংসতার যে চিত্র আমরা দেখেছি, তা যেকোনো বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য। এ সহিংসতা গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা এখন ঝুঁকির মুখে থাকল। ভবিষ্যতে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিতে আসার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তারা এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। চার. নিউ ইয়র্কের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে (৩০ ডিসেম্বর) ২০১৪ সালে অস্থিতিশীল দেশের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। তারা বলছে, 'বাংলাদেশ গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।' ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের মূল্যায়ন নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু যাঁরা বৈদেশিক নীতি নিয়ে কাজ করেন তাঁরা জানেন ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের গুরুত্ব কতটুকু। এরা মার্কিন নীতিনির্ধারণী একটি ফোরাম হিসেবে কাজ করে। তাদের বাংলাদেশের ব্যাপারে 'গৃহযুদ্ধের' মূল্যায়ন আমাদের সব অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম দিতে পারে। এ প্রতিবেদনটি, যা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গত ২ জানুয়ারি। ঠিক তার এক দিন পর বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) বার্ষিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। বিএমবিএস বলছে, ২০১৩ সালে দেশজুড়ে যে সহিংসতা হয়েছে, তাতে মারা গেছে ৫৭৩ জন, যার মধ্যে পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। আর আহতদের সংখ্যা ১০ হাজার ৪০৩। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে মানুষ মারা যাবে, এটা অকল্পনীয়। 'গৃহযুদ্ধের' ধারণা যারা দেয় তারা এ পরিসংখ্যানকে এখন ইস্যু করতে পারে। পাঁচ. এ নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ৫২ শতাংশ জনগোষ্ঠী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হলো। সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদের এটা পরিপন্থী, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, 'প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।' সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর (১৯৯১) মাধ্যমে এ শব্দগুলো সংবিধানে সনি্নবেশিত হয়। ছয়. আমাদের সবার মধ্যে একটা ধারণা রয়েছে যে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু 'বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়' এত বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর বিজয়(?) প্রমাণ করল, নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ। তাদের এ ব্যর্থতার প্রশ্নটিই তুলেছেন সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার। বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে সরকারের প্রভাবের বাইরে কাজ করতে পারে না, তা আরো একবার প্রমাণিত হলো। একাধিক ক্ষেত্রে ইসির ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। সরকারের চাপ উপেক্ষা করে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা কমিশনের সফলতা হিসেবেই বিবেচিত। কিন্তু 'সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি না জানিয়ে' ইসি বিতর্কিত হয়েছে। কমিশন ২৮ জুলাই নিজের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে প্রার্থিতা বাতিল সম্পর্কিত আরপিওর ৯১(ই) ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়; যদিও পরে প্রতিবাদের মুখে ইসি সরে আসে। মিথ্যা হলফনামা দিয়ে কেউ নির্বাচিত হলে তাঁর নির্বাচন বাতিল, নির্বাচনে কারচুপি হলে ফলাফল স্থগিত ও বাতিল করার ক্ষমতা ইসির নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না- এটা যদি ইসির কাছে প্রতীয়মান হয়, তাহলে ওই নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতাও ইসির নেই। আর্থিক ব্যাপারগুলোতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ অবমুক্ত করার দাবিরও কোনো সমাধান হয়নি। এর মধ্য দিয়ে সরকারের প্রভাব বিস্তার করার একটা সুযোগ থেকে যায়। সুতরাং ইসির বর্তমান কাঠামোয় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা যে সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হলো। সাত. দশম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকার সমর্থকরা বিগত পাঁচ বছরে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। 'সুজন' এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা একটি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, শীর্ষস্থানীয় সরকারি দলের নেতাদের অর্থ-সম্পদ কিভাবে বেড়েছে। সুস্থ রাজনীতি চর্চার জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। ক্ষমতায় গেলেই বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হতে হবে- এটা যদি 'স্টাবলিশ' হয়ে যায়, তাহলে রাজনীতি শুধু অর্থবানদেরই টানবে। অনেক অরাজনৈতিক ব্যক্তি, দুর্নীতিপরায়ণ আমলা শুধু অর্থ-সম্পদ বানানোর জন্য 'রাজনীতি'র খাতায় নাম লেখাবেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকারি দলের যাঁরা নির্বাচিত(?) হয়েছেন তাঁদের প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা করে পার্টি ফান্ডে জমা দিতে বলা হয়েছে। এটাও একটা বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং তাঁদের পরোক্ষভাবে দুর্নীতিতে উৎসাহিত করা হলো। আট. দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিদেশি দূতদের 'শেষবারের মতো' দৌড়ঝাঁপ করতে আমরা দেখেছি। এর আগে এক এক করে তারানকো, সুজাতা সিং, ওয়ার্সি কিংবা নিশার মতো বিদেশি দূতদের একটা 'সমঝোতা' করার উদ্যোগ নিতে আমরা দেখেছি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বিদেশি দূতদের 'হস্তক্ষেপের' ঘটনা বিদেশিদের কাছে প্রমাণ করল, আমরা আমাদের সমস্যা সমাধান করতে পারি না। এটা শুধু বাজে দৃষ্টান্তই নয়, বরং ভবিষ্যতে আবারও 'হস্তক্ষেপের' পথ প্রশস্ত করল। নয়. প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার কথা বলেছেন। শুনতে এটা ভালোই শোনায়। আমি নিজেও মনে করি, বাংলাদেশ হচ্ছে একটি 'সফট পাওয়ার', সক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশ একটি শক্তি। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি (১০৪৪ ডলার), জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমিয়ে আনা (১.৩ শতাংশ), শিশুমৃত্যু কমানো (হাজারে ৩৫ জন মাত্র), মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বৃদ্ধি, দারিদ্র্যসীমা কমানো (৩১.৫ শতাংশ), ব্যাপক নারীর অংশগ্রহণ, এমডিজিতে অনেকগুলোতে অগ্রগতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি, তা ঈর্ষণীয়। কিন্তু এটা ধরে রাখা সম্ভব হবে না, যদি না আমরা একটা 'সমঝোতায়' উপনীত হতে পারি। ইতিমধ্যে বলা হচ্ছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬.২ থেকে ৫.২ শতাংশে নেমে আসবে। প্রতিদিনের হরতালে বা অবরোধে ক্ষতি হচ্ছে দেড় হাজার কোটি টাকা। বিদেশি অনেক তৈরি পোশাকের ক্রেতা এখন অন্যত্র অর্ডার দিচ্ছে। সনাতন যারা আমাদের কাছ থেকে পোশাক কিনত তারা এখন অর্ডার দিচ্ছে ভারত, কম্পুচিয়া আর ভিয়েতনামে। আগামী দিনে বাংলাদেশের বিকল্প হতে যাচ্ছে মিয়ানমার। দশ. অভিযোগ উঠেছে, বিরোধীদলীয় নেতা এখন গৃহবন্দি(?); যদিও সরকার এটা অস্বীকার করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি গুলশানের বাসা থেকে বের হতে পারছেন না। এটা নিঃসন্দেহে একটা বাজে দৃষ্টান্ত। ভবিষ্যতের জন্য এটা খারাপ নজির। আমরা দশম সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মধ্যে প্রবেশ করলাম। যে দূরদর্শিতার প্রয়োজন ছিল, আমাদের নেতারা তা দেখাতে ব্যর্থ হলেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে নির্বাচন হলো বটে; কিন্তু তা সব প্রশ্নের জবাব দেবে না। সংগত কারণেই ২০১৪ সাল নিয়ে একটা শঙ্কা থেকেই গেল Daily Kalerkontho 06.01.14

0 comments:

Post a Comment