দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল, নির্বাচনের পরও সেই অনিশ্চয়তা কাটল না। নির্বাচনের পর দেশের প্রধান দুই নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার একটি প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। এ প্রতিক্রিয়া জট খোলার জন্য যথেষ্ট নয়। যখন প্রধানমন্ত্রী 'জিরো টলারেন্স'-এর কথা বলছেন, তখন বিরোধীদলীয় নেতা জানালেন আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ৫ জানুয়ারি একটি 'গ্রহণযোগ্য' নির্বাচন হয়নি। বিভিন্ন কারণে এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে যা ঘটল, তা আমাদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীকে বেশ উৎফুল্ল দেখা গেছে। তিনি এখন অনেক কনফিডেন্ট। তবে 'গণতন্ত্র বিজয়ী হয়েছে' বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে। কেননা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য নির্বাচনটা হয়েছে সত্য, কিন্তু আন্তর্জাতিক আসরে এটি কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ৭ জানুয়ারি কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও আমরা পেয়েছি; যা কি না প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করে না। যেমন, নতুন একটি নির্বাচনে বসার জন্য আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা ও কমনওয়েলথ। সেই সঙ্গে তাদের উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশিত হয়েছে। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক টাইম বলছে 'গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম।' আর ইকোনমিস্টের মন্তব্য 'নষ্ট নির্বাচন'। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাও মন্তব্য করেছে এটি ছিল একটি 'অদ্ভুত নির্বাচন'। প্রভাবশালী এ পত্রিকাটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এসব মন্তব্য বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এমনকি 'স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্বাচনে অংশ নেয়নি' বলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও হতাশা প্রকাশ করেছেন আ স ম আবদুর রব, কাদের সিদ্দিকী ও কর্নেল (অব.) অলির মতো মুক্তিযোদ্ধা। এরা কেউই নির্বাচনে অংশ নেননি। গণতন্ত্রে একটি নির্বাচিত সরকার যেমন থাকে, ঠিক তেমনি থাকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলও। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা অন্যতম একটি শর্ত। তাই আস্থা ও বিশ্বাস না থাকলে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যায় না। বাংলাদেশে আমরা গণতন্ত্র চেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস ও আস্থা নেই। আর নেই বলেই আমরা সবাই মিলে 'সব দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ'-এর একটি আবহ তৈরি করতে পারলাম না। এখন দশম সংসদ নির্বাচনকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এর মধ্যে ১২৭ জন আওয়ামী লীগের, ওয়ার্কার্স পার্টির ২ জন, জাসদের ৩ জন, জাতীয় পার্টির ২০ জন, জাতীয় পার্টি জেপির ১ জন। ১৪৭ আসনে যেখানে তথাকথিত নির্বাচন হয়েছে, সেখানে অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহীরা। ওইসব আসনে ভোটার ছিল ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। প্রার্থী ছিলেন ৩৯০ জন। মোট ১৮ হাজার ২০৮টি ভোট কেন্দ্রের সব কটিতে সুষ্ঠু ভোটও হয়নি। ভোটারের উপস্থিতির হার সম্পর্কে ইসির ব্যাখ্যা ৪০ ভাগ। তবে অনেকেই তা মানতে নারাজ। আওয়ামী লীগ এখন নতুন করে 'দ্বিতীয় আরেকটি মহাজোট সরকার' গঠন করবে, যাকে তারা বলছে 'জাতীয় ঐকমত্যের সরকার' এবং প্রয়োজনে ২৩৩টি আসন নিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিশ্চিত করে সংবিধানে আরো ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। এরই মধ্যে নবম সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল আওয়ামী লীগ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আবারো সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। সংসদীয় রাজনীতির একটা বড় সৌন্দর্য হলো সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা। কিন্তু দশম সংসদ নিয়ে এরই মধ্যে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এ সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে কোন দল? জাতীয় পার্টি। কিন্তু মুশকিল হলো জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশীদার। উপরন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জাতীয় পার্টির মন্ত্রী ও উপদেষ্টা আছেন একাধিক। ২৭টি আসনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী ছিল না। ফলে জাতীয় পার্টিকে কেন্দ্র করে গুজবের ডালপালা বাড়বেই। তবে জাতীয় পার্টি ও এর নেতা এইচ এম এরশাদ এরই মধ্যে বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। 'অসুস্থ' হয়ে গলফ খেলে তিনি 'চিকিৎসা' নিচ্ছেন সিএমএইচে। আর এ গলফ খেলাটা বাকি তার চিকিৎসার অংশ! আমাদের দুর্ভাগ্য ওবায়দুল কাদেরের মতো লোকের কাছ থেকেও এ ধরনের কথা শুনতে হয়। ওবায়দুল কাদেরের এ বক্তব্য যখন পত্রিকায় ছাপা হয়, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। বলতে দ্বিধা নেই, অতীতে ওবায়দুল কাদের তার বক্তব্য ও নেতৃত্বের গুণে নিজেকে একজন যোগ্য ও খাঁটি নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। যে কারণে দীর্ঘ দিন তিনি মন্ত্রিসভায় না থাকলেও, মহাজোট সরকারের শেষের দিকে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এখন তিনিই কি না বললেন এ কথা! যারা সংবাদপত্র নিয়মিত পাঠ করেন, তারা দেখেছেন এ নির্বাচনকে ঘিরে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বাজে ধারণার জন্ম হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এমনকি রাশিয়া কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বলেছিল বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রভাবশালী কলকাতার বাংলা সংবাদপত্র আনন্দবাজার বলেছিল 'খুব দ্রুত একাদশ নির্বাচনের প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছে ভারত'। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের তালিকায় বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে। যে ১০টি দেশকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও আছে। কী দুর্ভাগ্য, যেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষী পাঠাতে অনুরোধ করেন, সেই বাংলাদেশই কি না এখন ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত হলো! যে যুক্তি ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, তা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। অনেকেই জানেন প্রভাবশালী এ সাময়িকীটি মার্কিন নীতিনির্র্ধারণে প্রভাব খাটায়। নির্বাচন হয়ে গেল। কিন্তু 'সব দলের অংশগ্রহণ' তাতে থাকল না। আমাদের দুঃখ এখানেই যে আমাদের রাজনীতিবিদরা দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারলেন না। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। আস্থার সম্পর্কটা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। পশ্চিম বিশ্বের যে উৎকণ্ঠা, সে উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। কেননা বিএনপি বড় দল। দলটিকে আস্থায় না নিলে তা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে না। নির্বাচনে বিরোধী দল আসেনি। এর জন্য কে দায়ী, কে দায়ী নয় সে হিসাব নিয়ে আমরা যদি 'ব্যস্ত' থাকি, তাহলে আমাদের এত দিনের অর্জন আরো বাধাগ্রস্ত হবে। এরই মধ্যে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ আরো 'ক্ষতি' সহ্য করতে পারবে না। মনে রাখতে হবে অর্থনীতির চাকা যদি না চলে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতা না হলে, এ অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা থেকেই যাবে। আর তা অর্থনীতিকে আঘাত করবে, যা আমাদের কারোর জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। রাজনীতিবিদদের কাছে তাই আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে সেই প্রত্যাশা তারা পূরণ করতে পারবেন না। প্রশাসনকে ব্যবহার করে সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা যায় বটে, কিন্তু মানুষের মনে স্থান করে নেয়া যায় না। নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী 'বিজয়ী' হয়েছেন। কিন্তু একে 'গণতন্ত্রের বিজয়' বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী আরো উদার মনের পরিচয় দিতে পারেন, যদি তিনি তার দলের সাধারণ সম্পাদককে ভেঙে যাওয়া সংলাপ পুনরায় শুরু করার নির্দেশ দেন। ইতিহাসে তিনি স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন, যদি তিনি এ কাজটি করেন। জাতি এখনো সঙ্কটের মধ্যে আছে। হরতাল-অবরোধের কারণে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক, এটা বলা যাবে না। তাই প্রধানমন্ত্রী যে কাজ করতে পারেন, তা হলো : ১. খালেদা জিয়াকে তার 'গৃহবন্দি'র অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়া। খালেদা জিয়া তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করবেন। তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকা- শুরু করলে, আমার বিশ্বাস সংলাপের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ২. বিএনপির নেতাকর্মীরা যাতে জামিনে মুক্তি পান, সে ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া। এতে বিশ্ববাসী দেখবে তিনি সত্যিকার অর্থেই সমঝোতার ব্যাপারে আগ্রহী। ৩. সরকার যদি সত্যিকারভাবেই মনে করে জামায়াত জঙ্গিবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অভিমত, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের (গ) ও (ঘ) উপ অনুচ্ছেদ, রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭২ ও দ্য পলিটিকাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮-এর বিধিবিধান অনুসরণ করে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যায়। সে ক্ষেত্রে জামায়াতকে ছাড়াই বিএনপি সংলাপে অংশ নিতে পারবে। সরকার হার্ডলাইনে গেছে। শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৭ জানুয়ারি। এতে একটা ভুল মেসেজ পেঁৗছে যেতে পারে বিএনপির কাছে। নির্বাচনের সময় ও পরবর্তী সময়ে যশোর, গাইবান্ধা, পঞ্চগড় ও বাঁশখালীতে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছেন। ভোটবিরোধীরা ৫৩১টি স্কুলে আগুন দিয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত করা কিংবা স্কুলগুলো পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা কোনো সভ্য দেশে চিন্তাও করা যায় না। একজন স্কুলশিক্ষক নিজে স্কুলে আগুন লাগানোর সময় গ্রেফতার হয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা সভ্যতার ওপর একটি আঘাত। এসব ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর হওয়া উচিত। একটি নতুন সরকার গঠিত হবে, রোববার শপথ নেয়ার কথা। সাংবিধানিকভাবে এ সরকারের পাঁচ বছর থাকার কথা। কিন্তু সময়টা অনেক লম্বা। একটা সমঝোতার উদ্যোগ নতুন সরকারকে নিতে হবে। এটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। Daily JAI JAI DIN 10.01.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment