রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিএনপির রাজনীতি এখন কোন পথে : তারেক শামসুর রেহমান

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন 'প্রতিহত' ঘোষণার 'ব্যর্থতা' এবং দীর্ঘ প্রায় এক মাসজুড়ে চলা হরতাল-অবরোধের পর যে প্রশ্নটি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে বিএনপি এখন কী করবে? কোন পথে এখন বিএনপি? দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও, বাস্তবতা হচ্ছে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিএনপি ওই সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। যেখানে ৩৫ থেকে ৪০টি কেন্দ্রে কোনো ভোট পড়েনি, যেখানে ৫২ ভাগ জনগোষ্ঠী আদৌ তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি, সেখানে 'নির্বাচন'-এর নামে একটি নির্বাচন হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় 'বিজয়ী হয়েছে গণতন্ত্র'। ওই নির্বাচন নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন থাকলেও, বাস্তবতা হচ্ছে আগামী ২৯ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসতে যাচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর এই প্রথম বিএনপিকে ছাড়াই সংসদ অধিবেশন বসছে। যদিও এর আগে ১৯৮৬ সালে ও ১৯৮৮ সালেও (তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ) বিএনপি সংসদে ছিল না। তবে ওই সংসদ টিকে ছিল ১৭ মাস ও ৩১ মাস। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন। নবনিযুক্ত মন্ত্রীরা বলছেন, এই সংসদ থাকবে ৫ বছর। সংবিধানে এই ৫ বছরের কথাই বলা আছে। যেখানে সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণের কথা, সেখানে বিএনপি তথা ১৮ দলের অংশগ্রহণ না থাকায়, এ সংসদ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে বিএনপির ভবিষ্যৎ এখন কী? গেল বুধবার খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে নয়া কর্মসূচি দিয়েছেন। তার বক্তব্যে অনেক দিক আছে। প্রথমত, তিনি কোনো অবরোধ আর হরতালের কর্মসূচি দেননি। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার। তিনি বোধ করি উপলব্ধি করেছেন যে হরতাল আর অবরোধে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। আর এই সহিংসতায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বেশি। সহিংসতায় সাধারণ মানুষের যেমনি সমর্থন থাকে না, ঠিক তেমনি বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও তা সমর্থন করে না। বিএনপি ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছিল, তাতে কূটনীতিকরা সবাই এই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, বিএনপি ২০ জানুয়ারি ঢাকায় একটি গণসমাবেশ করেছে। সরকারের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করার জন্য এ ধরনের সমাবেশ বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত। তৃতীয়ত, বিএনপি ২৯ জানুয়ারি কালো পতাকা প্রদর্শনের ডাক দিয়েছে। সবার জানা ওই দিন দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে। চতুর্থত, খালেদা জিয়া আবার প্রতিটি বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ করার কথা বলেছেন। এটাও ভালো দিক। এতে কর্মীদের ধরে রাখা ও উজ্জীবিত করা সহজ হবে। পঞ্চমত, খালেদা জিয়া সংলাপের কথা বলেছেন। এই অ্যাপ্রোচটাও ভালো। মূলত একটি সমঝোতা ও সংলাপের কথা সবাই বলছেন। দাতাদের কাছ থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তাতে এ সংলাপের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। খালেদা জিয়ার এ আহ্বান নিঃসন্দেহে এখন একটি সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। পারস্পরিক বিশ্বাস আর আস্থা না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আপাতত সহিংসতানির্ভর রাজনীতির অবসান ঘটল। কিছুদিন পরেই ভাষার মাস। সুতরাং ভাষার মাসে বিএনপি কোনো বড় কর্মসূচি দেবে না, এটাই প্রত্যাশিত। একই সঙ্গে মার্চ হচ্ছে স্বাধীনতার মাস। এ মাসেও বিএনপি হরতাল আর অবরোধের মতো কর্মসূচি দেবে না, এটাও ধারণা করা যায়। কিন্তু তাতে করে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো অবসান হবে কি? আমার মনে হয় না। সরকার যদি কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে সমস্যা যা ছিল, তা থেকে যাবে। খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পর 'রাজনীতির বল'টা এখন স্পষ্টতই সরকারের কোর্টে। সরকার যদি সংলাপের ব্যাপারে আন্তরিক না হয়, তাহলে সমস্যা যেভাবে ছিল, সেভাবেই থেকে যাবে। বরং তাতে জটিলতা আরো বাড়বে। খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে বলেছেন, জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল। এর সঙ্গে অনেকেই ঐক্য করেছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন তিনি হয়তো এ ব্যাপারে একটি ঘোষণা দেবেন। কৌশলগত কারণে সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন। এর আগে তো তিনি একটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমকে স্পষ্ট করেছেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ঐক্য স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। আমরা যারা রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করি, আমরা সবাই জানি রাজনীতি বিষয়ে সেই বিখ্যাত উক্তিটি 'রাজনীতিতে স্থায়ী কোনো বন্ধু নেই, স্থায়ী কোনো শত্রু নেই।' এটা তো সত্যি, এই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। ১৯৮৬ সালে দেশে যখন তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল (এরশাদীয় জমানায়), তখন বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। সুতরাং রাজনীতিতে 'স্থায়ী শত্রু, স্থায়ী মিত্র'র ধারণা থেকে বিএনপি-জামায়াত ঐক্য টিকে আছে। আগামীকে এই ঐক্য নাও টিকে থাকতে পারে! তাই বোধ করি খালেদা জিয়া বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তিনি এবার ধীর গতিতে এগুচ্ছেন। নির্বাচনটা হয়ে গেছে। মন্ত্রিসভাও হয়ে গেছে। এটাই বাস্তবতা। এ মন্ত্রিসভা নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক, নির্বাচন নিয়ে যত বিরূপ মন্তব্যই আসুক না কেন, সরকার এটাকে আদৌ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। তাই বিএনপি তথা ১৮ দলের কাছে বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ১৮ দল এখন হরতাল নয়, বরং মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিকে সামনে রেখেই তাদের স্ট্রাটেজি ঠিক করছে। এ কারণেই দেখা যায় বিএনপি কোনো কঠোর কর্মসূচি দেয়নি। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আর আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার পুরো বিষয়টাই এখন নির্ভর করছে সরকারের ওপর। সরকার কি আদৌ বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাবে? আর যদি সমঝোতায় যায়ও, তাহলে এর ধরন কী হবে? বিএনপির তো দাবি ছিল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সরকার সেটা মানেনি। এবং আগামীতে যে মানবে, তাও নয়। কিছুটা নমনীয় হয়ে বিএনপির দাবি ছিল নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারথ তাও হয়নি। বিএনপির আরো একটি দাবি ছিলথ শেখ হাসিনাকে বাইরে রেখে যে কোনো অন্তর্র্বতীকালীন সরকারে তারা নির্বাচনে যেতে রাজি। তাও হয়নি। তাহলে বিএনপি কোন দাবিকে মুখ্য করে এখন আন্দোলনে যাবে? মধ্যবর্তী নির্বাচন? কিন্তু তাও খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। ভোটকেন্দ্রে কেউ আসুক, না আসুক, নির্বাচন হয়েছে। 'সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন' হয়নি। যারা রাজনীতিতে 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' নিয়ে কাজ করেন, তারা এখন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে একটি 'ষড়যন্ত্র আবিষ্কার' করে ফেলতে পারেন! বলতে দ্বিধা নেই। একটি নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশিত নির্বাচন এটি হলো না। আমাদের দুর্ভাগ্য এ জাতি আবারো একটি নির্বাচন দেখল, যেখানে প্রধান একটি দলের আদৌ কোনো অংশগ্রহণ নেই। ইতোমধ্যে দশম সংসদের ২৯৬ জন সদস্য শপথ নিয়েছেন। নয়া মন্ত্রিসভা গঠিত হলো ১২ জানুয়ারি রোববার। এর মধ্য দিয়ে দশম সংসদ তার যাত্রা শুরু করল। তবে এ সংসদ নিয়ে 'কিছু' এবং 'কিন্তু' আছে। এ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একটি বড় ধরনের সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। সংবিধানের ৬৫(২) ধারায় বলা আছে, 'একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত ৩০০ সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে।' এর অর্থ যারা শপথ নিয়েছেন, তারা সংবিধান মোতাবেক বৈধ কিন্তু নবম জাতীয় সংসদ এখনো বহাল আছে। আরো মজার ব্যাপার এর মধ্য দিয়ে ১২২ আসনে এখনো দুজন করে এমপি! এটা তো স্পষ্টতই সংবিধানে ৬৫(২) ধারার বরখেলাপ। আমি জানিনা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা তাকে বিষয়টির কীভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আরো একটা মজার কাহিনী আমাকে শুনিয়ে ছিলেন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, যিনি নয়া মন্ত্রিসভায়ও আছেন। তিনি জাতীয় পার্টির নেতা। বৃহস্পতিবার তিনি আমার সঙ্গে এটিএন নিউজের টকশোয় আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন। তিনি বললেন, জাতীয় পার্টি সরকারেও থাকবে, আবার বিরোধী দলেও থাকবে। কী অদ্ভুত কথা! গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের কথা কেউ কখনো শোনেনি। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা আমাদের এ ধরনের কথা শোনাচ্ছেন! রাজনীতির ছাত্র হিসেবে আমি কোথাও পাইনি যে দল একই সঙ্গে সরকারে থাকবে, আবার বিরোধী দলেও থাকবে। আমরা গণতন্ত্রের এ কোন রূপ বাংলাদেশে দেখছি! এরশাদ সাহেব আরো বিতর্কিত করলেন নিজেকে। তার অনেকদিনের স্বপ্ন সরকারের 'বিশেষ দূত' তিনি হবেন। এবার হলেন। কিন্তু 'অসুস্থ' হয়ে, গল্ফ খেলে, নিজেকে 'থু থু এরশাদ' হিসেবে পরিচিত করে তিনি কী পেলেন, জানিনা। কিন্তু দেশে রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে একটা বাজে ধারণার জন্ম দিলেন। জনগণের ওপর 'চাপিয়ে' দেয়া এই যে রাজনীতি, এই রাজনীতি আর যাই হোক জনগণের মঙ্গলের জন্য যে রাজনীতি, তা নয়। আরো একটি খবরথ নতুন নির্বাচন চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। রিটটি করেছেন নবম সংসদের বিএনপির সংসদীয় দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। এ রিটের ভবিষ্যৎ কী আমরা জানি না। কিন্তু রাজনীতির বিষয়টিকে আমরা আবারো আদালতে নিয়ে গেলাম। এই প্রবণতা ভালো নয়। মঙ্গলও নয়। রাজনীতির বিষয়টি রাজনৈতিকভাবেই সমাধান হওয়া উচিত। তাই তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দেবেন আমি জানিনা। কিন্তু আমি বুঝি দেশে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার জন্য বিএনপির সঙ্গে 'সমঝোতা' ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি তার 'অবরোধ আর হরতালের' কর্মসূচি চূড়ান্তভাবে পরিত্যাগ করেছে, এটা মনে হয় না। যদিও রাজধানীতে অবরোধ আর তেমনভাবে কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না আগের মতো। কিন্তু 'সংসদের বাইরে' থাকা বিএনপির এ কর্মসূচি ছাড়া বিকল্প কিছু আছে কি? 'নির্বাচন' হয়েছে। সেখানে যত কম ভোটই পড়ুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে এই নির্বাচন বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার 'মৃত্যু' ঘটাল। সরকার এ নির্বাচন দিয়ে তার 'লেজিটেমেসি' বাড়িয়েছে। সুতরাং আগামী দিনগুলো নিয়ে একটা শঙ্কা থেকেই গেল। আমার বিবেচনায় বিএনপি এখন সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে। হরতাল আর অবরোধ না দিয়ে বহির্বিশ্বে তার ইমেজ বাড়াতে চাইছে বিএনপি। সরকারের উচিত হবে তাই বিএনপির সঙ্গে একটা 'সংলাপ' শুরু করা। এ কাজটি করতে আমাদের যত দেরি হবে, রাজনীতিতে অস্থিরতা তত বাড়বে।

0 comments:

Post a Comment