রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইতিহাসে কীভাবে চিহ্নিত হবে?

গত বৃহস্পতিবার দশম সংসদের ২৮৩ সদস্য শপথ নিয়েছেন। আর শনিবার নিলেন এরশাদ। পুরো মন্ত্রিসভা গঠিত হলো রোববার। এর মধ্য দিয়ে দশম সংসদ তার যাত্রা শুরু করল। তবে এই সংসদ নিয়ে ‘কিছু’ এবং ‘কিন্তু’ আছে। বৃহস্পতিবারের ওই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একটি বড় ধরনের সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। সংবিধানের ৬৫ (২) ধারায় বলা আছে ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে।’ এর অর্থ যারা শপথ নিয়েছেন তারা সংবিধান মোতাবেক বৈধ কিন্তু নবম জাতীয় সংসদ এখনো বহাল আছে। আরো মজার ব্যাপার ১২২ আসনে এখন দুজন করে এমপি! এটা তো স্পষ্টতই সংবিধানের ৬৫(২) ধারার বরখেলাপ। আমি জানি না প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা তাকে বিষয়টির কীভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আরো একটা মজার কাহিনী আমাকে শুনিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ যিনি নয়া মন্ত্রিসভায়ও আছেন। তিনি জাতীয় পার্টির নেতা। বৃহস্পতিবার তিনি আমার সঙ্গে এটিএন নিউজের টকশোতে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। তিনি বললেন, জাতীয় পার্টি সরকারেও থাকবে, আবার বিরোধী দলেও থাকবে। কী অদ্ভুত কথা! গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের কথা কেউ কখনো শোনেনি। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা আমাদের এ ধরনের কথা শোনাচ্ছেন! রাজনীতির ছাত্র হিসেবে আমি কোথাও পাইনি যে, দল একইসঙ্গে সরকারের থাকবে, আবার বিরোধী দলেও থাকবে। আমরা গণতন্ত্রের এ কোন রূপ বাংলাদেশে দেখছি?
বৃহস্পতিবার এমপিদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি সম্পর্কে যে ‘গুজব’ এতদিন ভাসছিল তা বাস্তবে রূপ পেল। শপথ গ্রহণের আগেরদিন রওশন এরশাদ ‘জীবনের প্রথমবারের মতো’ সংবাদ সম্মেলনে করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তিনিই হতে যাচ্ছেন সংসদ বিরোধী দল নেতা। এরশাদ নন কেন? জবাবটা সোজাসাপ্টা। যেহেতু এরশাদ রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তাই তার পক্ষে বিরোধীদলীয় প্রধান হওয়া শোভা পায় না। অথচ তিনি কিনা বিশেষ দূত হলেন এখন। কি দুর্ভাগ্য এ জাতির! সংবাদ সম্মেলনে একটা কথা বললেই হলো। এর পেছনে সত্যতা আছে কী নেই, এর বাছবিচার অনেকেই করেন না। পৃথিবীর অনেক দেশের দৃষ্টান্ত দেখা যাবে, যেখানে সরকারপ্রধানরা ক্ষমতা হারানোর পর বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা পালন করেছেন। বেগম রওশন এরশাদের সংবাদ সম্মেলনে তার ডান পাশে বসা ছিলেন পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার। হাওলাদার সাহেব এতদিন বারবার বলে আসছেন তিনি প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করার জন্য আবেদন করেছেন, তার দল নির্বাচন বয়কট করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই হাওলাদার সাহেব কিনা শপথ নিলেন! তারাই আমাদের জাতীয় নেতা! তারাই মন্ত্রী হন! জনগণের সেবক! বিভ্রান্তিকর কথার্বাতা আর সুবিধাবাদিতার রাজনীতি পুরো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। বিএনপির বিকল্প হিসেবে জাতীয় পার্টির একটা সম্ভাবনা ছিল। এখন জাতীয় পার্টির এই ভূমিকা বিশেষ করে এইচএম এরশাদের দ্বৈত ভূমিকা জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে তার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলবে। একসময় ১৯৮৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেব দেশে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবর্তমানে (নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কারণে) সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছিলেন আ স ম আবদুর রব। কিন্তু মানুষ রব সাহেবকে সেদিন কীভাবে সম্বোধন করেছিল, তা নিশ্চয়ই আমাদের অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা! এরশাদ সাহেবও নিশ্চয়ই তা ভুলে যাননি। গত শনিবার ‘অনেক নাটকের পর’ তিনি শপথ নিলেন। গণমাধ্যম জানাচ্ছে, শপথ অনুষ্ঠানে তিনি হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। আগে যেভাবে অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বারবার বলে আসছিলেন তার দল নির্বাচনে যাবে না, তিনি তার প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন কী হলো? ‘অসুস্থ’ হয়ে তিনি আবার চলে গেলেন সিএমএইচএ তারপর বাড়িতে। এরশাদের এই ভূমিকাকে আমরা কী বলব? নাটক? তিনি সেনাবাহিনীপ্রধান ছিলেন। রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ৯ বছর দেশ চালিয়েছেন। একবারও কী মনে হলো না তার এই ‘অভিনয়’ মানুষ বোঝেন! আমরা অসাংবিধানিক শক্তিকে চাই না। সাংবিধানিক শক্তিকেই চাই। কিন্তু এই সাংবিধানিক শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিরা যখন বিভ্রান্তিকর কথা বলেন, তখন আস্থার জায়গা আর থাকে না। আমরা তো  রাজনীতিবিদদের কাছেই বারবার ফিরে যেতে চাই। তারাই দেশ চালাবেন। দেশকে নেতৃত্ব দেবেন। তিনি ‘অসুস্থ’ হলেন। ‘অসুস্থ’ হয়ে গলফ খেললেন। আবার শপথ নিতেও ভুললেন না। তরুণ প্রজন্ম এসব রাজনীতিবিদের কাছ থেকে কী শিখবে? তরুণ প্রজন্ম যারা রাজনীতি করতে আগ্রহী তারা কী এসব ঘটনায় অনুপ্রাণিত হবে  আদৌ? একজন ‘অসুস্থ এরশাদ’ এখন মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত!
‘নির্বাচন’ হয়ে গেছে। এই ‘নির্বাচন’ নিয়ে যত প্রশ্নই উঠুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে দশম জাতীয় সংসদের ২৯২ জন সদস্য শপথ নিয়েছেন। সংবিধান মোতাবেক তারা এখন সংসদ সদস্য তবে সরকারি ভাষ্যমতে, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন ২৪ তারিখের পর। নবম সংসদ বিলুপ্ত হলো না। নিয়মমাফিক ২৪ তারিখ ওই সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং দশম সংসদ তার কার্যক্রম শুরু হবে। এই নির্বাচন এবং শপথ গ্রহণ নিয়ে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে। সংবিধানের ১৪৮ ২(ক) অনুযায়ী সরকারি গেজেট প্রকাশের ৩ দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণের যে কথা বলা হয়েছে, সেটা অনুসরণ করে সংসদ সদস্যরা (দশম সংসদ) শপথ নিয়েছেন। এটা সংবিধান অনুযায়ী করা হয়েছে কিন্তু ১৪৮(১) যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে দেখব এই ধারাবলে যে শপথ গ্রহণ হলো তা ৬৫(২) ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৪৮(১) ধারাটা এ রকম তৃতীয় তফসিলে উল্লেখিত যে কোন পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি কার্যগ্রহণের পূর্বে উক্ত তফসিল অনুযায়ী শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করিবেন। এর অর্থ কী? এমপি সাহেবরা শপথ নিয়েছেন কার্যগ্রহণের পূর্বে। অর্থাৎ ৯ তারিখ থেকেই তিনি সংসদ সদস্য! কিন্তু ১২২টি আসনে যেখানে অন্য এমপি রয়েছেন তাদের কী হবে? সংবিধানের কোথাও কিন্তু বলা হয়নি নয়া এমপি দায়িত্বগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো এমপি আর তার দায়িত্বে থাকবেন না। এখানে এক ধরনের জটিলতা রয়েছে। দেশের আইনজীবীরাও এ ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্ত। এ দেশে যিনি আজীবন কোম্পানি আইন পড়েছেন, কোম্পানি আইনে মামলা-মোকাদ্দমা করেন, তিনি হয়ে যান সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তারা তাদের মতো করে সংবিধানের ব্যাখ্যা দেন। এখন শপথ গ্রহণের বিষয়টি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, সে ব্যাপারে যে কেউ উচ্চ আদালতের কাছে একটা রেফারেন্স চাইতে পারেন। এমনকি সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কিংবা ড. কামাল হোসেন যারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত তারা স্ব-উদ্যোগে একটা রিট করতে পারবেন। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা ভালো। এমনকি সরকার নিজেও সব বিতর্ক এড়াতে উচ্চ আদালতের কাছে মতামত চাইতে পারত। আরো জটিলতা আছে। রোববার মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। দশম সংসদে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী নেয়া হয়েছে। এটাই নিয়ম। কিন্তু এই শপথ যদি ২৪ জানুয়ারির পরে অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠতে পারে। এখানে ‘সংসদ সদস্যদের’ ব্যাপারটি নিয়ে একটা গোলমাল লেগে যেতে পারে। একটা মন্ত্রিসভা হলো যখন নবম জাতীয় সংসদ বহাল। আর মন্ত্রিসভা হলো দশম জাতীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে। তাহলে কেউ তো প্রশ্ন করতেই পারেন এটা সংবিধানের বরখেলাপ নয় কি? এই মন্ত্রিসভা ২৪ তারিখের পরে গঠিত হলে ভালো হতো। শোভন হতো। কোনো জটিলতা থাকত না। কোনো প্রশ্নও থাকত না। নিশ্চই সরকারপ্রধান তথা সরকারের উপদেষ্টারা সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সংবিধানের প্রসঙ্গটি বাদই দিলাম। নির্বাচনের পর কোনো দেশ থেকে অভিনন্দন বার্তা এসেছে কি? এমনকি ভারতের কাছ থেকে যে বার্তা এসেছে, সেখানে সেই অর্থে অভিনন্দন সূচক কোনো বক্তব্য ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ খবর এসেছে। গত ৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের ১১৩তম কংগ্রেসে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৫ জন সিনেটর রিচার্ড ডারবিন, জন বুজম্যান, বারবারা বস্কার, মাইকেল বি, এজি ও সিনেটর ক্রিস্টোফার এস মার্ফি গত ১১ ডিসেম্বর এই প্রস্তবাটি পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিতে পাঠান। এটি নিয়েই আলোচনা হয়। সিনেটর গৃহীত প্রস্তাবে ৬টি বিষয় রয়েছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে-নিরপেক্ষ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সত্যিকার অর্থে সংলাপ, অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ, নির্বাচক পর্যবেক্ষদের নিরাপত্তা প্রদান, তারানকোর উদ্যোগের প্রতি সমর্থন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ‘স্বাধীনতা’ ফিরিয়ে দেয়া ইত্যাদি। একই সঙ্গে সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান রবার্ট মেনডেজ দু’নেত্রীকে (প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী) যে চিঠি দিয়েছেন তাতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানো, সহিংসতা বন্ধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে। সিনেটর মেনডেজের চিঠিটি ছাপা হয়েছে গত শনিবার। সিনেটের প্রস্তাব ও সিনেটর মেনডেজের চিঠির মধ্যে দিয়ে যে মেসেজ আমরা পাচ্ছি, তা হচ্ছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর একটা পথ হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে ‘সংলাপ’ শুরু করা। এদিকে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুটি বড় দলের মাঝে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে আংশিক ব্রিটিশ সহযোগিতা হারাতে পারে বাংলাদেশ।
এমনি এক পরিস্থিতিতে একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে গত রোববার। সংবিধানের ৫৬ (১) ধারায় বলা হয়েছে ‘একজন প্রধানমন্ত্রী থাকিবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেই রূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকিবেন।’ একই সঙ্গে (২) ধারায় বলা হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে তাহাদের সংখ্যার কমপক্ষে নয় দশমাংশ সংসদ সদস্যদের মধ্য হইতে নিযুক্ত হইবেন...।’ সমস্যাটা হয়েছে এখানেই। যেখানে ‘সংসদ সদস্যদের’ মধ্য থেকে কথাটা বলা হয়েছে, সেখানে দুই সংসদের (নবম ও দশম) অস্তিত্ব বজায় থাকায় সেখানে দশম সংসদ থেকে মন্ত্রী নেয়ায় একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। এই মন্ত্রিসভার বৈধতা নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। একইসঙ্গে মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি মন্ত্রিসভাকে বড় ধরনের বিতর্কের মাঝে ফেলে দিয়েছে। যতদূর জানা যায়, ২০০৬ সালে হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত একটি পর্যবেক্ষণ ছিল। তাতে বলা হয়েছিল একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকা অনৈতিক, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সংবিধানবহির্ভূত। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গত শনিবার হাইকোর্টের ওই পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে ঐকমত্যের সরকারের বিরোধিতা করেছেন। এখানে ঐকমত্যের ধারণার ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু ঐকমত্যের ব্যাপারে যাদের পেলাম, তারা সবাই মূলত আগের মহাজোট সরকারেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাতে ‘ঐকমত্য সরকার’ হলো কোথায়? অনেকেই এটা স্বীকার করবেন যে, বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে একটা ঐকমত্যের সরকারের প্রয়োজন ছিল। এটা ভালো হতো যদি সব দল ও মতের প্রতিনিধিত্ব এই মন্ত্রিসভায় থাকত। এমনকি প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকেও এই মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন। কেননা পরিস্থিতি এটাই দাবি করে। তবে সংবিধান যেহেতু ‘সাংসদ নন’ এমন কাউকে নিয়ে মন্ত্রী করার বিধান সীমিত, এক্ষেত্রে টেকনোক্র্যাট কোটায় কিংবা উপদেষ্টা পরিষদে তাদের রাখা যেত। মন্ত্রিসভায় সব মতের প্রতিনিধিত্ব থাকলে, সংকট সমাধানের পথে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেটা হলো না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা দরকার। গেজেটে রওশন এরশাদকে বিরোধী দল নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তাকে সেই মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার দল যখন মন্ত্রিসভায় থাকে, তখন তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপর ছুরিকাঘাতের শামিল। বেশকিছু ধরেই জাতীয় পার্টির মাঝে একটা ধারা লক্ষ্য করা গেছে আর তা হচ্ছে মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ! এখন বেগম রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা বানিয়ে তারা নিজেরা মন্ত্রী হলেন। আমি এর আগেও বলেছি এরশাদের অবর্তমানের জাতীয় পার্টির একটা অংশ আওয়ামী লীগের মাঝে বিলীন হয়ে যাবে, অপর অংশ চলে যাবে বিএনপিতে। এরশাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও তার সুবিধাবাদী রাজনীতির কারণে তৃতীয় দল হিসেবে জাতীয় পার্টির বিকশিত হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল সেই সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে। অতীতেও একাধিকবার জাতীয় পার্টি ভেঙেছে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান মঞ্জু কিংবা সর্বশেষ কাজী জাফর মূল দল ত্যাগ করে আলাদাভাবে সংগঠিত হয়েছেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু কিংবা নাজিউর রহমান মঞ্জুর ‘এক দল এক নেতা’ হিসেবে বিবৃতির মাধ্যমে তাদের অস্থিত্ব বজায় রাখলেও লাভবান হয়েছেন এক জায়গায়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আবারো মন্ত্রী হয়েছেন। আর নাজিউর রহমান মঞ্জুর অর্বতমানে তার ছেলেরা দলটিকে ‘ভোলাকেন্দ্রিক’ একটি দলে পরিণত করেছেন। আগামীতে বিএনপি যদি সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে পার্থ কিংবা কাজী জাফর আবারো মন্ত্রী হতে পারেন। বিতর্কিত নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা ৪৮ সদস্যবিশিষ্ট যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন তাতে তেমন কোনো চমক নেই। তবে এটা ঠিক বেশকিছু বিতর্কিত ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ‘সাবেক মন্ত্রীদের’ নয়া মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেননি। অযোগ্য, অতি কথার প্রিয় ব্যক্তিরাও ঠাঁই পাননি। এতে তিনি প্রশংসা পেতেই পারেন। আবার যখন দেখি বিতর্কিত নির্বাচনে এবারে ‘বিজয়ী’ হয়েই সরাসরি শপথ নিয়েছেন, তখন আস্থার জায়গাটা ফিকে হয়ে আসে। আসলে কোন নীতিমালার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এই মন্ত্রিসভা জাতির আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। যারা অতি কথা বলেন এবং বিরোধী দলের সঙ্গে যে কোনো সমঝোতায় যেতে প্রধান অন্তরায়, তারাও রয়ে গেছেন মন্ত্রিসভায়। এতে কি ঐকমত্যের সরকার হবে?
গতকালের আরো একটি খবর নতুন নির্বাচন চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছে। এই রিটটি করেছেন নবম সংসদের বিএনপির সংসদীয় দলের চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুক। এই রিটের ভবিষ্যৎ কী আমরা জানি না। কিন্তু রাজনীতির বিষয়টিকে আমরা আবারো আদালতে নিয়ে গেলাম। এ প্রবণতা ভালো নয়। রাজনীতির বিষয়টি রাজনৈতিকভাবেই সমাধান হওয়া উচিত। তাই তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দেবেন, জানি না। কিন্তু এটা সত্য যে দেশে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার জন্য বিএনপির সঙ্গে ‘সমাঝোতা’ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ‘অবরোধ আর হরতালের’ কর্মসূচি পরিত্যাগ করেছে, এটা মনে হয় না। যদিও রাজধানীতে অবরোধ আর তেমনভাবে কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না আগের মতো। কিন্তু ‘সংসদের বাইরে’ থাকা, বিএনপির এই কর্মসূচি ছাড়া বিকল্প কিছু আছে কি? ‘নির্বাচন’ হয়েছে। সেখানে যত কম ভোটই পড়–ক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে এই নির্বাচন বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার ‘মৃত্যু’ ঘটাল। সরকার এই নির্বাচন দিয়ে তার ‘লেজিটেমেসি’ বাড়িয়েছে। সুতরাং আগামী দিনগুলো নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। 
Daily Manobkontho 16.01.14

0 comments:

Post a Comment