রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মন্ত্রিসভা নিয়ে নানা প্রশ্ন

শেষ পর্যন্ত নয়া মন্ত্রিসভা রবিবার শপথ নিল। বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই এই মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। আর এই মন্ত্রিসভা গঠিত হলো এমন একসময়, যখন নবম জাতীয় সংসদ এখনো বহাল আছে। সংবিধান অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নবম জাতীয় সংসদের আয়ুষ্কাল। নবম জাতীয় সংসদকে বহাল রেখে দশম জাতীয় সংসদের সদস্যদের শপথ ও মন্ত্রিসভা গঠন একটি সাংবিধানিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, সংবিধানের ৫৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'একজন প্রধানমন্ত্রী থাকিবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী থাকিবেন'। এ ধারা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু প্রশ্ন আছে ৫৬(২) ধারা নিয়ে। এখানে বলা হয়েছে, 'প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে তাহাদের সংখ্যার অনূন্য নয়-দশমাংশ সংসদ সদস্যের মধ্য হইতে নিযুক্ত হইবেন...'। সমস্যাটা হয়েছে এখানেই। যেখানে 'সংসদ সদস্যের' মধ্যে থেকে কথাটা বলা হয়েছে, সেখানে দুই সংসদের (নবম ও দশম) অস্তিত্ব বজায় থাকায় দশম সংসদ থেকে মন্ত্রী নেওয়ায় একটি জটিলতা তৈরি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির সদস্যদের অন্তর্ভুক্তিতে একটি রাজনৈতিক ও একই সঙ্গে সাংবিধানিক বিতর্কও সৃষ্টি হতে পারে। এরশাদ মন্ত্রী পদমর্যাদায় বিশেষ দূত হয়েছেন, যা তিনি দাবি করে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। এর বাইরে জাতীয় পার্টি একজন পূর্ণ মন্ত্রী ও দুজন প্রতিমন্ত্রী পেয়েছে। অথচ বেগম রওশন এরশাদ এখন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। সেভাবেই গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের 'সুবিধাতন্ত্র', 'গোষ্ঠীতন্ত্র' চালু হলো। সংসদীয় গণতন্ত্রে যেখানে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকে, সেখানে জাতীয় পার্টির এই ভূমিকা শুধু গণতন্ত্রের বিকাশকেই বাধাগ্রস্ত করবে না, বরং রাজনীতিবিদদেরই হেয়প্রতিপন্ন করবে। যত দূর জানা যায়, ২০০৬ সালে উচ্চ আদালতে এ-সংক্রান্ত একটি পর্যবেক্ষণ ছিল। তাতে বলা হয়েছিল, একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকা অনৈতিক, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সংবিধানবহির্ভূত। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গত শনিবার হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে ঐকমত্যের সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন। তৃতীয়ত, এরশাদের ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য একটি কলঙ্ক। তাঁর মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বিশেষ দূতের দায়িত্ব নেওয়া রওশন এরশাদের বক্তব্যের বরখেলাপ। রওশন এরশাদ এর আগে বলেছিলেন, 'এরশাদ সাহেব রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাই তাঁর পক্ষে বিরোধীদলীয় প্রধান হওয়া শোভা পায় না।' এখন মন্ত্রীর পদমর্যাদা তিনি পেলেন বটে; কিন্তু তিনি তাঁর হারানো সম্মান ফিরে পাবেন বলে মনে হয় না। তিনি ইতিহাসে ধিক্কৃত একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে চিহ্নিত হবেন এখন। চতুর্থত, সৈয়দ আশরাফের কথা অনুযায়ী 'যাঁরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি, মন্ত্রিসভায় তাঁদের জায়গা হয়নি।' কিন্তু নয়া মন্ত্রিসভায় অনেক অদক্ষ মন্ত্রী রয়েছেন। তা সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যকে সমর্থন করে না। পঞ্চমত, অতিকথন, দুর্নীতিগ্রস্ত ও প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয়নি বলা হলেও এটাও ধোপে টেকে না। কেননা 'অতিকথক' হিসেবে খ্যাত জনৈক প্রতিমন্ত্রী পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন এমন অনেক ব্যক্তির ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। এখন এসব ব্যক্তির কারণে সরকার বিতর্কিত হয়ে পড়তে পারে। ষষ্ঠত, সংস্কারবাদী হিসেবে খ্যাত কয়েকজন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছেন। তাঁরা এখন দল বা সরকারে কতটুকু সংস্কার আনতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়। সপ্তমত, পররাষ্ট্র কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোনো পূর্ণ মন্ত্রী নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যিনি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন, তিনি একেবারেই আনকোরা। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর নূ্যনতম অভিজ্ঞতাও নেই। ফলে দশম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহির্বিশ্বে যে ইমেজ সংকটের মুখে বাংলাদেশ পড়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। সরকারের উচিত হবে দক্ষ একজন টেকনোক্র্যাটকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া। মহাজোট সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি ছিলেন, তিনি গেল সাড়ে চার বছর পৃথিবীব্যাপী ঘুরে বেড়িয়েছেন। মন্ত্রী হয়েও প্রটোকল ভেঙে নিজে ছবি তুলেছেন। অটোগ্রাফ নিয়েছেন ভিআইপিদের। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারেননি। তাঁকে বাদ দেওয়া ভালো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও একজন দক্ষ লোক দরকার। তবে বিতর্কিত ও কট্টর লোকদের এ পদে না দেওয়াই মঙ্গল। মহাজোট সরকারের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাঁরাই ছিলেন, তাঁরা বিতর্কিত হয়েছেন নানা কারণে। অষ্টমত, প্রধানমন্ত্রী এই সরকারকে ঐকমত্যের সরকার বলেছেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এটা মহাজোট সরকারেরই সম্প্রসারণ। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জেপিকে নিয়ে ঐকমত্যের সরকার হয় না। তাদের কোনো গণভিত্তিও নেই। বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে ভোট প্রাপ্তি ১ শতাংশের ওপরে নয়। উপরন্তু 'নৌকা' নিয়েই তাঁরা নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। নবমত, উপদেষ্টারা সবাই পুরনো। তাঁদের এ মুহূর্তে আদৌ প্রয়োজন ছিল না। তবু রাখা হয়েছে। দশমত, মন্ত্রিসভায় নারী নেতৃত্ব একেবারেই কম। একজন পূর্ণ মন্ত্রী মাত্র আছেন ক্যাবিনেটে। এতে ক্যাবিনেটে নারীকুলের সঠিক প্রতিনিধিত্ব হয়নি। মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কোনো 'চমক' নেই। তবে এ মন্ত্রিসভা যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে, তা কিভাবে মোকাবিলা করবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। গত ৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের ১১৩তম কংগ্রেসের প্রথম সেশনেই বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাঁচজন সিনেটর রিনডি ডারবিন, জন বুজম্যান, বারবারি বস্ক্রার, মাইকেল বি এহি ও সিনেটর ত্রিস্টোফার এস মাফি গত ১১ ডিসেম্বর এ প্রস্তাব পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিতে পাঠান। এটি নিয়েই সিনেটে আলোচনা হয় ও প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। সিনেটে গৃহীত প্রস্তাবে ছয়টি বিষয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সত্যিকার অর্থে সংলাপ, অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ, নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা প্রদান, তারানকোর উদ্যোগের প্রতি সমর্থন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। একই সঙ্গে সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান রবার্ট মেনডেজ দুই নেত্রীকে (প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী) যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানো, সহিংসতা বন্ধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে। সিনেটর মেনডেজের চিঠিটি ছাপা হয়েছে গত শনিবার। সিনেটের প্রস্তাব ও সিনেটর মেনডেজের চিঠির মধ্য দিয়ে একটি মেসেজ আমরা পাচ্ছি, আর তা হচ্ছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর একটা পথ হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে সংলাপ শুরু করা। একই সঙ্গে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, তা বিবেচনায় নেওয়াও প্রয়োজন। টেলিগ্রাফে বলা হয়েছে, দুটি বড় দলের মধ্যে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে আংশিক সহযোগিতা হারাতে পারে বাংলাদেশ। এখন একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। বিতর্কিত ও অযোগ্যদের একটা বড় অংশই নয়া মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি, এটা প্রধানমন্ত্রীর 'অবস্থানকে' শক্তিশালী করবে সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু একুশ শতকে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যে মেধা, মনন ও যোগ্যতা থাকা দরকার, তা নয়া মন্ত্রিসভায় আছে বলে মনে হয় না। এমন দু-একজন পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, যাঁদের সংসদীয় কার্যক্রম তেমন উজ্জ্বল নয়। অতীতে সংসদীয় কার্যক্রমে তাঁরা তেমন একটা ভূমিকা রাখতে পারেননি। ফলে তাঁদের অনভিজ্ঞতা মন্ত্রণালয় পরিচালনায় তাঁদেরকে আমলানির্ভর করে তুলবে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত যিনি, তিনি যখন পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। টেকনোক্র্যাট কোটায় যাঁকে পূর্ণ মন্ত্রী করা হলো, তিনি আওয়ামী লীগেরই নেতা। বরং ভালো হতো, যদি সুধীসমাজের মধ্যে থেকে টেকনোক্র্যাট কোটায় দু-একজন মন্ত্রী নেওয়া হতো। একুশ শতকে বাংলাদেশের জন্য এ রকম মন্ত্রী প্রয়োজন রয়েছে। তরুণ নেতৃত্ব মন্ত্রিসভায় এসেছে, তবে সংখ্যায় কম। এই নয়া মন্ত্রিসভা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিয়ম রক্ষা করলেন, কিন্তু 'চমক' সৃষ্টি করতে পারলেন না। প্রধানমন্ত্রীর অনেক আস্থাভাজন ব্যক্তি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায়ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সন্দেহ দানা বাঁধবে এই সরকারের বয়স নিয়ে। নয়া মন্ত্রীরা দক্ষতা কতটুকু দেখাতে পারেন, সেদিকেই আগ্রহ থাকবে এখন সবার।
 Daily KALER KONTHO 14.01.14

0 comments:

Post a Comment